ম্রো সম্প্রদায়, সিকদার গ্রুপ ও আমাদের সরকার
খুব সম্প্রতি সিকদার গ্রুপের বিরুদ্ধে ম্রো সম্প্রদায়ের ভূমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। গত ৮ নভেম্বর ২০২০ বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কের কাপ্রুপাড়া এলাকায় কালচারাল শোডাউন ও সমাবেশ করেছে ম্রো জাতিসত্তার অসংখ্য নারী-পুরুষ।
বান্দরবান জেলা পরিষদ এই বিষয়ে বলেছে তারা বাগান নয় পর্যটন করার জন্যই জায়গাটি লিজ নেন। কিন্তু পর্যাপ্ত তহবিল না থাকায় জেলা পরিষদ প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে না পারায় ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি একটি সংস্থাকে জমিটি ৪০ বছরের জন্য লিজ দেয়। তবে ম্রো নেতারা বলছেন জেলা পরিষদ তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে এবং বাগান করার জন্যই জেলা পরিষদ সেটি লিজ নিয়েছিল। কিন্তু সেটি যে পরবর্তীতে অন্যকে দেয়া হয়েছে সেই বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি ম্রো নেতাদের।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জেলা পরিষদ চোয়ারম্যান নিজেই বলছেন, অনুমোদনের জন্য ২০১২ সালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে পার্বত্য এলাকায় ভূমি বন্দোবস্ত কার্যক্রমে স্থগিতাদেশের শর্তাদি পূরণ না হওয়ায় মন্ত্রণালয় বন্দোবস্ত মামলাটি নিষ্পন্ন করা সম্ভব নয় বলে জানায়। কারন সেটিতে আঞ্চলিক পরিষদ এই লিজ বিষয়ে আপত্তি তোলে। ফলে জায়গাটি পরিষদের নামে বন্দোবস্ত গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন থেকে যায়।
তাহলে জোরালো প্রশ্ন হলো যেখানে জেলা পরিষদের লিজ প্রক্রিয়াটিই ঝুলে ছিল, সেখানে কী প্রক্রিয়ায় এটি তাহলে জেলা পরিষদ অন্যকে দিলো? সেই অধিকার তাদের আছে কীনা? এই বিষয়গুলো নিয়ে জেলা পরিষদের ‘কাঁই-কুঁই’মূলক সাংবাদিক সন্মেলনের বিপরীতে যৌক্তিক গ্রহনযোগ্য জবাবদিহিতা প্রয়োজন। এছাড়া স্থানে স্থানে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সম্বলিত পতাকা প্রস্তাবিত হোটেলের মধ্যে সেট করা হয়েছে, সেটাও তারা করতে পারেন কি না? এই প্রশ্নগুলো থেকেই যায়।
এদিকে সিকদার গ্রুপের উদ্যোগে পাঁচ তারকা হোটেল ‘ম্যারিওট’ হোটেল এন্ড রিসোর্ট নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। সেখানে গিয়ে আমরা দেখতে পেলাম কারবারির অফিস ঘর ভাঙা হয়েছে, সেই স্থান ছেড়ে দিয়ে অফিস ঘর দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন স্থানীয় কারবারি। যদিও জেলা পরিষদ দাবী করেছে সেই জায়গায় কেউ ছিলোনা।
বর্তমানে পুরো এলাকা জুড়ে বাউন্ডারী দেয়া হয়েছে। সেখানে পতাকার মত করে ঝুলছে এই পাঁচতারকা হেটেলের প্রচারনা, সেই পতাকার মত উড়তে থাকা প্লাকার্ডে আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাসৌজ্জ্বল ছবি। এর অনতিদূরেই একটি সাইন বোর্ড, যেখানে ‘Coming soon’ লেখা আছে, দুইটি হেলিপ্যাড নির্মাণসহ এই পর্যটন কেন্দ্রের প্রজেক্টের বিস্তারিত লেখা আছে। একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান কেন তার কোন প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করবেন? কারন হলো মানুষকে ভীত রাখা।
এই ছবি, সাইনবোর্ড দেখে মানুষ ভয় পাবে।ভাববে যখন স্বয়ং রা্ষ্ট্র এই প্রক্রিয়ায় জড়িত তখন সে আর কাছে তার প্রতিবাদ হাজির করবে। এরই মধ্যে জঙ্গল কাটা শুরু হয়েছে, গ্রামের ভিতর দিয়ে রাস্তা তৈরি হবে। এই নিয়ে চিম্বুক পাহাড়ের আশেপাশের মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন এই ভেবে যে তার ঘরও ভাঙা হবে শীঘ্রই। গ্রামবাসীর বক্তব্য ‘কেউ আমাদের সাথে নাই, এমন কি রাষ্ট্রও আমাদের পক্ষে নাই।’
বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়সহ নীলগীরির আশপাশের গ্রামে শত শত বছর ধরে বাস করছেন ম্রো সম্প্রদায়ের মানুষজন। এই পাহাড় এ জাতিসত্তার জীবিকার প্রধান উৎস। চিম্বুক পাহাড়কে ঘিরে ম্রো জনগোষ্ঠীর মানুষদের জীবন-জীবিকা ধ্বংসের এই যে মাস্টার প্ল্যান, উপরে হেলিকপটার, নিচে পাহাড়িদের উপস্থাপন, পাহাড়ের জীব বৈচিত্র্য, প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশের ‘ম্রো উপস্থাপনে’র রাজনীতি কতোটা কোনোভাবেই এই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের পক্ষে যায় না। পর্যটনকেন্দ্র নামে পাহাড়িদের জন্য মরণফাঁদ তৈরি করা হচ্ছে একে কোনোভাবেই উন্নয়ন বলা যাবে না।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.