মোদির CAA ফাঁদ : পাকিস্তান ফিরে যাচ্ছে হিন্দুরা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জাতীয়তাবাদী সরকার ২০১৯ সালে যে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করেছেন, তা থেকে ফায়দা নিতে সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে ভারতে যাওয়া শত শত হিন্দু আবার পাকিস্তান ফেরত চলে যাচ্ছে।
ভারতের মোদি সরকার নতুন এই বিতর্কিত আইনে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে হিন্দু অভিবাসীদের আইনগত অভিবাসনের ব্যবস্থা করেছে।
কিন্তু রাজস্থান রাজ্যের একটি গ্রামে মাত্র কয়েক সপ্তাহ বসবাস করেই বহিরাগত হিন্দুরা বুঝতে পারেন যে হিন্দুস্বর্গ মনে করে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলেন, স্থানটি তেমন নয়। ফলে গত মাসে তারা পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে তাদের আগের গ্রামে ফিরে আসেন। উল্লেখ্য, এই প্রদেশেই পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি হিন্দু বসবাস করে।
ফিরে যাওয়াদের মধ্যে একজন রাম। তিনি বলেন, পাকিস্তানি হওয়ার জন্য আমাদেরকে ঘৃণা করা হতো। আরো খারাপ বিষয় ছিল তাদের দলিত হওয়া। ভারতের প্রাচীন বর্ণবাদী সমাজব্যবস্থায় দলিতরা হলো সর্বনিম্ন স্থানে থাকা বর্ণ।
ভারত ১৯৫৫ সালে বর্ণভিত্তিক বৈষম্য নিষিদ্ধ করলেও দলিতসহ নিম্নবর্ণের গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে বৈষম্য অব্যাহত রয়েছে এবং তাদের শিক্ষা, চাকরি ও আবাসনে সমস্যায় পড়তে হয়।
রামের স্ত্রী রাম দেবী বলেন, তাদের পরিবারকে প্রায় এক বছর একটি বাড়িতে আবদ্ধ রাখা হয। সেখানে খাবার ও পানির সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। তিনি বলেন, সেখানকার জীবন ছিল কারাগারের মতো। পাকিস্তানে ফিরে আসার পর এখন আমার মনে হচ্ছে, আমরা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছি।
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভক্ত হলেও অনেক হিন্দু পাকিস্তানে থেকে যায়। স্বাধীনতার সময় পাকিস্তানে হিন্দু ছিল মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগ। বর্তমানে পাকিস্তানের ২২ কোটি লোকের মধ্যে হিন্দু ১ ভাগের সামান্য বেশি।
মোদির আশ্রয় দেয়ার প্রতিশ্রুতির পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশি বেশি হিন্দু ভারতে গেছে। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইসলামাবাদে ভারতের হাই কমিশন সংখ্যাটি দিতে অস্বীকার করলেও হিউম্যান রাইটস কমিশন অব পাকিস্তানের মতে, গত ৫ বছরে ভারতে অভিবাসন করেছে ৮ হাজার লোক।
তাদের অনেকেই হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে। কারণ তাদের কল্পিত স্বর্গরাজ্য সম্পর্কে তাদের ভুল ভেঙ্গেছে।
সিন্ধু প্রদেশের ঘোটকি গ্রামের গরিব চাষি প্রেম সিং বলেন, তিনি গত বছর ভারতে চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু আট মাস পর ফিরে এসেছেন।
তিনি বলেন, যখন লোকজন জানতে পারল যে আমরা পাকিস্তানি, তখন তাদের মনোভাব সাথে সাথে বদলে গেল। পাকিস্তানের থারপারকার মরুভূমির কৃষক রাম সিং তার জমি বিক্রি করে ভারতের গুজরাটে চলে গিয়েছিলেন। তার কাহিনীও একই রকম।
তিনি বলেন, আমি যখন ভারতে গিয়েছিলাম, তখন আমাদের ঘরবাড়ি বন্ধ করে দেয়া হয়। আমরা এমনকি ওই রাজ্যে আমাদের স্বজনদের সাথেও দেখা করতে যেতে পারিনি। তিনিও ফিরে আসেন।
পাকিস্তান হিউম্যান রাইটস কমিশনের সিন্ধু প্রদেশের প্রধান আসাদ ইকবাল বাট বলেছেন, অভিবাসীরা ভারতের অবতরণের পরপরই স্থানীয় পুলিশ তাদের পাসপোর্ট ও অন্যান্য ভ্রমণ নথিপত্র নিয়ে যায়। তারা যখন ফেরার চিন্তা করে, তখন তারা তাদের ভ্রমণ নথিপত্র পায় না। তারা আশ্রয়ের আবেদন করতে ব্যর্থ হয়, তাদের সঞ্চয় আইনজীবীদের পকেটে চলে যায়।
পাকিস্তান থেকে ভারতে যাওয়া অভিবাসীদের দুর্দশা প্রকটভাবে ফুটে ওঠে গত আগস্টে রাজস্থানের যোধপুরের একটি কৃষিখামারে এক হিন্দু অভিবাসী পরিবারের ১১ সদস্যের লাশ পাওয়ার ঘটনায়। মৃত অভিবাসীদের পরিবার অভিযোগ করেছে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাদেরকে বিষপ্রয়োগ করেছে। তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের স্বজনেরা তারপর থেকে ছোট ছোট বিক্ষোভ সমাবেশ করছে। তবে গত সপ্তাহে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের রাজধানীতে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে প্রথমবারের মতো অবস্থান ধর্মঘট পালন করে।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির হিন্দু আইনজীবী সুরেন্দার বলসাই বলেন, যোধপুরের ঘটনাটি দেখুন। সেখানে পাকিস্তান থেকে যাওয়া দলিত পরিবারের ১১ সদস্যকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, এতে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, ভারত দলিতদের পাকিস্তান থেকে ভারতে যাওয়াকে নিরুৎসাহিত করছে।
নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় ভারতে যাওয়া একদল হিন্দু ও শিখ শরণার্থী পাকিস্তানে ফিরে যাচ্ছে। আর্থিক দৈন্যদশায় তাদের ওই আশা গুড়িয়ে গেছে। বৃহস্পতিবারই তাদের পাকিস্তানের পথে রওয়ানা হওয়ার কথা। ভারতের পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পাসের পর এক বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত সরকার এটি কার্যকরের বিধিমালা তৈরি করতে পারেনি।
বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে আরো বেশি বিপদে পড়েছে ভারতে আটকে পড়া হিন্দুরা। ওয়াগা সীমান্ত ক্রসিং দিয়ে ভারতে এসেছিলো এরা। ভারতের কেন্দ্রিয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এদেরকে পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেও বলেছে যে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা নিয়ে যেসব পাকিস্তানী ভারতে বাস করছে অথবা দীর্ঘমেয়াদি ভিসার জন্য যাদের আবেদন বিবেচনাধীন তাদেরকে সংশ্লিষ্ট এফআরআরও/এফআরও থেকে ফিরে যাওয়ার সনদ নিতে হবে।
পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের ওমরকোট জেলা থেকে আসা ৩৭ বছর বয়সী শ্রীধর দীর্ঘমেয়াদি ভিসা নিয়ে ভারতে থাকছিলেন। তার আশা ছিলো সিএএ থেকে উপকার পাওয়া যাবে কিন্তু এখন দেখছেন অপেক্ষার শেষ নেই।
শ্রীধর বলেন, আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানের ভিসা পাওয়ার জন্য গত চার বছর ধরে যোধপুরে এফআরআরও (ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস) ও নয়াদিল্লীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে ছুটাছুটি করেছি। এখন আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি এবং পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
সিএএ-তে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ভারতে পারি জমানো অমুসলিমদের সহজে নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানায়, পাকিস্তান ফিরে যেতে ইচ্ছুককারীদের আবেদনপত্র পাওয়া গেছে মূলত গুজরাট, রাজস্তান, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও দিল্লী থেকে। মাঠ পর্যায়ের তদন্তকারীরা এসব উদ্বাস্তুকে হয়রানি ও নিপীড়ন করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে নাগরিকত্ব পাওয়ার লোভে ভারতে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টান অভিবাসীদের দুর্দশা আরো বেড়েছে বলে এ বিষয়ে অবগত মহল থেকে জানা গেছে।
সিন্ধুর হায়দ্রাবাদ থেকে আসা মিঠুন বলেন, ভালো থাকতে আমরা ভারতে এসেছিলাম। গত এক বছর ধরে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা পাওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। কোভিড-১৯ লকডাউনের কারণে আমার পরিবার আর্থিক সমস্যায় পড়েছে। এখন আমরা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.