আদিবাসীদের জীবনপ্রণালী ও রাষ্ট্রীয় হীন দৃষ্টিভঙ্গী
স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একটা অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম।দেশের সমতলীয় বাস্তবতার চাইতে তুলনামূলকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা পুরোদমে আলাদা বা পৃথক।পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১৩ ভাষাভাষি ১৪ টি আদিবাসী জাতিসত্বাসমূহের জীবন প্রণালী খুবই মানবেতর।তারা প্রতিনিয়ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রকৃতির সাথে কঠিন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনে।এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের উচু নিচু পথ বেয়ে দুর্বিষহ জীবন নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া আদিবাসীদের একটা নিত্যদিনের অভ্যাস।আদিবাসীদের বেঁচে থাকার তাগিদে প্রকৃতির সাথে এমন নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম বিশ্বের ইতিহাসে নগন্য।একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জাতিসত্বাসমূহের এমন করুণ বাস্তবতারও একটা কারণ আছে বটে।
উল্লেখ্য,পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি রাষ্ট্রের প্রতিকূল বা হীন দৃষ্টিভঙ্গী আদিবাসীদের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে উৎখাত করে চাপিয়ে দিয়েছে মানবেতর জীবন।স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আদৌ আদিবাসীরা স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত, বঞ্চিত তাদের স্বাতন্ত্র্য স্বকীয়তা নিয়ে বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার থেকে।এখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মুক্ত আলো পৌঁছাতে পারেনি পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবেতর জীবন যাপন করা আদিবাসীদের কাছে।একটা স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশে আদিবাসীদের পরাধীনতার লোহ খাঁচায় বন্ধি রাখা রাষ্ট্রের জন্য কতটুকু লজ্জা!!!ভাববার বিষয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের উপর বাংলার গৌরবীয় সন্তান সেনাবাহিনী এবং বহিরাগত অনুপ্রবেশধারী সেটেলার বাঙালী কতৃক যে নিপীড়ন,নির্যাতন এবং রাষ্ট্রীয় শোষণ বঞ্চনার জন্ম দেয়া হয়েছিলো তা বর্তামানেও ব্যাপকভাবে প্রতীয়মান পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে।পাহাড়ে এখনো সেনা শাসন এবং সেটেলার বাঙালীদের অন্যায় অত্যাচারের কোন সরলতা নেই।পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অধিকারহীন আদিবাসীদের সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালীরা একযোগে কখনো পুড়িয়ে মারে আবার কখনো কুঁপিয়ে মারে।আদিবাসীদের বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভূমি বেদখল করে কখনো আদিবাসীদের করে দেশান্তরী!নিজ ভূমিতে পরবাসী।আদিবাসী মা-বোনদের হিংস্র দানবিয় থাবার মূখে করে ফেলে ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর কখনো গলা টিপে,কখনো কুঁপিয়ে,কখনো গাছে ঝুলিয়ে আবার কখনো যৌনাঙ্গে গাছের গুড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে নৃসংশভাবে হত্যা করে বাংলার দামাল ছেলে সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালীরা।
এই তো গেল মাসের ২৯ তারিখেই খাগড়াছড়ি জেলার মিতালী চাকমা নামের একটি আদিবাসী নারীকে নাটকীয়ভাবে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে সেনাবাহিনীর দুই অফিসার খুব ভদ্রভাবে ধর্ষণ করলো।অবশ্যই মিতালী চাকমাকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়াকে দশচক্ষুর আড়ালে রাখতে মিতালী চাকমার সাথে একটি আদিবাসী ছেলেকেও তাঁরা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল।কিন্তু ক্যাম্পে যাওয়ার পরে মিতালী চাকমার কোন দেখাই পেল না মিতালী চাকমার সাথে ক্যাম্পে যাওয়া সেই ছেলেটি।এর আগেও বহুবার সেনাবাহিনী কতৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মা বোনেরা।তার মধ্য আরেকটি আলোচিত ধর্ষণ হচ্ছে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার অরাছড়ি নামক গ্রামে রাতের অন্ধকারে দীঘলছড়ি সেনাক্যাম্পের সেনাবাহিনীর সদস্য কতৃক দুই বোন মারমা কিশোরী ধর্ষণের শিকার হন।পাহাড়ে আদিবাসী নাররীদের ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যা কেবল সেনাবাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় তুলনামূলকভাবে সেটেলার বাঙালীরা আদিবাসী নারী ধর্ষণের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী থেকে অনেক এগিয়ে।সেনাবাহিনী এবং সেটেলার বাঙালীদের এসব অন্যায়ের কোন বিচার হয় না;সম্পূর্ণ বিচার বহিঃর্ভূত।বিচারের দাবিতে যখন আদিবাসীরা রাজপথে নামে তখন আদিবাসী গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রদ্রোহিতার সাইনবোর্ড,দেশদ্রোহিতার সাইনবোর্ড!!!সেনাবাহিনী এবং সেটেলার বাঙালীদের অন্যায়ের বিচার স্বাধীন দেশের মাটিতে হওয়ার কথা ভাবা আর ট্যাক্সি,সিএনজি দিয়ে আমেরিকা কিংবা বিদেশ যাওয়ার চিন্তা করা একিই!রাষ্ট্র ঐসব নরপশুদের বিচার করবে না।কারণ?কারণ একটাই রাষ্ট্রযন্ত্রও মনেপ্রাণে চাই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আদিবাসীরা উৎখাত হোক।তাঁর একটা জ্বলন্ত প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৯ সালের ২৬ মে (তথসময়ে সেনাবাহিনীর কর্ণেল) জেনারেল সালাম ও ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ্'র খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে এক প্রকাশ্য জনসভায় দেওয়া বক্তব্যে।তাঁরা দুজনেই জনসভায় একই সুরে বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন "We want the land,not the people" অর্থাৎ তাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জমি চাই,মানুষ চাই না!তাহলে বিষয়টা কিসে দাড়ালো ভেবে দেখুন।
এবার আসি পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন নিয়ে,সম্প্রতি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রামে যে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে তা অবশ্যই অস্বীকার করার নয়।কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে এসব উন্নয় আদিবাসীদের মতব্যাতীরিকে করা হচ্ছে।আদিবাসীরা কখনো উন্নয়নের বিরোধী নয়,উন্নয়ন অবশ্যই চাই।কিন্তু সেটা বা সে উন্নয়ন হবে আদিবাসীদের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিৎ করার পরে,তার আগে নয়।সরকারের উন্নয়নের বাণী;পার্বত্য চট্টগ্রামে মেডিক্যাল কলেজ হয়েছে,বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে,পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন হয়েছে,আহা কি উন্নয়ন।পার্বত্য চট্টগ্রামে যেখানে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাবস্থা,মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যাবস্থার মান পুরোদমে অনুন্নত সেখানে মেডিক্যাল কলেজ,প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন প্রয়োজনীয়তা আছে কী?আগে প্রাথমিক লেভেল,মাধ্যমিক লেভেল,উচ্চ মাধ্যমিক লেভেলের শিক্ষা ব্যাবস্থা সংস্কার করার চিন্তা না করে মেডিক্যাল কলেজ,বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তা করা কী বোকামী নয়।পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন!!!পর্যটন মানেই আদিবাসীদের জন্য এটা একটা আতংকের নাম।এই উন্নয়ন একদিকে আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে নিজ ভূমিতে পরবাসী বানিয়ে দেয় অন্যদিকে আদিবাসী নারীদের পতিতাবৃত্তির জন্য বাধ্য করে!যে উন্নয়নের ছোঁয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জীবনপ্রণালী ক্রান্তিকালের দিকে ঠেলে দেয় সে উন্নয়নের বিরোধী আদিবাসীরা।আদিবাসীদের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার মধ্য দিয়ে মৌলিক অধিকার নিশ্চিৎ না হওয়া পর্যন্ত এই উন্নয়নের প্রতিকূলে অবস্থান নেবে আদিবাসীরা আজীবন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.