ভেনিজুয়েলায় কেন অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে?
হুয়ান গুইদো এবং নিকোলাস মাদুরো
তেলসমৃদ্ধ দেশ ভেনিজুয়েলায় অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতিমাত্রায় মুদ্রাস্ফীতি, বিদ্যুৎ সঞ্চালন বন্ধ, খাদ্য ও ওষুধের স্বল্পতা দেশটিতে একটি রাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। এই সংকটের মধ্যেই বিরোধী নেতা হুয়ান গুইদো নিজেকে দেশটির অন্তবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। যা বর্তমান সমাজতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর জন্য একটি বড় ধাক্কা। ইতোমধ্যে দেশটিতে মাদুরো বনাম গুইদোর পক্ষ বিপক্ষে নিয়ে এক ভূরাজনৈতিক খেলায় লিপ্ত হয়েছে স্ব স্ব বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলো।
বর্তমান মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাশ করতে গিয়েও চীন, রাশিয়া ভেটো দেয়ার ফলে ব্যর্থ হয়েছে আমেরিকার ওই উদ্যোগ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভেনিজুয়েলায় গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে চেয়ে গুইদোর পক্ষ নিতে তার সুরে অন্যান্য দেশকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে। যার ফল মিলতে শুরু করেছে। দেশি এবং আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট মাদুরো সংলাপের জন্য গুইদোকে আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সেটা প্রত্যাখান করে ভেনিজুয়েলার মানুষকে মুক্ত না করা পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বেন না বলে হুশিয়ারি দিয়েছেন গুইদো।
অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেকগুলো দেশ ৮ দিনের মধ্যে মাদুরোকে আরেকটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেয়ার জন্য ৮ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছে। অন্যথায় তারা স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট গুইদোকে বৈধ প্রেসিডেন্টের স্বীকৃতি দিবে বলে জানিয়েছে। তবে এই আলটিমেটার প্রত্যাখান করেছে ভেনিজুয়েলা। ফলে সংকট আরো গভীর হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
মাদুরো বিরোধী বিক্ষোভে ইতোমধ্যে দেশটিতে অন্তত ২৬জন মারা গেছে। দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে ইতোমধ্যে জাতিসংঘ সর্তক করে দিয়েছে। ক্ষুধা, বেকারত্ব বৃদ্ধি, ওষুধের অভাবে দেশটি থেকে ইতিমধ্যে ৩০ লাখেরও বেশি লোক দেশ ত্যাগ করেছে। দেশটিতে বিদ্যমান সংকটের নেপথ্যে থাকা ৭ কারণের ব্যাখ্যা দিয়েছে সংবাদ মাধ্যম বিবিসি।
হাস্যকর মুদ্রাস্ফীতি
ভেনিজুয়েলার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অতিমাত্রায় মুদ্রাস্ফীতি। দেশটির বিরোধী নিয়ন্ত্রিত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলীর তথ্য বলছে, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে দেশটিতে ১৩ লাখ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে। বছর শেষে প্রতিটি পণ্যের দাম গড়ে ১৯ দিনে দ্বিগুণ হয়েছে।
এসবের কারণে ভেনিজুয়েলার সাধারণ মানুষ খাদ্য, প্রসাধনীর মতো প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। একই সঙ্গে দেশটির স্থানীয় মুদ্রায় ডলার কিনতে ব্যয় বাড়ছে দ্রুত।
প্রবৃদ্ধির পতন
লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে তেল মজুদে শীর্ষে থাকা দেশটি এক সময় অনেক শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাদুরো এবং তার পূর্বসূরী প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের সময় দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং অধিক মাত্রায় ঋণকে দেশটির অর্থনীতির পতনের কারণ হিসেবে দেখা হয়। তেলের দাম বৃদ্ধি সুবিধায় ২০০০ সালে দেশটির প্রয়াত নেতা হুগো শ্যাভেজ ঋণ সুবিধা পেয়েছিল এবং সে সময় সরকারের ব্যয় ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। পরবর্তীতে মাদুরো সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় থাকাকালে দেশটির অর্থনীতি বড় ধরনের পতনের শিকার। ২০১৬ তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় ভেনিজুয়েলার সংকট জটিল আকার ধারণ করতে শুরু করে।
পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব
দিনে দিনে ভেনিজুয়েলার ক্ষুধার তীব্র হচ্ছে। দেশটির জীবনমান জরিপ-২০১৭তে দেখা যায়, প্রতি ১০ জনের ৮ জন বলেছেন তারা পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে প্রয়োজনের চেয়ে কম খাচ্ছেন। প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জন বলেছেন খাবার কেনার টাকা না থাকায় না খেয়ে ঘুমাতে যেতে হয়। যেটা তাদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ বলেছে তারা ২০১৭ সালে গড়ে ১১ দশমিক ৪ কেজি ওজন কমেছে।
এছাড়া প্রথাগত খাবারের পরিমাণ এবং মান দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। দশজনের মধ্যে ৯ জনের প্রতিদিনের খাবার সরবরাহ করতে পারে না। ৮২ লাখ মানুষ দিনে দুই বেলা বা তার চেয়ে কম খেতে হচ্ছে। এছাড়া আয়রন, ভিটামিন এবং পুষ্টিকর খাবারের অভাব দেখা দিয়েছে।
পর্যাপ্ত ওষুধের অভাব
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভেনিজুয়েলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে এবং আক্রান্তদের সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৬১ সালে যে দেশটি প্রথম ম্যালেরিয়া দূর করার জন্য সনদ অর্জন করেছিল সেই ভেনিজুয়েলায় এখন প্রতি ২৪ জনের একজন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত। দেশটিতে ম্যালেরিয়া নিরোধ ওষুধ স্বল্পতা তৈরি হয়েছে।
তেল উৎপাদন কমে যাওয়া
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অপরিশোধিত তেল ও পেট্রোল সরবরাহকারী দেশ ছিল ভেনিজুয়েলা। যা দেশটির রপ্তানি আয়ের বড় অংশই। ২০০২ সালের পর থেকে অনেক বেশি তেল উৎপাদন হতে থাকে দেশটিতে। দেশটিতে জাতীয় ধর্মঘট শুরু হওয়ার আগ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যেটি অব্যহত থাকে। এই সময় তেলের দাম অনেক বেশি ছিল।
ওপেকের দেয়া তথ্যমতে, সে সময় প্রতিবছর ৬০ বিলিয়ন ডলার শুধু তেল বিক্রি করে আয় করে ভেনিজুয়েলা। তবে ২০১৩ সালে শ্যাভেজের মৃত্যুর এক বছর পর থেকে তেলের দাম কমতে শুরু করে। সেখান থেকে তেল নির্ভর অর্থনীতির দেশটিকে সংকট মোকাবিলায় কাজ করতে হচ্ছে।
দেশত্যাগ
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, ২০১৪ সালের পর থেকে প্রায় ৩০ লাখেরও বেশি লোক দেশত্যাগ করেছে। যাদের অধিকাংশ পাশ্ববর্তী দেশ কলম্বিয়া, পেরু, চিলি, ইকুয়েডর, ব্রাজিলে আশ্রয় নিয়েছে। তবে দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেলছি রদগ্রিজ জাতিসংঘের দেয়া ওই তথ্য প্রত্যাখান করেছেন। তিনি বলেছেন, দেশটিতে সামরিক হস্তক্ষেপ তৈরি করতে বৈরী দেশের হয়ে জাতিসংঘ এই সংখ্যা তৈরি করেছে।
সমর্থনে বিভক্ত দেশ
নিজের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের কয়েকদিনের মধ্যে চলমান বিক্ষোভের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ লাতিন আমেরিকার এক ডজনেরও বেশি দেশ ইতোমধ্যে মাদুরোর বিরোধীতা করে গুইদোকে সমর্থন দিয়েছে। রোববার স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য ঘোষণা দিয়েছে ৮ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন না হলে তারা গুইদোকে সমর্থন দিবে। কিন্তু রাশিয়া এই ঘটনাকে সমালোচনা করেছে। তারা মনে করে এই ধরনের সমর্থন আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী এবং দেশটিতে রক্তপাতের পথ তৈরি করবে। চীন, মেক্সিকো, তুরস্ক অবশ্য মাদুরোকে সমর্থন দিয়েছে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.