পূর্ব সংঘটিত হত্যাকান্ড,প্রেক্ষিত পাহাড়
প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২৫ মার্চ ১৯৮০ সালে।ঐ দিন কাউখালী থানার সেনাকর্মকর্তা কলমপতি ইউনিয়নভুক্ত নোয়াপাড়া বৌদ্ধ মন্দিরটির আসন্ন কিছু উৎসব উপলক্ষে মেরামতের বিষয়টি আলোচনার জন্য স্থানীয় জুম্ম গ্রামবাসীদের সমবেত হওয়ার নির্দেশ দেন।যখন গ্রামবাসীরা সমবেত হয় তখন সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য সমবেত গ্রামবাসীদের উপর অতর্কিতভাবে গুলি চালায়।এতে আনুমানিক ৩০০ পাহাড়ী জুম্ম নিহত হয় এবং আরো অনেকেই আহত হয়।এরপর সেনাবাহিনীর সদস্য এবং নতুন বসতিকারী সেটেলার বাঙালীরা একযোগে কলমপতি ইউনিয়নের ২০টি গ্রামের উপর আক্রমন চালায়,বাড়িঘর লুন্ঠন করে,জ্বালিয়ে দেয় এবং ইউনিয়নের ৯টি বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস করে দেয়।২০ জন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে কুপিয়ে হত্যা এবং মারধর করা হয়।তাছারা ৩০ জন জুম্ম নারীকে অপহরন করে ধর্ষণ করা হয়।এরপর ১৯৮১ সালের ২৫ জুন মাটিরাঙ্গা এবং বেলছড়ি এলাকার জুম্ম গ্রামগুলিতে যথাক্রমে আক্রমন চালানো হয়।এবং নির্বিচারে জুম্ম পাহাড়ীদের হত্যা করা হয়।শতশত বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং লুন্ঠন করা হয়।এতে কয়েকশত জুম্ম পাহাড়ি নিহত এবং আহত হয়।ঐ ঘটনার পর রামগড়,মাটিরাঙ্গা এবং তার আশপাশের গ্রামগুলি হতে ২০ হাজার জুম্ম পাহাড়ী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।এরপর গণহত্যা ঘটে ১৯৮৪ সালের ৩১ মে হতে ৭ জুন পর্যন্ত ভূষণছড়া এবং ছোট হরিনা মৌজায়।নতুন বসতিকারী সেটেলার বাঙালীরা জুম্ম পাহাড়ীদের পাকা ধান কেটে দিলে জুম্ম পাহাড়ীরা তাদের বাঁধা প্রদান করার চেষ্টা করে। ঐ প্রতিক্রিয়ার ফলে সেনাবাহিনী,বিডিআর এবং সেটেলার বাঙালীরা একযোগে জুম্ম পাহাড়ীদের গ্রামগুলোতে ব্যাপক নৃসংশ আক্রমন চালায়।ঐ আক্রমনে ৬২ জন জুম্ম পাহাড়ী নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়।তাছারা ৭ জন জুম্ম পাহাড়ী নারীকে ধর্ষণ করা হয় এবং গ্রামগুলি জ্বালিয়ে দেয়া হয়।ফলে ৪৫৩০ জন জুম্ম পাহাড়ী পার্শ্ববর্তী ভারতের মিজোরাম রাজ্যে মানবেতর জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।কয়েকমাস পর মিজোরাম সরকার তাদের জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিলে তারা আবারো সেনাবাহিনী এবং সেটেলার বাঙালীদের দ্ধারা অত্যাচারের শিকার হয়।
এরকম গণহত্যা আরো ঘটে ১৯৮৬ সালের ১ মে তারিখে পানছড়ি এবং মাটিরাঙ্গা এলাকায়,১৮ মে তারিখে রামবাবু ডেবা গ্রামে এবং ঐ একই সালে ১৯ ডিসেম্বর চংড়াছড়ি এবং মেরুং মৌজায়।ঐসব সংগঠিত ঘটনায় ২৩৮ জন জুম্ম নিহত হয় এবং ৪৮০ জনের বেশি আহত হয় এবং ২০৯ জন নিখোঁজ হয়।ধারনামতে তারাও নিহত হয়েছে।কারণ তাদের পরবর্তীতে আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।তাদের মধ্য অধিকাংশ নারী এবং শিশু।
১৯৮৮ সালের ৮-১০ আগস্ট তারিখে সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালীরা এক সঙ্গে যুগপৎ আক্রমন চালায় হিরাচর,সারবোতুলী,খাগড়াছড়ি এবং পাবলাখালী গ্রামে।গ্রামগুলো ছিল পাশাপাশি।এতেও শতাধিক জুম্ম নিহত হয় এবং আহত হয়।অনেকেই আবার পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।এরপর ১৯৮৯ সালের ৪মে তারিখে আরও একটি বড়ধরণের গণহত্যা ঘটে।ঐদিন কে বা কারা লুংগুদু উপজেলার চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ সরকারকে হত্যা করে চলে যায়। জুম্মদের মনে আক্রমনের আশঙ্কার জন্ম হলে এলাকার পূর্ব উপজেলা চেয়ারম্যান অনিল চাকমার বাড়িতে আশ্রয় নেয় জুম্মরা।কারণ দীর্ঘদিন অনিল চাকমা লুংগুদু উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালে এলাকার পাহাড়ী এবং বাঙালী সবাই তাকে সম্মান করত।কিন্তু সেদিন নতুন বসতিকারী সেটেলার বাঙালী এবং গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা একযোগে অনিল চাকমার বাড়ী সহ আশপাশের জুম্ম গ্রামগুলোর বাড়ীঘর আক্রমন করে বাড়ীঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং লুঠপাট করে।এবং জুম্মদের নির্বিচারে হত্যা করে।অনিল চাকমার স্ত্রী সহ সেদিন প্রায় ১০০ জন জুম্মকে হত্যা করে গ্রামপ্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য এবং সেটেলার বাঙালীরা।উল্লেখ্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সবাই ছিল বাঙালী এবং সরকারই তাদের অস্ত্র সরবরাহ করে দেয়।সে অস্ত্র দিয়ে সেদিন তারা জুম্মদের আক্রমন করে এবং হত্যা করে ও অনেক জুম্ম আহত হয়।এরপর আরো একটি গণহত্যা ঘটে ১৯৯৩ সালের ১৭ নভেম্বর নানিয়াচড় বাজারে।সেদিন ছিল হাটবাজার।শত শত জুম্ম বাজারে এসেছিল।সেদিন সকালে সেনাবাহিনীর সদস্যদের লঞ্চঘাটে একটি যাত্রাছাউনি দখলের বিরুদ্ধে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ একটি মিছিল বের করে।সেই প্রতিক্রিয়ায় সেনা সদস্য এবং নতুন বসতি স্থাপনকারীগণ বাজারে উপস্থিত জুম্ম জনগণসহ মিছিলকারী ছাত্রদের ওপর অতর্কিত আক্রমন চালায়।সেই আক্রমনে ২৯ জন পাহাড়ি নিহত,১৬২ জন আহত এবং ৭৩ জন নিখোঁজ হয়।এর পূর্বে ১৯৯২ সালে ১০ এপ্রিল তারিখে আরও একটি গণহত্যা ঘটে পানছড়ি থানার লোগাং গুচ্ছগ্রামে।সেদিন সকালে নতুন বসতিকারীগণ উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করে যে গুচ্ছগ্রামে জুম্মগন একজন বাঙালী রাখাল বালককে হত্যা করেছে।সেই প্রতিক্রিয়ায় দুপুর বেলা নতুন বসতিকারী এবং নিরাপত্তা বাহিনী একযোগে গুচ্ছগ্রামটিকে আক্রমন করে ঘরগুলো জ্বালিয়ে দেয় এবং পাহাড়ী জুম্মদের আক্রমন ও হত্যা করতে থাকে।সেই ঘটনায় কমপক্ষে ৩০০ জন নারী পুরুষ ও শিশু নিহত হয় এবং আরো অনেকেই আহত হয়।আনুমানিক ৭০০ বাড়ীঘর পুড়ে যায়।ঘটনাটি দেশে বিদেশে বিস্তর প্রচার লাভ করে।কারণ ঘটনার দু একদিন আগে একটি মানবাধিকার গ্রুপ বিজু উৎসব উপলক্ষে খাগড়াছড়ি গিয়েছিল এবং তাদের খাগড়াছড়ি থাকার সময়ে ঘটনাটি ঘটে।কিন্তু সেনাবাহিনী মানবাধিকার গ্রুপটিকে ঘটনাস্থলে যেতে দেয় নি।এমনকি সেনাবাহিনীরা তথসময়ের জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সমীরন দেওয়ানকেও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে যেতে দেয়া হয় নি।
এরকম ছোটবড় ঘটনা রাংগামাটি এবং খাগড়াছড়ি জেলায় ১৯৭৬ সাল হতে বিশেষ করে জেনারেল এরশাদের আমলে বহু ঘটেছিলো এবং এসব ঘটনায় শত শত জুম্ম পাহাড়ী নারী পুরুষ,শিশু নিহত,আহত এবং নিখোঁজ হয়।তাছারা হাজার হাজার জুম্ম বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
এসব ঘটনা ব্যাতিক্রম বাদে তদন্ত হয়নি এবং সংবাদপত্রেও প্রকাশ পায় নি।কেবল লোগাং গণহত্যা কান্ড এবং নানিয়াচর হত্যাকান্ড একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দ্ধারা তদন্ত করা হয়েছিলো,সেই রিপোর্টও প্রকাশ পায় নি।তাছারা কোন অপ।রাধীকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে অথবা বিচারের সম্মূখীন হতে হয়েছে এমনও শোনা যায় নি।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.