দয়ার সাগর আব্দুস সাত্তার ইধিকে কি আপনি চিনেন?
আব্দুস সাত্তার ইধি (১৯২৪-২০১৬)
আবদুস সাত্তার ইধি সামাজিক কাজে বিপ্লব করা একজন মানুষ। মানুষের কাছ থেকে টাকা সাহায্য নিয়ে যিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন সবচেয়ে বড় দাতব্য প্রতিষ্ঠান। ইধি ছিলেন পাকিস্তানের একজন জনহিতৈষী, সমাজসেবী ও মানবতাবাদি। তিনি ইধি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান ছিলেন। ছয় দশকব্যপী তিনি এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। তাকে দয়ার ফেরেশতা নামে ডাকা হত এবং পাকিস্তানের সবচেয়ে সম্মানিত ও কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তি বিবেচিত করা হয়।
আবদুস সাত্তার ইধি ১৯২৮ সালে ব্রিটিশ ভারতের গুজরাটের বান্টভায় জন্মগ্রহণ করেন। ইধির ১১ বছর বয়সে তার মা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হন এবং ১৯ বছর বয়সে মারা যান। পরবর্তী জীবনে দুস্থদের সহায়তামূলক কাজের ক্ষেত্রে তার মায়ের অসুস্থতাকালীন সময়টি ভূমিকা রেখেছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ইধি সপরিবারে পাকিস্তানে চলে আসেন। তিনি করাচিতে বসবাস শুরু করেন এবং একটি পাইকারি দোকানে কাজ নেন। কয়েকবছর পরে অন্যদের সহায়তায় তিনি একটি বিনামূল্যের ডিসপেনসারি চালু করেন।
ইধি ফাউন্ডেশনের জন্য নিজেই ভিক্ষে করতেন আব্দুস সাত্তার ইধি
দরিদ্রদের সহায়তার জন্য ইধি তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। পাকিস্তানে তিনি সেবামূলক কর্মকাণ্ডের দৃশ্য বদলে দেন। তিনি ইধি ফাউন্ডেশন গঠন করেন। পাশাপাশি ৫,০০০ রুপি দিয়ে ইধি ট্রাস্ট নামে একটি কল্যাণমূলক ট্রাস্ট চালু করেন। পরে এর নাম বদলে বিলকিস ইধি ট্রাস্ট রাখা হয়। অন্যান্যদের কাছ থেকে তিনি অনেক অর্থ সহায়তা পান। ফলে তার কাজের ব্যপ্তি বৃদ্ধি পায়।
বর্তমানে এটি পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ কল্যাণমূলক সংগঠন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত ইধি ফাউন্ডেশন ২০,০০০ এর বেশি পরিত্যক্ত শিশুকে উদ্ধার, ৫০,০০০ এর বেশি এতিমকে পুনর্বাসন ও ৪০,০০০ এর বেশি নার্সকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। এছাড়াও এই সংগঠন শহর ও গ্রাম এলাকায় ৩৩০টি সেবামূলক কেন্দ্র চালিয়ে থাকে।
এসব কেন্দ্র থেকে রান্নার স্থান, পুনর্বাসন স্থল, অসহায় নারী ও শিশুদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র এবং মানসিক ভারসাম্যহীনদের জন্য ক্লিনিক পরিচালনা করা হয়। ইধি ফাউন্ডেশনের একটি মজার ব্যাপার হলো ইধি ঝোলা। এই ঝোলাতে যে কেউ কোন বাচ্চা রেখে গেলে সে বাচ্চার দায়িত্ব ইধি ফাউন্ডেশনের।
ইধি ফাউন্ডেশনে ইয়াতিম বাচ্চাদের সাথে নিজেই খেতেন, তাদেরকে রাখতেন নিজের মতো করে
ইধি ফাউন্ডেশন বিশ্বের সর্ববৃহৎ এম্বুলেন্স সার্ভিস পরিচালনা করে। দুই হাজার অ্যামবুলেন্স,৪০ টি রেসকিউ বোট,দুটি এয়ারপ্লেন এবং একটি হেলিকপ্টার নিয়ে গঠিত ইধি ফাউন্ডেশনের অ্যামবুলেন্স সার্ভিস। এই ফাউন্ডেশনের আছে মানসিক ভারসাম্যহীন ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য আশ্রম, মেডিক্যাল ক্লিনিক, মরচুয়ারি, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র, দত্তক গ্রহণ কেন্দ্র ও ক্যান্সার হসপিটাল।
এছাড়াও তারা ২৪ ঘন্টার জরুরি সেবা দিয়ে থাকে। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ককেসাস অঞ্চল, পূর্ব ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে এটি ত্রাণমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। ২০০৫ সালে হারিকেন ক্যাটরিনার পর যুক্তরাষ্ট্রে সহায়তা প্রদান করা হয়। বিবিসির বর্ণনায় তাকে পাকিস্তানের সবচেয়ে সম্মানিত এবং অনেকের দৃষ্টিতে সুফির সমতুল্য ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
একেবারে শ্রমিকদের মত করে ইধি ফাউন্ডেশনের কাজ নিজের হাতেই করতেন তিনি
প্রতিদিন নানা সাহায্যের জন্য পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছয় হাজার ফোনকল আসে ইধি ফাউন্ডেশনে।করাচীতে হেড অফিসে আছে সার্বক্ষণিক কম্পিউটারাইজড মনিটরিং, যাতে করে সাহায্য চাওয়ার সর্বোচ্চ পনেরো মিনিটের মধ্যেই অ্যামবুলেন্স পৌঁছানো যায়।
মাত্র ৩০ হাজার রুপিতে শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানের বিশাল দক্ষযজ্ঞ সামলাতে এখন বার্ষিক ২২ মিলিয়ন ইউএস ডলারের বাজেটের প্রয়োজন হয়।অদ্ভুত ব্যাপার হল এই পুরো টাকাটাই আসে জনসাধারণের ব্যক্তিগত দান থেকে।অর্থাৎ কোন সরকার,ধর্মীয় সংঘ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে অনুদান গ্রহণ করে না ইধি ফাউন্ডেশন। এই দানে খারাপ 'উদ্দেশ্য' লুকানো থাকে। কখনো ফান্ড তুলতে মাইলের পর মাইলও হেটেছেন। কয়েকবছর আগে পেশোয়ারের এক রাস্তার পাশে বসে পড়েন আবদুল সাত্তার ইধি। জনগণও তাকে হতাশ করেননি। দিয়েছিল বাংলাদেশী টাকার বারো লক্ষ সমমানের অর্থ। এরকম একবার পায়ে এক মাইল হেঁটে মাত্র এক ঘন্টার ভিতরেই তুলেছিলেন এক লাখ রূপি। সেই পদযাত্রায় শেষ পর্যন্ত আড়াই লাখ রূপি।
কোন সংস্থার সাহায্য না নিয়ে এভাবেই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করতেন ইধি
২০০৬ সালে করাচির ইন্সটিটউট অব বিজনেজ এডমিনিস্ট্রেশন তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে বেডফোর্ডশায়ার বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট প্রদান করে। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে নিশান-ই-ইমতিয়াজ খেতাব দেয়। ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের পাঠকদের ভোটে তিনি ২০১৩ এর পারসন অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালে ইধির জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ৩০,০০০ এর বেশি স্বাক্ষর সংবলিত মালালা ইউসুফজাইয়ের বাবা জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাইয়ের আবেদনসহ নোবেল শান্তি পুরস্কারের আবেদন করেছিলেন।
আবদুস সাত্তার ইধি ১৯৬৫ সালে ইধি ডিসপেনসারির নার্স বিলকিস ইধিকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির দুই পুত্র ও দুই কন্যা রয়েছে। তিনি তার সহজসরল জীবনযাপনের জন্যও পরিচিত। তার শুধু দুইটি কাপড় ছিল। সংগঠন থেকে তিনি কোনো বেতন নিতেন না এবং অফিসের পাশে একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। নিজের ব্যাপারে বলতেন,আমি গরীবের জন্য ভিক্ষা করি। তাকে ডাকা হতো The Richest Poor Man (সবচেয়ে ধনী কিন্তু গরিব) ব্যক্তি হিসেবে।
শিশুদের তিনি ভালোবাসতেন দারুণ
২০১৩ সালের ২৫ জুন আবদুস সাত্তার ইধির কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে। ২০১৬ সালের ৮ জুলাই কিডনির নিষ্ক্রিয়তার জন্য তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পর অঙ্গ দানের ইচ্ছা থাকলেও তার অসুস্থতার কারণে শুধু কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা সম্ভব ছিল। করাচির ইধি পল্লীতে তাকে দাফন করা হয়।
তার মৃত্যুর পর পাকিস্তানের অনেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তি শোক প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বলেন "আমরা মানবতার একজন প্রকৃত সেবককে হারিয়েছে"। সেনাপ্রধান রাহিল শরিফ তাকে একজন "প্রকৃত মানবতাবাদি" বলে উল্লেখ করেন। তার মৃত্যুর পরেরদিন জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়। তাকে গার্ড অব অনার ও ১৯টি গান স্যালুট প্রদান করা হয়। পাকিস্তানিদের মধ্যে ইতিপূর্বে শুধু মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ও জিয়াউল হক এরূপ সম্মান লাভ করেছিলেন। করাচির জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত তার জানাজায় রাষ্ট্রপতি, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানসহ অনেক রাষ্ট্রীয় উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
মৃত্যুর পর ইধি সাহেবের জানাজায় মানুষের ঢল, পাকিস্তান হারিয়েছে তাদের সেরা একজন মানবকে
আন্তর্জাতিক পুরস্কার:
# রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার (১৯৮৬)
# লেনিন শান্তি পুরস্কার (১৯৮৮)
# পল হ্যারিস ফেলো, রোটারী ইন্টারন্যাশনাল (১৯৯৩)
# আর্মেনিয়ার ভূমিকম্পে সহায়তার জন্য সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শান্তি পুরস্কার (১৯৯৮)
# হামদান এওয়ার্ড (২০০০)
# আন্তর্জাতিক বালজান পুরস্কার (২০০০)
# শান্তি ও সম্প্রীতি পুরস্কার (২০০১), দিল্লি
# শান্তি পুরস্কার (২০০৪), মুম্বাই
# শান্তি পুরস্কার (২০০৫), হায়দ্রাবাদ
# গান্ধী শান্তি পুরস্কার (২০০৭), দিল্লি
# শান্তি পুরস্কার (২০০৮), সিউল
# সম্মানসূচক ডক্টরেট, করাচির ইন্সটিটিউট অব বিজনেজ এডমিনিস্ট্রেশন (২০০৬)
# ইউনেস্কো-মদনজিত সিং পুরস্কার (২০০০)
#আহমদিয়া মুসলিম শান্তি পুরস্কার (২০১০)
জাতীয় পুরস্কার:
# সিলভার জুবিলী পদক, কলেজ অব ফিজিশিয়ান এন্ড সার্জনস পাকিস্তান (১৯৬২–১৯৮৭)
# মুইজউর রহমান পুরস্কার (২০১৫)
# উপমহাদেশের সমাজসেবী, সিন্ধু সরকার (১৯৮৯)
# নিশান-ই-ইমতিয়াজ, পাকিস্তান সরকার (১৯৮৯)
# নির্যাতিত মানুষের প্রতি কৃতিত্বপূর্ণ দায়িত্বের স্বীকৃতি, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, পাকিস্তান
সরকার (১৯৮৯)
# পাকিস্তান নাগরিক পুরস্কার, পাকিস্তান নাগরিক সমাজ (১৯৯২)
# সম্মাননা পদক, পাকিস্তান সেনাবাহিনী
# খিদমত পুরস্কার, পাকিস্তান একাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্স
# বাচা খান শান্তি পুরস্কার (১৯৯১)
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.