যে নারীকে কেন্দ্র করে সৌদি-কানাডা সংকট শুরু হয়
সন্তানসহ সামার বাদাউই
মানবাধিকার এবং নারী স্বাধীনতার দিক থেকে বিশ্বে সৌদি আরবের অবস্থান খুবই খারাপ। কঠোর আইন আর গোঁড়া সামাজিক ব্যবস্থার কারণে মুখ খুলে প্রতিবাদ করার মতো সাহস সেখানে কারো নেই। বছরের পর বছর ধরে মদ্যপ, উশৃঙ্খল, ধর্ষকামী পুরুষদের হাতে নির্যাতিত হয়ে আসলেও সেটাকেই নিজেদের ভাগ্য হিসেবে বরণ করে নেয় সেখানকার নারীরা।
কিন্তু ব্যতিক্রমও আছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভীড়ে দুই একজন ক্ষণজন্মা প্রতিবাদী নারীর সন্ধানও মাঝেমাঝে পাওয়া যায়, যারা নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দেয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে নির্যাতিত হতে হবে জেনেও দাবি তোলে সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় আইন সংস্কারের, অসম আইনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় রাষ্ট্রীয় অঙ্গসংগঠগুলোর বিরুদ্ধে। আর এগুলো করতে গিয়ে বারবার কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রেপ্তার হয়, কারা বরণ করে। এরকমই এক ক্ষণজন্মা নারী সামার বাদাউই, যার গ্রেপ্তার এবং মুক্তি দাবিকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি সৌদি আরব এবং কানাডার মধ্যে শুরু হয়েছে নজিরবিহীন কূটনৈতিক যুদ্ধ।
তার জন্ম ১৯৮১ সালে। ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছেন অত্যন্ত প্রতিকূল পারিবারিক পরিবেশে। বাবা মোহাম্মদ বাদাউই ছিলেন পরিবারের প্রতি দায়িত্বহীন এবং উশৃঙ্খল প্রকৃতির। এ পর্যন্ত মোট ১৪টি বিয়ে করেছেন। অসৎ বন্ধুবান্ধবের সাথে মিশতেন, অবাধে অর্থ অপচয় করতেন, নিয়মিত নেশা করতেন, এবং সামারকে মৌখিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন।
পিতার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে কিশোরীকালেই দুইবার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। একবার ১৩ বছর বয়সে এবং আরেকবার ১৬ বছর বয়সে। সে সময় ব্যর্থ হলেও পরবর্তীতে ২০০৮ সালে, ২৬ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান এবং জেদ্দায় নির্যাতিত মহিলাদের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে ওঠেন।
জীবনসঙ্গীর সাথে সামার বাদাউই
বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা অবশ্য সৌদি আরবে বিরল কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু সামার শুধু পালিয়ে গিয়েই থেমে যাননি। তিনি জেদ্দা পাবলিক কোর্টে আবেদন করে বসেন যেন তার বাবাকে তার অভিভাবকত্বের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ২০০৯ সালে তার বাবা তার বিরুদ্ধে জেদ্দা ক্রিমিনাল কোর্টে অবাধ্যতার অভিযোগে মামলা করে বসেন। ফলে মামলার বিচারক সামারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
তবে জেদ্দার মেয়র মিশা’ল বিন আব্দুল আজিজের মধ্যস্থতায় তিনি আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে তার ভাইয়ের বাসায় গিয়ে ওঠেন। ২০১০ সালে মামলা চলাকালীন সময়েই তার বাবা তাকে বিয়ে করার অনুমতি না দিলে তিনি বাবার বিরুদ্ধে ‘আদ্ল’ এর মামলা করেন, যেহেতু সৌদি আরবের শরিয়া আইন অনুযায়ী পুরুষ অভিভাবকের তার অধীনস্ত নারীর বিয়ের ব্যাপারে বাধা দেওয়ার অধিকার নেই।
এখানেই শেষ নয়, সামারকে তার বাবার অবাধ্যতার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘদিন মামলা চালিয়ে তিনি বাবার বিরুদ্ধে জয়ী হন। তিনি তার আইনজীবীকে বিয়ে করেন।
মিশেল ওবামা ও হিলারি ক্লিনটনের সাথে সামার বাদাউই
এরপর তিনি নারীদের ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তার আন্দোলন ধীরে ধীরে জোরালো হয়। অবশেষ রাষ্ট্র পৌরসভা নির্বাচনে ভোট দেয়ার ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পায়। কিন্তু এজন্যও তাকে বার বার গ্রেপ্তার হতে হয়। তার ভাই ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও হয়রানীর শিকার হতে হয়।
সম্প্রতি সৌদি আরব নারীদের ড্রাইভিংয়ের অনুমতি দেওয়াসহ বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু একইসাথে অধিকতর সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে।
গত মে মাস থেকে সৌদি আরব এখন পর্যন্ত অন্তত ১৫ জন নারী অধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের অনেকের বিরুদ্ধে বিদেশি রাষ্ট্রের হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে, যার ফলে তাদের ২০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। সৌদি যুবরাজ এক্ষেত্রে এরকম নীতি অনুসরণ করছেন যে, তিনি তার নিজের ইচ্ছেমতো কিছু সংস্কার করবেন, কিন্তু সে ব্যাপারে কারো কোনো সমালোচনা সহ্য করবেন না।
নারী অধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে চলমান এ গ্রেপ্তার অভিযানের ধারাবাহিকতায় গত ৩০ জুলাই সৌদি কর্তৃপক্ষ সামার বাদাউই এবং নাসিমা আল-সাদাহ নামে আরেকজন নারী অধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। সামারের ভাই রাইফকে গ্রেপ্তারের পর তার স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততিরা কানাডায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। সম্প্রতি তারা কানাডার নাগরিকত্বও অর্জন করেছে।
২০১৩ সালে OLOF PALME PRIZE লাভ করেন সামার বাদাউই
কানাডা এমনিতেই সবসময় বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলে। তদুপরি এক কানাডিয়ান নাগরিকের পরিবারের সদস্যকে গ্রেপ্তার করায় কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর তীব্র সমালোচনা করে এবং অবিলম্বে সামারসহ অন্যান্য মানবাধিকার কর্মীদের মুক্তি দাবি করে একটি টুইট বার্তা প্রকাশ করে।
সামারের মুক্তি দাবি করা কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঐ টুইটের বিরুদ্ধে সৌদি আরব তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। তারা এটিকে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং সার্বভৌমত্বের উপর হস্তক্ষেপ হিসেবে অভিযোগ করে। এর পরপরই তারা কানাডার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারসহ কানাডার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কানাডার বিরুদ্ধে সৌদি আরবের এরকম কঠোর অবস্থানে যাওয়ার পেছনে অবশ্য আরো কিছু রাজনৈতিক কারণ আছে। তবে সামার বাদাউইকে কেন্দ্র করেই সেটা প্রকাশ্য হয়েছে।
কারণ যেটাই হোক না কেন, একটা সময় পরে হয়তো কূটনৈতিকভাবেই তার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু প্রকাশ্যে যাকে কেন্দ্র করে এই সংকটের শুরু, সেই সামার বাদাউইকে হয়তো তুচ্ছ কারণেই জেল খাটতে হবে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.