ফিল্ম রিভিউঃ দেবী।
রিভিউতে যাওয়ার আগে 'দেবী' সম্পর্কে এক বাক্যে একটা মন্তব্য করি। "আমার দেখা বাংলা চলচ্চিত্রে সব থেকে বাজে ফিল্ম দেবী"!
আমি চলচ্চিত্র অনুরাগী নই। এটা আমার আগ্রহের বিষয় কোন কালেই ছিলো না। কিন্তু তবুও দুই-তিন বছরান্তে কোন ভালো ফিল্মের খবর পেলে দেখি। প্রেক্ষাগৃহে আজকের আগে আমার দেখা সর্বশেষ ফিল্ম ছিলো 'আয়নাবাজী'। যাহোক, 'দেবী'র ব্যাপারে বলার আগে থ্রীলার ফিল্ম দেখার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আজ থেকে বছর দশেক আগের কথা। শীতের সময় আমার এক আত্মীয়ের পরিবার পারিবারিক কোন প্রোগ্রাম জয়ন করতে গ্রামের বাড়িতে যাবে। সে সময় হালিশহরে চোরের খুব উৎপাত ছিলো। তাই আমার উপর দায়িত্ব পড়লো এই ক'টা দিন ওই বাসায় থাকতে হবে। সামনে আমার সেমিস্টার ফাইনাল ছিলো। তাই নির্ঝঞ্চাট পড়াশুনা করার জন্য আমিও খুশি মনে রাজি হয়ে থাকা শুরু করলাম। এক রাতে পড়াশুনা শেষ করে ঘুমাতে যাবো। তার আগে কিছুক্ষণ টিভি দেখার জন্য বসলাম। টিভি চ্যানেল ঘু্রিয়ে দেখলাম একটা চ্যানেলে হলিউডের একটা হরর ফিল্ম চলছে। সুপার ন্যাচারাল, হরর, প্যারানর্মাল, সাইকো থ্রীলার জাতিয় বিষয়ে আমার আগ্রহ খুবই বেশি। তাই গোটা ঘরের লাইট জালিয়ে, কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে দেখতে শুরু করলাম। ছবি চলছে আর আমি ভয়ে শিহরিত হচ্ছি। এত ভয়ানক দৃশ্য কিভাবে বানাতে পারে সেটা ভেবেই আশ্চর্য হচ্ছি। ভৌতিক আবহ, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, একের পর এক রক্ত হিম করা দৃশ্যপট সব মিলিয়ে যেন এক অপার্থিব পরিবেশ! ছবির এক পর্যায়ে খুব ভয়ংকর একটা সিন চলছে। আর কাকতালীয় ভাবে ঠিক সে সময় ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলো। আমি সাথে সাথে আপাদমস্তক কম্বল মুড়িয়ে ফেললাম। মনে হচ্ছিলো গল্পের পিশাচটা আমার বিচানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ থেকে কম্বল সরালেই দেখতে পাবো। কতক্ষণে রাত পোহাবে চোখ বন্ধ করে সে হিসেব করছিলাম। কিন্তু আমার জীবনের সব থেকে লম্বা রাত বোধহয় সেটাই ছিলো। সে রাত তো বটেই সেদিনের পর কয়েক রাত আমি ঠিক মতো ঘুমাতে পাড়িনি। এতটা ভয়ংকর ভাবে নিমির্তি হয়েছিলো ফিল্মের প্রতিটি দৃশ্যপট!
যাহোক, এবার আজকে দেখা ঢালিউডের 'দেবী' নিয়ে বলি। প্রথমে বিস্ময় প্রকাশ করছি যে, সাইকো থ্রীলার ঘরনার ফিল্ম বানানোর দুঃসাহস দেবী'র পরিচালক অনম বিশ্বাসের হলো কি করে? এলোমেলো কাহিনী, একটা সিনের সাথে আরেকটা সিনের সমন্বয়হীনতা, অসঙ্গত ব্যাকগ্রান্ড সাউন্ড, গল্পের সাবলিলতার অভাব সর্বপোরী একটা ফিল্ম খারাপের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছাতে কলাকৌশলগত যত রকমের ত্রুটি থাকা দরকার তার সবটাই দেবীতে বিদ্যমান। ফিল্মের শুরুতে ১৭৫৭ সালের একটা নরবলির দৃশ্য দেখানো হয়েছে। ফিল্মের শেষ পর্যন্ত এই সিনের কোন সম্পৃক্ততা খুঁজে পাইনি। ছবির এক পর্যায়ে মনে হয়েছে এটা চাইল্ড সেক্সুয়াল এবিউজ জাতিয় কোন ফিল্ম, কিন্তু সেখানে ধাক্কা খেলাম। রানুর চরিত্রে অভিনয় করা জয়া আহসান দশ বছর বয়সে একটা মন্দিরের পুরহিত দ্বারা সেক্সুয়াল এবিউজের শিকার হয়, কিন্তু সে ঘটনার সাথে বলির কি সম্পৃক্ততা সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনি। ১৭৫৭ সালের ঘটনায় মন্দিরের দৃশ্যে বলি দেয়া ব্যক্তিটি আহমেদ সাবেত চরিত্রে অভিনয় করা ইরেশ জাকের। আবার রানুর দশ বছর বয়সে যে লোকটির দ্বারা সেক্সুয়াল হেরাসমেন্টের শিকার হয়েছে, সে লোকটিও ইরেশ জাকের। এরপর নীলুর চরিত্রে শবনম ফারিয়াকে পটিয়ে বলি দিতে নিয়ে যাওয়া লোকটিও ইরেশ জাকের। বলিউড বা টালিউডের কিছু ফিল্মে সনাতনী ধর্মের রীতি অনুযায়ী পুনঃজন্মের কাহিনীতে এরকম দেখা যায়। এক জন্মের অতৃপ্তি নিয়ে ভিলেন পরবর্তী জন্মে অন্যকোন রুপে এসে আবার পুরানো ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে চায়। ধরে নিতে পারতাম এখানেও পুনজন্মে বিশ্বাসের ব্যাপার আছে, কিন্তু সেটাও ধোপে টেকে না। কারণ রানুর স্বামীর নাম আনিস। সে হিসেবে এটা বলা যায়, দেবীর কাহিনীর পটভুমিতে হিন্দু ধর্ম ছিলো না। আনিস মুসলিম ধর্মাবলম্বী নাম।
রানুকে ষোল বছর আগে লালসার বস্তুতে পরিনত করা ইরেশ জাকের পরবর্তীতে নীলুকে টার্গেট করে। সেখানে ষোল বছর আগের ইরেশ জাকের আর ষোল বছর পরের ইরেশ জাকেরের বয়সের কোন পার্থক্য তো নেইই, উল্টো নীলুর বিপরীতে অভিনয় করা ইরেশ জাকের যেন আরো তরুণ! ছবিতে আত্মার রুপে বলির শিকার হওয়া দুটি মেয়েকে প্রায় দেখা গেছে, কিন্তু মেয়ে দুটিকে ঠিক কি কারণে এখানে এনেছে সেটা পরিস্কার নয়। ছবির প্রথম দিকের দৃশ্যে নীলু যে গাড়িতে বসে থাকে সেটা পঞ্চাশের দশকের মডেল। মনে করলাম ছবিটি বিগত শতাব্দীর পটভুমিতে তৈরী। সেখানে খেলাম আরেক বড় ধাক্কা। একদিকে মিসির আলীর চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীর গলায় নোকিয়া এগারশো মডেলের মোবাইল, অন্যদিকে ইরেশ জাকেরের ড্রাইভ করা গাড়ি, নীলুর চ্যাট করা মেসেঞ্জার একেবারে চলতি দশকের।
ইরেশ জাকের ঠিক কোন প্রথার জন্য বা কি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে নরবলি দেয় সেটাও খোলশা করা হয়নি। ছবিতে ইরেশ জাকের আপাদমস্তক একজন মানুষ। কোন আত্মা বা ভুত-প্রেত নয়। সেটা আরো পরিস্কার হয় তার মৃত্যুর দৃশ্যে। সেখানে উড়ে এসে তার শরীরে লোহার পেরেক বিদ্ধ হলে সে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে। আত্মার শরীর থেকে রক্ত বের হয় না। এদিকে আবার ইরেশ জাকেরকে কয়েকবার তার হাত কেটে রক্ত খেতে দেখা যায়। রানুর কল্পনায় একবার তাকে পা টেনে পানিতে ডুবিয়ে ফেলে কেউ একজন। সেখানে কিছুক্ষণ পর রানুর পায়জামা ভেসে উঠে। আরেকবারের কল্পনায় রানুর শ্লিলতাহানী করতে পায়জামা খুলে ফেলার দৃশ্যটি মন্দিরের অভ্যান্তরে। হায় সেলুকাস! গল্প বর্ননায় রানুর দশ বছর বয়সে গ্রামে একটা লাশ পাওয়া যায়। রানুর ভাষ্যমতে লাশের ব্যক্তিটির নাম জালাল উদ্দিন। সুরতহালের বিবরন অনুযায়ী আস্ত একটা লাশ পাওয়া গেছে। মুন্ডু কাটা লাশ নয়। শিশু রানুর মুন্ডচ্ছেদ করতে গিয়ে দৈব প্রক্রিয়ায় নিজের মুন্ডচ্ছেদ হয়ে যাওয়া লোকটি তাহলে জালাল উদ্দিন নয়। তাহলে বলি দিতে গিয়ে নিজের মুন্ডচ্ছেদ হয়ে যাওয়া লোকটি কে? জালাল উদ্দিনের সাথে তার সম্পৃক্ততা কোথায়? যদি কিছুক্ষণের জন্য ধরেও নিই সেই লোকটিই জালাল উদ্দিন, তাহলে প্রশ্ন আসে জালাল উদ্দিন তো মুসলমানের নাম। মুসলমান ব্যক্তি মন্দিরের পুরহিত হয় কি করে? নরবলিই বা কেন দিতে যাবে? আহমেদ সাবেত নামি ইরেশ জাকেরই বা কে? মন্দিরে নরবলি দিতে যাওয়া ব্যক্তি, জালাল উদ্দিন এবং নরবলির সাথে তার সম্পর্কই বা কি?? সর্বশেষ বলির হাত থেকে নীলুর মুক্তি পাওয়ার সাথে রানুর মৃত্যুর বিষয়টি একেবারে হাস্যকর ঠেকেছে।
এরকম হাজারো প্রশ্ন আছে দেবী'র প্রতিটি দৃশ্যে! দেবী'র প্রতিটি দৃশ্যে ফুটে উঠোছে পরিচালকের অপারদর্শীতার চিত্র। সাইকো থ্রীলারের নাম করে দর্শককে গেলানোর চেষ্টা হয়েছে একেবারেই যাচ্ছেতাই। সেটা নিয়ে না হয় নাই বললাম। কিন্তু এটা না বলে পারছি না, অভিজ্ঞতার এত ঘাটতি নিয়ে সাইকো থ্রীলার ঘরনার ফিল্ম বানানোর দূর্মতি হলো কি করে এই পরিচালকের? সাইকো থ্রীলার ঘরানার ফিল্ম দেখে মানুষের মনে ভয়ের উদ্রেক হয়, কিন্তু দেবীতে দর্শকদের ভয় পাওয়ানোর বাচ্চাসুলভ চেষ্টা দেখে আমার ভয়ের বদলে চরম হাসির উদ্রেক হয়েছে। এত পাগলামোও মানুষ করতে পারে!!
জয়াকে যতটুকু রোল দিয়েছে সেটাতে জয়া একশোতে একশো! বেচারি প্রাণপণে চেষ্টা করেছে নিজের রোলটা সুচারুরুপে প্লে করতে। এবং সেটা পেরেছেও। কিন্তু চিত্রনাট্য রচয়িতা জয়াকে ঠিক কি করতে দিয়েছে, সেটা সে নিজেও পরিস্কার নয়। জয়ার অভিনয় সন্দেহাতীতভাবে ভালো হয়েছে, কিন্তু নাম ভুমিকায় অভিনয় করা সেন্ট্রাল কারেক্টারে মুল কাজটা কি ছিলো, সেটা ছবি দেখে কিছুই আন্দাজ করা যায়নি। অন্যদিকে চঞ্চল চৌধুরীও দূর্দান্ত অভিনয় করেছে, কিন্তু সেখানেও একই ব্যাপার! হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসে মিসির আলী চরিত্র জোরালো ভুমিকা থাকে, কিন্তু দেবীতে মিসির আলীও চোখে পড়ার মতো রোল প্লে করতে পারেনি। অর্থাৎ মিসির আলী চরিত্রটিকে স্ট্রং কোন পার্ট দিতে দারুনভাবে ব্যার্থ হয়েছে পরিচালক। সব মিলিয়ে শ্রেফ একটা জগাখিঁচুড়ি হয়েছে!! সত্যি কথা বলতে দেবী ছবিটিতে পরিচালক ঠিক কি করতে চেয়েছে সেটা সে নিজেও বলতে পারবে না।
রিভিউর সমালোচনা হিসেবে কেউ হয়তো এই প্রশ্ন তুলতে পারেন, এত অসংলগ্নতার থাকলে দেবী'র এত দর্শক কেন? মানুষ কেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দেবী দেখার জন্য? তাই লেখার সর্বশেষ এই প্যারাটি তাদের জন্য। বলা হয়েছে দেবী প্রয়াত বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত। দেবী'র এই ব্যাপক দর্শক কাটতির মুল কারণও সেটা। হুমায়ুন আহমেদের কাহিনী অবলম্বে ছবি নির্মিত হবে আর দর্শক ভেঙে পড়বে না এরকম কখনো হয়নি। আর এখানেই অনম বিশ্বাস সফল। শুধু একারণেই দেবীও ব্যবসা সফল। কিন্তু দেবী দেখে প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে বের হয়ে আসা দর্শকদের চেহারায় সীমাহীণ বিরক্তির চাপ আর মনের অবস্থা যদি বুঝতে পারতো, তবে দেবীর কলাকুশলীরা এরকম ফিল্ম নির্মাণের আগে কয়েকশো বার ভাবতো!
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
আমি চলচ্চিত্র অনুরাগী নই। এটা আমার আগ্রহের বিষয় কোন কালেই ছিলো না। কিন্তু তবুও দুই-তিন বছরান্তে কোন ভালো ফিল্মের খবর পেলে দেখি। প্রেক্ষাগৃহে আজকের আগে আমার দেখা সর্বশেষ ফিল্ম ছিলো 'আয়নাবাজী'। যাহোক, 'দেবী'র ব্যাপারে বলার আগে থ্রীলার ফিল্ম দেখার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আজ থেকে বছর দশেক আগের কথা। শীতের সময় আমার এক আত্মীয়ের পরিবার পারিবারিক কোন প্রোগ্রাম জয়ন করতে গ্রামের বাড়িতে যাবে। সে সময় হালিশহরে চোরের খুব উৎপাত ছিলো। তাই আমার উপর দায়িত্ব পড়লো এই ক'টা দিন ওই বাসায় থাকতে হবে। সামনে আমার সেমিস্টার ফাইনাল ছিলো। তাই নির্ঝঞ্চাট পড়াশুনা করার জন্য আমিও খুশি মনে রাজি হয়ে থাকা শুরু করলাম। এক রাতে পড়াশুনা শেষ করে ঘুমাতে যাবো। তার আগে কিছুক্ষণ টিভি দেখার জন্য বসলাম। টিভি চ্যানেল ঘু্রিয়ে দেখলাম একটা চ্যানেলে হলিউডের একটা হরর ফিল্ম চলছে। সুপার ন্যাচারাল, হরর, প্যারানর্মাল, সাইকো থ্রীলার জাতিয় বিষয়ে আমার আগ্রহ খুবই বেশি। তাই গোটা ঘরের লাইট জালিয়ে, কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে দেখতে শুরু করলাম। ছবি চলছে আর আমি ভয়ে শিহরিত হচ্ছি। এত ভয়ানক দৃশ্য কিভাবে বানাতে পারে সেটা ভেবেই আশ্চর্য হচ্ছি। ভৌতিক আবহ, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, একের পর এক রক্ত হিম করা দৃশ্যপট সব মিলিয়ে যেন এক অপার্থিব পরিবেশ! ছবির এক পর্যায়ে খুব ভয়ংকর একটা সিন চলছে। আর কাকতালীয় ভাবে ঠিক সে সময় ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলো। আমি সাথে সাথে আপাদমস্তক কম্বল মুড়িয়ে ফেললাম। মনে হচ্ছিলো গল্পের পিশাচটা আমার বিচানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ থেকে কম্বল সরালেই দেখতে পাবো। কতক্ষণে রাত পোহাবে চোখ বন্ধ করে সে হিসেব করছিলাম। কিন্তু আমার জীবনের সব থেকে লম্বা রাত বোধহয় সেটাই ছিলো। সে রাত তো বটেই সেদিনের পর কয়েক রাত আমি ঠিক মতো ঘুমাতে পাড়িনি। এতটা ভয়ংকর ভাবে নিমির্তি হয়েছিলো ফিল্মের প্রতিটি দৃশ্যপট!
যাহোক, এবার আজকে দেখা ঢালিউডের 'দেবী' নিয়ে বলি। প্রথমে বিস্ময় প্রকাশ করছি যে, সাইকো থ্রীলার ঘরনার ফিল্ম বানানোর দুঃসাহস দেবী'র পরিচালক অনম বিশ্বাসের হলো কি করে? এলোমেলো কাহিনী, একটা সিনের সাথে আরেকটা সিনের সমন্বয়হীনতা, অসঙ্গত ব্যাকগ্রান্ড সাউন্ড, গল্পের সাবলিলতার অভাব সর্বপোরী একটা ফিল্ম খারাপের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছাতে কলাকৌশলগত যত রকমের ত্রুটি থাকা দরকার তার সবটাই দেবীতে বিদ্যমান। ফিল্মের শুরুতে ১৭৫৭ সালের একটা নরবলির দৃশ্য দেখানো হয়েছে। ফিল্মের শেষ পর্যন্ত এই সিনের কোন সম্পৃক্ততা খুঁজে পাইনি। ছবির এক পর্যায়ে মনে হয়েছে এটা চাইল্ড সেক্সুয়াল এবিউজ জাতিয় কোন ফিল্ম, কিন্তু সেখানে ধাক্কা খেলাম। রানুর চরিত্রে অভিনয় করা জয়া আহসান দশ বছর বয়সে একটা মন্দিরের পুরহিত দ্বারা সেক্সুয়াল এবিউজের শিকার হয়, কিন্তু সে ঘটনার সাথে বলির কি সম্পৃক্ততা সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনি। ১৭৫৭ সালের ঘটনায় মন্দিরের দৃশ্যে বলি দেয়া ব্যক্তিটি আহমেদ সাবেত চরিত্রে অভিনয় করা ইরেশ জাকের। আবার রানুর দশ বছর বয়সে যে লোকটির দ্বারা সেক্সুয়াল হেরাসমেন্টের শিকার হয়েছে, সে লোকটিও ইরেশ জাকের। এরপর নীলুর চরিত্রে শবনম ফারিয়াকে পটিয়ে বলি দিতে নিয়ে যাওয়া লোকটিও ইরেশ জাকের। বলিউড বা টালিউডের কিছু ফিল্মে সনাতনী ধর্মের রীতি অনুযায়ী পুনঃজন্মের কাহিনীতে এরকম দেখা যায়। এক জন্মের অতৃপ্তি নিয়ে ভিলেন পরবর্তী জন্মে অন্যকোন রুপে এসে আবার পুরানো ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে চায়। ধরে নিতে পারতাম এখানেও পুনজন্মে বিশ্বাসের ব্যাপার আছে, কিন্তু সেটাও ধোপে টেকে না। কারণ রানুর স্বামীর নাম আনিস। সে হিসেবে এটা বলা যায়, দেবীর কাহিনীর পটভুমিতে হিন্দু ধর্ম ছিলো না। আনিস মুসলিম ধর্মাবলম্বী নাম।
রানুকে ষোল বছর আগে লালসার বস্তুতে পরিনত করা ইরেশ জাকের পরবর্তীতে নীলুকে টার্গেট করে। সেখানে ষোল বছর আগের ইরেশ জাকের আর ষোল বছর পরের ইরেশ জাকেরের বয়সের কোন পার্থক্য তো নেইই, উল্টো নীলুর বিপরীতে অভিনয় করা ইরেশ জাকের যেন আরো তরুণ! ছবিতে আত্মার রুপে বলির শিকার হওয়া দুটি মেয়েকে প্রায় দেখা গেছে, কিন্তু মেয়ে দুটিকে ঠিক কি কারণে এখানে এনেছে সেটা পরিস্কার নয়। ছবির প্রথম দিকের দৃশ্যে নীলু যে গাড়িতে বসে থাকে সেটা পঞ্চাশের দশকের মডেল। মনে করলাম ছবিটি বিগত শতাব্দীর পটভুমিতে তৈরী। সেখানে খেলাম আরেক বড় ধাক্কা। একদিকে মিসির আলীর চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীর গলায় নোকিয়া এগারশো মডেলের মোবাইল, অন্যদিকে ইরেশ জাকেরের ড্রাইভ করা গাড়ি, নীলুর চ্যাট করা মেসেঞ্জার একেবারে চলতি দশকের।
ইরেশ জাকের ঠিক কোন প্রথার জন্য বা কি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে নরবলি দেয় সেটাও খোলশা করা হয়নি। ছবিতে ইরেশ জাকের আপাদমস্তক একজন মানুষ। কোন আত্মা বা ভুত-প্রেত নয়। সেটা আরো পরিস্কার হয় তার মৃত্যুর দৃশ্যে। সেখানে উড়ে এসে তার শরীরে লোহার পেরেক বিদ্ধ হলে সে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে। আত্মার শরীর থেকে রক্ত বের হয় না। এদিকে আবার ইরেশ জাকেরকে কয়েকবার তার হাত কেটে রক্ত খেতে দেখা যায়। রানুর কল্পনায় একবার তাকে পা টেনে পানিতে ডুবিয়ে ফেলে কেউ একজন। সেখানে কিছুক্ষণ পর রানুর পায়জামা ভেসে উঠে। আরেকবারের কল্পনায় রানুর শ্লিলতাহানী করতে পায়জামা খুলে ফেলার দৃশ্যটি মন্দিরের অভ্যান্তরে। হায় সেলুকাস! গল্প বর্ননায় রানুর দশ বছর বয়সে গ্রামে একটা লাশ পাওয়া যায়। রানুর ভাষ্যমতে লাশের ব্যক্তিটির নাম জালাল উদ্দিন। সুরতহালের বিবরন অনুযায়ী আস্ত একটা লাশ পাওয়া গেছে। মুন্ডু কাটা লাশ নয়। শিশু রানুর মুন্ডচ্ছেদ করতে গিয়ে দৈব প্রক্রিয়ায় নিজের মুন্ডচ্ছেদ হয়ে যাওয়া লোকটি তাহলে জালাল উদ্দিন নয়। তাহলে বলি দিতে গিয়ে নিজের মুন্ডচ্ছেদ হয়ে যাওয়া লোকটি কে? জালাল উদ্দিনের সাথে তার সম্পৃক্ততা কোথায়? যদি কিছুক্ষণের জন্য ধরেও নিই সেই লোকটিই জালাল উদ্দিন, তাহলে প্রশ্ন আসে জালাল উদ্দিন তো মুসলমানের নাম। মুসলমান ব্যক্তি মন্দিরের পুরহিত হয় কি করে? নরবলিই বা কেন দিতে যাবে? আহমেদ সাবেত নামি ইরেশ জাকেরই বা কে? মন্দিরে নরবলি দিতে যাওয়া ব্যক্তি, জালাল উদ্দিন এবং নরবলির সাথে তার সম্পর্কই বা কি?? সর্বশেষ বলির হাত থেকে নীলুর মুক্তি পাওয়ার সাথে রানুর মৃত্যুর বিষয়টি একেবারে হাস্যকর ঠেকেছে।
এরকম হাজারো প্রশ্ন আছে দেবী'র প্রতিটি দৃশ্যে! দেবী'র প্রতিটি দৃশ্যে ফুটে উঠোছে পরিচালকের অপারদর্শীতার চিত্র। সাইকো থ্রীলারের নাম করে দর্শককে গেলানোর চেষ্টা হয়েছে একেবারেই যাচ্ছেতাই। সেটা নিয়ে না হয় নাই বললাম। কিন্তু এটা না বলে পারছি না, অভিজ্ঞতার এত ঘাটতি নিয়ে সাইকো থ্রীলার ঘরনার ফিল্ম বানানোর দূর্মতি হলো কি করে এই পরিচালকের? সাইকো থ্রীলার ঘরানার ফিল্ম দেখে মানুষের মনে ভয়ের উদ্রেক হয়, কিন্তু দেবীতে দর্শকদের ভয় পাওয়ানোর বাচ্চাসুলভ চেষ্টা দেখে আমার ভয়ের বদলে চরম হাসির উদ্রেক হয়েছে। এত পাগলামোও মানুষ করতে পারে!!
জয়াকে যতটুকু রোল দিয়েছে সেটাতে জয়া একশোতে একশো! বেচারি প্রাণপণে চেষ্টা করেছে নিজের রোলটা সুচারুরুপে প্লে করতে। এবং সেটা পেরেছেও। কিন্তু চিত্রনাট্য রচয়িতা জয়াকে ঠিক কি করতে দিয়েছে, সেটা সে নিজেও পরিস্কার নয়। জয়ার অভিনয় সন্দেহাতীতভাবে ভালো হয়েছে, কিন্তু নাম ভুমিকায় অভিনয় করা সেন্ট্রাল কারেক্টারে মুল কাজটা কি ছিলো, সেটা ছবি দেখে কিছুই আন্দাজ করা যায়নি। অন্যদিকে চঞ্চল চৌধুরীও দূর্দান্ত অভিনয় করেছে, কিন্তু সেখানেও একই ব্যাপার! হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসে মিসির আলী চরিত্র জোরালো ভুমিকা থাকে, কিন্তু দেবীতে মিসির আলীও চোখে পড়ার মতো রোল প্লে করতে পারেনি। অর্থাৎ মিসির আলী চরিত্রটিকে স্ট্রং কোন পার্ট দিতে দারুনভাবে ব্যার্থ হয়েছে পরিচালক। সব মিলিয়ে শ্রেফ একটা জগাখিঁচুড়ি হয়েছে!! সত্যি কথা বলতে দেবী ছবিটিতে পরিচালক ঠিক কি করতে চেয়েছে সেটা সে নিজেও বলতে পারবে না।
রিভিউর সমালোচনা হিসেবে কেউ হয়তো এই প্রশ্ন তুলতে পারেন, এত অসংলগ্নতার থাকলে দেবী'র এত দর্শক কেন? মানুষ কেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দেবী দেখার জন্য? তাই লেখার সর্বশেষ এই প্যারাটি তাদের জন্য। বলা হয়েছে দেবী প্রয়াত বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত। দেবী'র এই ব্যাপক দর্শক কাটতির মুল কারণও সেটা। হুমায়ুন আহমেদের কাহিনী অবলম্বে ছবি নির্মিত হবে আর দর্শক ভেঙে পড়বে না এরকম কখনো হয়নি। আর এখানেই অনম বিশ্বাস সফল। শুধু একারণেই দেবীও ব্যবসা সফল। কিন্তু দেবী দেখে প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে বের হয়ে আসা দর্শকদের চেহারায় সীমাহীণ বিরক্তির চাপ আর মনের অবস্থা যদি বুঝতে পারতো, তবে দেবীর কলাকুশলীরা এরকম ফিল্ম নির্মাণের আগে কয়েকশো বার ভাবতো!
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.