পরিবহন সেক্টরের ঈশ্বরের কথা

বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত এবং সমালোচিত ব্যক্তিটির নাম নিঃসন্দেহে শাজাহান খান। তিনি নির্বাচিত সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ সরকারের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। তবে এসব ছাপিয়ে যে পরিচয়ে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত সেটা হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক সমিতির নির্বাহী সভাপতি। তাকে পরিবহন সেক্টরের অঘোষিত ঈশ্বর বললেও ভুল হবে না। এই ভদ্রলোক মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর আমলে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন, তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার যথেষ্ট পুরনো।
তবে সেসব এখন বিস্মৃত অতীত, বরং গত কয়েক বছরে তার প্রচ্ছন্ন ছায়ায় থেকে শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এমন সব কর্মকাণ্ড এমন সব কর্মকাণ্ড করেছেন, হুটহাট ধর্মঘট ডেকে জনজীবনে এত বেশি ভোগান্তির সৃষ্টি করেছেন যে, তার নাম শুনলেও এখন সাধারণ মানুষ ক্ষেপে ওঠে। তিনি নিজেই এজন্যে কম দায়ী নন, কখনও ছাত্র-ছাত্রীর মৃত্যুর খবর পেয়ে হেসে ফেলছেন, কখনও ড্রাইভার-হেল্পারদের দোষ লঘু করার জন্যে এমন সব বেফাঁস কথাবার্তা বলেছেন যে, অনেকের কাছে শাজাহান খান নামটাই এখন একটা চলন্ত কৌতুক!

১৯৮৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েক যাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় এক বাসচালককে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তখন সেই রায়ের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করে রায় বাতিল করতে বাধ্য করেছিলেন শাজাহান খান এবং তার সংগঠন, টানা ধর্মঘটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল দেশ। মোটামুটি সেই সময় থেকেই যাত্রীদের জিম্মি করে পরিবহন শ্রমিকদের দৌরাত্ন্যের শুরু হয়েছিল। গত কয়েক বছরে যেটা বেড়েছে কয়েকশো গুণে। তারা কারো তোয়াক্কা করে না, কোনকিছুর ধার ধারে না, তারা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, আবার শাস্তির মুখোমুখী না হবার জন্যে আইন সংশোধনের অন্যায় দাবী তুলে দেশ অচল করে দেয়ার ক্ষমতাও তারা রাখে!

নিহত তারেক মাসুদ ও মিশুক মনির
২০১১ সালে তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীর যখন মানিকগঞ্জের ঘিওরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলেন, তখন ড্রাইভারদের শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রশ্নটা উঠেছিল। কপমপক্ষে অষ্টম শ্রেণী পাশ না হলে ড্রাইভিং লাইসেন্স যাতে দেয়া না হয়, সেই দাবীও তুলেছিলেন অনেকে। সংসদে দাঁড়িয়ে শাজাহান খান তখন তার সংগঠনের কর্মীদের পক্ষ নিয়ে বলেছিলেন- ‘অশিক্ষিত চালকদেরও লাইসেন্স দেওয়া দরকার। কারণ, তারা সিগনাল চেনে, গরু-ছাগল চেনে, মানুষ চিনে। সুতরাং তাদের লাইসেন্স দেওয়া যায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর যে ড্রাইভার, সে ক্লাস ফাইভ পাশ, সে তো গাড়ি ভালোই চালায়…’
বেসরকারী টেলিভিশন Rtv তে এক টক শো-তে তিনি গিয়েছিলেন আলোচনা করতে, সেখানে বিএনপির ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলামও ছিলেন। অন এয়ার প্রোগ্রামেই দুজনে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। তখন রফিকুল ইসলামকে ‘বেয়াদব’ বলে সম্বোধন করেছিলেন শাজাহান খান। ব্যারিস্টার রফিকুলের চোখ তুলে নেয়ারও হুমকি দিয়েছিলেন তিনি!

ব্যারিস্টার রফিকুলের চোখ তুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন টকশোতে
পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে নারী নিপীড়নের ঘটনার এক অদ্ভুত সাফাই গেয়ে তিনি বলেন, ‘এই দেশে কোটি কোটি মানুষের বসবাস। এরমধ্যে ঢাকা শহরেই থাকে দুই কোটি মানুষ। এরকম একটা-দুইটা টুকিটাকি ঘটনা হতেই পারে। এতগুলো মানুষের মধ্যে এটা তেমন কোনো বিষয়ই না!’ তবে সমালোচনার মুখে পরদিন তিনি তার এই বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। শাজাহান খানের দাবী, তার বক্তব্যকে নাকি ভুলভাবে ব্যখ্যা করা হয়েছিল!
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবে যায়। পরিবেশ দূষণ নিয়ে সাংবাদিকেরা তার কাছে প্রশ্ন করলে শাজাহান খান জবাব দেন, ‘সুন্দরবনে তেল ছড়িয়ে পড়ায় তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।’
তার চালক ভাইদের অধিকার রক্ষায় তিনি বরাবরই সোচ্চার। তাদের কারো জেল-জরিমানা হবে, কেউ মামলা খাবে, এটা তিনি কোনভাবেই মেনে নিতে পারেন না। সেজন্যেই তো এতসব পরিবহন ধর্মঘট! এবছরের কথা, বাস চালকদের এক সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে তিনি। বলেছিলেন- ‘চালকদের পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদেরও বিচার হওয়া উচিৎ।’
চালকদের ধর্মঘটের ব্যাপারে ২০১৭ সালে তার মন্তব্য ছিল- ‘বাসচালকরা ধর্মঘট করছেন না, তারা স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন।’ সাভারে ট্রাকচাপা দিয়ে এক নারীকে হত্যার দায়ে ঢাকার আদালত ট্রাক চালকের ফাঁসির রায় দেয়ায় শাজাহান খানের প্রতিক্রিয়া ছিল এমন- ‘ফাঁসি দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে, এটা ভুল ধারণা। তাহলে বাংলাদেশে কোন খুন হতো না। এদেশে খুনের সাজা ফাঁসি, তারপরেও খুন কি বন্ধ আছে?’
জাবালে নূরের বেপরোয়া চালকের বাসচাপায় যখন শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়েছিলেন, তখন তিনি একগাল হেসে বলেছিলেন- ‘ভারতের মহারাষ্ট্রে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩ জন মারা গেছে। এগুলো নিয়ে আমরা যেভাবে কথা বলি, ওখানে কি এগুলো নিয়ে কেউ এভাবে কথা বলে?’ তার এই মন্তব্য এবং হাসি নিয়ে প্রচণ্ড সমালোচনা হলে তিনি পরে ক্ষমা চেয়েছিলেন, বলেছিলেন- ‘আমার হাসিটাই আমার দোষ। মুচকি হাসি আল্লাহ এবং মানুষ সবাই পছন্দ করেন। যদি আমার মুচকি হাসি দোষের হয় তাহলে আমি আর হাসবো না।’
এরপর থেকে তিনি কম কম হাসেন, কম কম কথা বলেন। শাজাহান খান বুঝে গেছেন, মুচকি আল্লাহ পছন্দ করলেও, মানুষ করে না। আর ‘বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা তো আছেই! তিনি কি বলতে চান, কি বোঝাতে চান সেটা বোকা জনগণ বোঝে না, বোঝে কেবল তার শ্রমিক ভাইয়েরা। তাইতো তারা ধর্মঘটের সময় পোড়া মবিলের কালি লেপন করেছে এদেশের মুখে।
শাজাহান এখন মিডিয়ায় কথা বলেন না, বলতে চান না। তিনি যে সংগঠনের সভাপতি সেই সংগঠনের ডাকে দেশ অবরুদ্ধ হলেও তিনি এই ব্যাপারে কিছুই নাকি জানেন না।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.