যেভাবে কাজ করে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই
এফবিআই এর পূর্নরূপ ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। এখন থেকে প্রায় ১১০ বছর আগে ১৯০৮ সালের ২৬ জুলাই গঠন করা হয় এফবিআই। শুরুতে কোনো নাম দেয়া হয়নি। ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের অধীন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য ফোর্স নিয়োগ দেয়া হয়। দায়িত্ব দেয়া হয় অ্যাটর্নি জেনারেল চার্লস জে. বোনাপার্টকে। এভাবেই ছোট একটি গ্রুপ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এফবিআই। আর বর্তমানে এর কর্মী সংখ্যা ৩৫ হাজার ১০৪ জন। ফিল্ড অফিস রয়েছে ৫৬টি। স্যাটেলাইট অফিস চার শতাধিক। রয়েছে ৬০টি আন্তর্জাতিক লিয়াজোঁ অফিস। এর ডিরেক্টর নিয়োগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। এ জন্য অনুমতি নিতে হয় সিনেটের। প্রতি বছর সংস্থাটি খরচ করে প্রায় ৮.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সংস্থাটির নীতিবাক্য হচ্ছে ‘Fidelity, Bravery and Integrity’।
এফবিআই প্রতিষ্ঠাকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন থিওডর রুজভেল্ট। একটু পেছনের অর্থাৎ ১৮৯২ সালের কথা। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তখন ছিলেন সিভিল সার্ভিস কমিশনার। সিভিল সার্ভিসকে পুনর্গঠনের জন্য ওই বছর তিনি বোনাপার্ট নামের এক ঊর্ধ্বতন আইন কর্মকর্তার সাথে দীর্ঘ আলাপ করেন। তখন ফেডারেল আইনের সংশোধনের বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রস্তাব করা হয় রাজনৈতিক নেতা ও সিভিল প্রশাসনের জন্য আলাদা আইন করার। ১৯০১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার চার বছর পর বোনাপার্টকে অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ দেন রুজভেল্ট। ১৯০৮ সালে বোনাপোর্ট প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে একটি বিশেষ বাহিনী তৈরির প্রস্তাব দেন। তারই পরামর্শ অনুযায়ী কোনো প্রকার অফিসিয়াল পদবী ছাড়াই একটি বাহিনী তৈরি করা হয়। পরে এই বাহিনীর নাম দেয়া হয় ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট
মার্কিন নিরাপত্তাকে আরো সুসংহত করার জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয় ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)। সন্ত্রাস দমন, দেশের অভ্যন্তরে অন্য দেশের গোয়েন্দা তৎপরতা, ক্রিমিনাল আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং এ সংক্রান্ত তথ্য রাষ্ট্র, বিচারবিভাগ, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরবরাহ করে সংস্থাটি। ১০টি ক্ষেত্রে সংস্থাটি বেশি গুরুত্ব দেয়। এগুলো হচ্ছে সন্ত্রাসী হামলা থেকে দেশকে মুক্ত রাখা।
দেশের অভ্যন্তরে অন্য দেশের কূটনীতিকদের তৎপরতা ও গোয়েন্দাগিরি নিয়ন্ত্রণ। দেশের বিরুদ্ধে সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণ। দেশের সব পর্যায়ের অপরাধ প্রতিরোধ। বেসামরিক আইন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠন ও তাদের মদদদাতাদের থেকে দেশকে রক্ষা করা। অদৃশ্যমান অপরাধ দমন। সংগঠিত উগ্র সন্ত্রাস দমন। ফেডারেল, রাজ্য, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সহায়তা দেয়া। এফবিআই’র মিশনে সফলতার জন্য নিয়মিত প্রযুক্তি উন্নয়ন। এফবিআই আইন প্রয়োগে কাউকে বাধ্য করতে পারে না। পলিসির আলোকে সংস্থাটিকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও এর গবেষণা কাজ করতে হয়।
এফবিআই এর ফ্লাগ
একনজরে এফবিআই
প্রতিষ্ঠা: ১৯০৮
এফবিআই নামকরণ: ১৯৩৫
প্রথম ডিরেক্টর: স্ট্যানলি ফিনস
জনবল: ৩১,১০৪
ফিল্ড অফিস: ৫৬টি
বার্ষিক বাজেট: ৮.৭ বিলিয়ন
লোকাল অফিস: ৫ শতাধিক (রেসিডেন্ট এজেন্সিজ)
আন্তর্জাতিক অফিস: ৬০ (লিগ্যাল এটাসেস)
নীতিবাক্য: Fidelity, Bravery and Integrity
ওয়েব সাইট: www.fbi.gov
হেডকোয়ার্টার ওয়াশিংটন ডিসিতে
এফবিআই’র হেড কোয়ার্টার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির পেনসিলভেনিয়া এভিনিউতে। সংস্থাটির স্পেশাল এজেন্ট ও সাপোর্ট পার্সোনালরা হেডকোয়ার্টারে অফিস করেন। তারাই দেশ ও দেশের বাইরে এফবিআই’র কাজের সমন্বয় ও সংগঠিত করেন। হেডকোয়ার্টারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বণ্টন। সংগৃহীত তথ্য সঠিক কি না তা যাচাই বাছাই করা। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ হওয়া উচিত তা এখান থেকেই বলা হয়।
এফবিআই হেডকোয়ার্টার
সারা বিশ্বেই এরা বিরাজমান
এফবিআই যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা হলেও বিশ্বেই এর কাজ ও শাখা বিস্তৃত। দেশের অভ্যন্তরে প্রধান প্রধান শহরে সংস্থাটির রয়েছে ৫৬টি ফিল্ড অফিস। এ ছাড়া দেশের ছোট শহরে রয়েছে চার শতাধিক রেসিডেন্ট এজেন্সিস। দেশের বাইরে রয়েছে ৬০টি আন্তর্জাতিক অফিস। এ অফিসের নাম দেয়া হয়েছে ‘লিগ্যাল এটাচেস’। এসব অফিস সংশ্লিষ্ট দেশের যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস পরিচালনা করছে।
তথ্য সংগ্রহের বড় মাধ্যম মিডিয়া
এফবিআই’র কর্মকৌশল বিশ্বের আর দশটা গোয়েন্দা সংস্থার মতোই। তবে কাজ করতে গিয়ে সিআইএ যে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে ও যে পরিমাণ অর্থ খরচ করে সেটা বিশ্বের কোনো গেয়েন্দা সংস্থাই করতে পারে না। বিশ্বের সব দেশেই রয়েছে এর শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। সিআইএ’র তথ্য সংগ্রহের বড় মাধ্যম হচ্ছে মিডিয়া বা সংবাদমাধ্যম। যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল, সরকারি প্রকাশনা, পরিসংখ্যান, সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে সংস্থাটি তথ্য সংগ্রহ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, মিডিয়াকর্মী ও বিভিন্ন পেশার পদস্থ কর্মকর্তাদের কিনে নেয় সংস্থাটি। দেশ ও দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কর্মকাণ্ডে সংস্থাটিকে তীক্ষ নজর রাখতে হয়। এ ছাড়া ভূ-উপগ্রহ, ইন্টারনেট, গোয়েন্দা বিমান ও ফোনে আড়ি পেতেও সংস্থাটি তথ্য সংগ্রহ করে। সবচেয়ে বড় কথা হলো বিশ্বের সব দেশে ছড়িয়ে আছে এফবিআই’র নিজস্ব এজেন্ট। এরা অত্যন্ত দক্ষ ও চতুর। এরা সব পরিস্থিতির সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে। এরা ছদ্মবেশেও থাকে আবার মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা হিসেবেও থাকে।
অন্য দেশগুলোও এদের হায়ার করতে পারে
সংস্থাটি গোয়েন্দাবৃত্তিতে সহযোগী দেশকে সহযোগিতা করে। কোনো দেশ সংস্থাটির সহযোগিতা চাইলে জনবল ও প্রযুক্তি দিয়ে তাকে সহযোগিতা করে। এ জন্য গঠন করে টাস্ক ফোর্স। বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে এ সংস্থা। এ জন্য সংস্থাটি ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠা করে এফবিআই ন্যাশনাল একাডেমি। এখানে নিজ দেশের গোয়েন্দাদের ছাড়াও বাইরের দেশের পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
সমালোচনা
এফবিআই’র বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক চোরাচালান, নারী পাচারসহ নানা অপকর্মে সহায়তার অভিযোগ। এসব করতে গিয়ে অনেক সময় মূল কাজ থেকে বিচ্যুতও হয়েছে কখনো। অসতর্কতার কারণে পারমাণবিক অস্ত্রের অনেক গোপন বিষয় পাচার হয়েছিল জার্মান, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অনেক দেশে। মোসাদের খবরদারি থেকে সংস্থাটি মুক্ত হতে পারেনি। নাইন-ইলেভেনের কোনো আগাম তথ্যও সরকারকে দিতে পারেনি এফবিআই।
যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে অনেক গোয়েন্দা উপগ্রহ। বিশ্বের ইন্টারনেট প্রযুক্তির বেশির ভাগই দেশটির নিয়ন্ত্রণে। সাইবার ক্রাইম রোধে রয়েছে বিশাল বাজেট। এরপরও এসব বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রেই সংস্থাটি সফল হয়নি। দেশটিতে অপরাধ ও অপরাধীর মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সাম্রাজ্যের জাল বিস্তার করছে তা রক্ষার জন্য যে প্রযুক্তি, জনবল ও কৌশল দরকার তার অনেক কিছুই সংস্থাটি দিতে পারছে না। হয়তো সামনে অনেক ব্যর্থতাই সংস্থাটিকে ঘিরে ফেলবে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.