২-৩ অক্টোবর, ১৯৭৭ || জিয়াউর রহমানের আরেকটি নগ্ন পদক্ষেপ || ইতিহাসের অন্যতম আরও একটি কলঙ্ককিত অধ্যায় ||
২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭। জাপান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ৪৯২। প্যারিস থেকে মুম্বাই হয়ে টোকিও হানেদা বিমান বন্দর। যথারীতি মুম্বাই থেকে আকাশে উড়ল বিমান। জাপানীর কুখ্যাত রেড আর্মি ভারতের আকাশেই ছিনতাই করে বিমান। রেড আর্মির ছিনতাইকারীদের আদেশে প্লেন নামে ঢাকার তেজগাঁও বিমান বন্দরে। ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২ অক্টোবর , রুদ্ধশ্বাস ঘটনা সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে। এত বড় বিমান ছিনতাই ঘটনা আমাদের দেশে কখনো ঘটে নি। ২ অক্টোবর জাপান সরকার ছিনতাইকারীদের দাবী মেনে নেয়, যাত্রীরা ছাড়া পায় তেজগাঁও বিমান বন্দরে , চার্টার বিমানে ছয় রাজবন্দী সহ যাবতীয় দাবীকৃত অর্থ আসে ঢাকায়, ৩ তারিখ সেই বিমান উড়ে ঢাকা থেকে কুয়েত সিটি , কুয়েত সিটি থেকে দামেস্ক, দামেস্ক থেকে আলজেরিয়া। অবসান ঘটে এত বড় বিমান ছিনতাই এর ঘটনা।
এত বড় ঘটনায় যখন সবার রুদ্ধশ্বাস অবস্থা, সেই সময়ে সবার চোখের আড়ালে ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক ঘটনা। অক্টোবরের ২ আর ৩ তারিখ তথাকথিত বিদ্রোহ দমনের নামে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে ঘটে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। মিশরের গোয়েন্দা সংস্থা সেপ্টেম্বরের শেষেই সামরিক স্বৈরশাসক, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে অভ্যুথানের কথা জানিয়েছিল বিমানবাহিনীর অভ্যুথানের কথা। জিয়াউর রহমান কোন ব্যবস্থাই নেন নি, এমনকি বিমান বাহিনীর প্রধানকে সতর্ক করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে নি।
বিদ্রোহ শুরু হয়, বিদ্রোহীদের হাতে মারা যায় মেধাবী অফিসাররা। গুলি খেতে খেতে কোন মতে বেঁচে যায় রেড আর্মির সাথে আলোচনা করতে আসা জাপানের ডেলিগেটরা। ভোরের আলো ফোটার আগেই বিদ্রোহ দমন করা হয়, প্রায় ২০০ বিদ্রোহীর সবাই মারা যায়।
বিদ্রোহীরা মারা গেলেও থেমে থাকে নি হত্যাযজ্ঞ। বিদ্রোহে জড়িত থাকুক কিংবা নাই থাকুক, প্রহসনের সামরিক বিচারে নির্বিচারে হত্যা করা হয় একের পরে এক বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা আর সৈনিকদের, যারা ছিলেন প্রগতিশীল, মুক্তিযোদ্ধা অথবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। কাউকেই আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ দেওয়া হয় নি, মাত্র দুই মিনিটের বিচারেই মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়, ফায়ারিং স্কোয়াডে অথবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় তাদের। সঠিক সংখ্যা না জানা গেলেও ধারণা করা হয় প্রায় ১১৪৩ মানুষকে হত্যা করা হয় * , যার নিজেরাও জানতো না তাদের অপরাধ কোথায়। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যায় , কুর্মিটোলা বেজক্যাম্পের সৈনিক অফিসারদের সবাইকে হত্যা করা হয়, কারণ ১৯৭৭ এর মে মাসের "হ্যাঁ/না" ভোট, যে ভোটের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান নিজেকে রাষ্ট্রপতি বলে স্ব-স্বীকৃতি দেয় , গোয়েন্দা মারফত জানতে পারেন, কুর্মিটোলা বেজক্যাম্পের সবাই তাকে না ভোট দিয়েছিলেন। প্রতিশোধ নেয়ার সুবর্ণ সুযোগ কোন সামরিক স্বৈরশাসক হাতছাড়া করতে চায়?
,
জিয়ার উদ্দেশ্য ছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আজীবন ক্ষমতায় থাকা। এর জন্য তিনি সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের একে একে বা একই সাথে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেন। এমনকি তার এই পদক্ষেপের ব্যাপারে কট্টর জাতীয়তাবাদী সাবেক ডিজি বিডিআর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানও প্রশ্ন তুলেছেন বেশ কয়েকটি লেখায়। জিয়াকে এক অর্থে আমি দোষারোপ করি না(সাময়িক সময়ের জন্য তর্কের খাতিরে) । হঠাৎ করে পাওয়া ক্ষমতার সমীকরণে টিকে থাকতে তিনি জাদু মিয়াকেও সরিয়ে দিতে পারলে সাড়ে এগারো শত এয়ার ফোর্স কোন ছার!!
১৯৭৫ এর পর থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ছোট বড় ২৫ টার মতো সামরিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে। আমাদের প্রজন্ম না জানলেও ইতিহাস এগুলো রয়ে গেছে। হয়তো সবাই কেবল গুটি কয়েক ঘটনা নিয়ে ব্যাস্ত থাকে, এরকম আরও দুটো ঘটনা বহু মানুষ জানেনা জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনীর ১০ কি ১১তম বেঙ্গল রেজিঃ সৈনিকদের ও গোটা একটি ব্যাটালিয়ন ২১ রিওজন আর্টিলারী মেবি ওইটা তো চট্টগ্রামেই, লাল পাহাড়ের ওদিকেই এক রাতে গায়েব করে দিয়েছিলো। অন্যদিকে জেড ফোর্স নিয়ে মেজর জিয়ার নেতাকর্মীরা গর্ববোধ করে কিন্তু ওদের একজনও কি জানে জেড ফোর্স আসলে কি ছিলো কখন তৈরী হয়েছিলো ওদের কাজ কি ছিলো? কেন হাজার হাজার মুক্তিযুদ্ধা জেড ফোর্সের ভয়ে ভারতে দীর্ঘদিন আশ্রয়ে ছিলো পালিয়ে বেড়িয়েছে। কেউ এসব জানেনা,জানতেও চায় না। সবাই কেবল দলকানা ইতিহাস নিয়ে পড়ে থাকে।
,
আমার কেনো জনি মনে হয় বঙ্গবন্ধুর জীবনে সবচাইতে বড় ভুল ছিল জেনারেল খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান না করা। উচিত ছিল জেনারেল ওসমানীকে ভারতে আর জেনারেল জিয়াকে ভুটানে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো আর জেনারেল শফিউল্লাহকে কৃষি বা বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিযুক্ত করা। জেনারেল মোশাররফ অন্ততপক্ষে বাকি দুইজনের চাইতে অনেক বেশি কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন।
,
সেদিন আসিফ নজরুল সাহেব টক শো তে বলছিলেন খালেদা-হাসিনা দুইজনই ইতিহাসের অসম্ভব দুই জনপ্রিয় নেতার লিগাছি নিয়ে চলে যার দরুন তারা আধিপত্তের সাথে তিন তিন বার ক্ষমতায় এসেছেন কিন্তু এরশাদ সাহেব এমন কোন কিছুর ধারক নয় তাই তিনি পারেন নি।ইতিহাস সব সময় মানুষ কে শেখায় আর আমাদের ইতিহাস ক্ষয়তার পালাবদলে এতো বেশি বিকৃত হয়েছে যে আমরা প্রতিনিয়ত শুধু কনফিউজ হই।
দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল, এত বড় হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোথাও লেখালিখি হয় নি, ফলে পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারে নি। 1996 এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত এই ঘটনা দেশবাসীর অনেকেরই জানা ছিল না। কারন জিয়া এই পুরো ম্যাসাকারের ঘটনা আড়াল করেছিলেন । পত্রিকায় রিপোর্ট পর্যন্ত হতে দেননি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশে জিয়ার কুকীর্তির কাহিনী ফাঁস করে দেবার একটা সুযোগ সাংবাদিকরা পেয়ে যান। মনে পড়ে ভোরের কাগজের অনুসন্ধানী রিপোর্টার জায়েদুল আহসানের এক রিপোর্টে বিমান বাহিনীর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা অফিসার ও জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখান থেকে এক মর্মস্পর্শী ঘটনার সৃষ্টি হয় এক বিধবা স্ত্রী ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তার সন্তান বাবার খোঁজে পত্রিকা অফিসে এসে তালিকায় তাঁর বাবার নাম খুঁজে পায় । এখান থেকেই আনিসুল হক আয়েশা মঙ্গল উপন্যাসটি লেখেন।আর বর্তমানে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী তৈরি করেন "আয়েশা" নাটক।
ইতিহাস মুছে ফেলে যায় না ইতিহাস কথা বলে তার আপন নিয়মে।
,
Video document:
Click Here
***(এন্থনি ম্যাসক্যারেনহ্যাস এর লিখা এবং ফেসবুক, উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য)
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.