মিঠাইন থেকে বঙ্গভবনের অধিপতি

অনেক কারণেই রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সৌভাগ্যবান। কোনো বিতর্ক ছাড়াই সসম্মানে বঙ্গভবনে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে চলেছেন তিনি। শুধু তাই নয় দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তিনি। তাঁর পূর্বসূরি আর কারো এই সৌভাগ্য হয়নি।
'মেষপালক থেকে রাষ্ট্রনায়ক'। প্রচলিত কথাটির সঙ্গে একটু মিলিয়ে 'হাওর থেকে বঙ্গভবনের অধিপতি'- এভাবে বললে এতটুকু অত্যুক্তি হবে না। প্রথমজনকে চিনতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহম লিংকন। আর দ্বিতীয়জন? হ্যাঁ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কথাই বলছি। ভাটির দেশ নামে পরিচিত দুর্গম হাওর অঞ্চলের কৃষকের ছেলে আবদুল হামিদ এখন রাষ্ট্রের অভিভাবক, যিনি সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠায় অনুসরণীয়। যাঁর বিবেক সদাজাগ্রত মা, মাটি ও মানুষের কল্যাণচেষ্টায়। নিজ দায়িত্ব পালনে সর্বদাই সব মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে তাঁর অবস্থান প্রমাণিত।
সংসদবিষয়ক খবর সংগ্রহে নিয়োজিত বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মীর বিশেষ ঘনিষ্ঠ সাতবার নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য মো. আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট। সুনাম ও সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন বিরোধীদলীয় উপনেতা, ডেপুটি স্পিকার ও দুইবার স্পিকার হিসেবে। দীর্ঘ ৪২ বছরের অন্যতম প্রধান কর্মস্থল সংসদ থেকে অধিষ্ঠিত হলেন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে। সেদিন ছিল ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদ ভবনে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অঝোরে কেঁদেছিলেন। চোখ ভিজেছিল উপস্থিত সবার।

নবনির্বাচিত এই রাষ্ট্রপতি বক্তব্যের শুরুতে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। রুমালে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, এই সংসদে আমি ৪২ বছর কাটিয়েছি। আজকের দিনটা আমার জন্য বিষাদের। যেখানেই থাকি, মন থাকবে সংসদে। আপনাদের সবাইকে বিদায় জানানো আমার জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমি হয়তো বঙ্গভবনেই থাকব। তবে অন্য রাষ্ট্রপতির চেয়ে আমি বেশি সংসদে আসব। আপনারা আমাকে সহযোগিতা করবেন, যেন অর্পিত দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করে ইজ্জতের সঙ্গে বিদায় নিতে পারি।'
সত্যি আবদুল হামিদ ভুলে যাননি জাতীয় সংসদকে। মাঝেমধ্যেই ছুটে যান সংসদ ভবনে। সংসদ ভবনের সপ্তম তলায় রাষ্ট্রপতির দপ্তরে সময় কাটান। খোঁজখবর নেন স্পিকার থেকে শুরু করে সংসদ সচিবালয়ের সাধারণ কর্মচারীদের। প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতাও করেন। সাংবাদিকরাও এর থেকে বাদ পড়েন না। এই তো সেদিনও হঠাৎ ঢুকে পড়লেন সংসদ ভবনের সাংবাদিক লাউঞ্জে। সবাই হতবাক। এর আগে গত বছর বাজেট অধিবেশন চলাকালে একদিন আগে ঘোষণা ও প্রটোকল ছাড়াই সাংবাদিক লাউঞ্জে হাজির হন তিনি।

গত ৫ এপ্রিল রাতে সংসদ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছিল। রাত ৮টা ৩৪ মিনিটে সংসদের সাংবাদিক লাউঞ্জে অকস্মাৎ উপস্থিত হন রাষ্ট্রপতি। সব বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে মুহূর্তের মধ্যে মেতে ওঠেন হাসি-তামাশা ও স্মৃতিচারণায়। ঢুকেই বলেন, 'দেখতে এলাম কেমন আছেন আপনারা।' একে একে সবার সঙ্গে হাত মেলান। তারপর সাংবাদিকদের সঙ্গে নানা কথার ফুলঝুরিতে মেতে ওঠেন।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এই ব্যক্তি মাত্র পাঁচ মিনিটেই সবার খোঁজখবর নেন, কুশল বিনিময় করেন। বর্তমান স্পিকার ও সংসদ সদস্যদের দক্ষতা নিয়েও কথা বলেন। তাঁরা কেমন চালাচ্ছেন সে বিষয়ে সাংবাদিকদের মতামত জানতে চান। এ সময় সংসদে তাঁকে প্রতিদিন মিস করার কথা জানাতেও ভোলেননি সাংবাদিকরা। সংসদ প্রাণবন্ত করতে তাঁর হাস্যরস ও নানা চেষ্টার কথাও উল্লেখ করেন তাঁরা।

হাওর অধ্যুষিত জেলা কিশোরগঞ্জের মিঠামইন থেকে এসে বঙ্গভবনে স্থান করে নেওয়া আবদুল হামিদ সেদিন বিশাল বঙ্গভবনের দরবার হলে আমাদের দেখামাত্রই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। এগিয়ে এসে কুশল বিনিময় করেন, নাম ধরে ধরে সাংবাদিকদের পারিবারিক খোঁজখবর নেন। ইফতার শেষে বঙ্গভবন ঘুরিয়ে দেখান। ছবি তোলেন। আড্ডা দেন। খোলামেলা কথা বলেন অনেক বিষয়েই।

বঙ্গভবনে নিজেকে বন্দি মনে করেন রাষ্ট্রপতি। বিভিন্ন সময় তিনি অনেককেই তা বলেছেন। আমাদেরও বলেছিলেন। তিনি বলেন, 'আমি ছিলাম বরাবরই আড্ডাপ্রিয় মানুষ। এখন আর আগের মতো আড্ডা দিতে পারি না। কথা বলতে পারি না। সংসদে কাটিয়েছি জীবনের বড় একটি অংশ। সেই সংসদ আমাকে টানে। কিন্তু মন চাইলেই সেখানে ছুটে যেতে পারি না।' রসিকতা করে বললেন, 'ইচ্ছা করলে যেতে পারি মাত্র ১২ মিনিটে। কিন্তু যাই না। কারণ রাজধানীর ট্রাফিক। এমনিতেই যানজট নিয়ে মানুষের ত্রাহি অবস্থা। এর ওপর আমি যদি সংসদে যেতে চাই, তাহলে এক ঘণ্টা আগে থেকেই রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। সে জন্য আমার আত্মীয়স্বজন, এমনকি লালমাটিয়ায় আমার মেয়ের বাসায়ও যাই না।'

সংসদ অধিবেশন সরাসরি সম্প্রচারের কারণে প্রাণোচ্ছল এই ব্যক্তি সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা রয়েছে। অনেক কঠিন বিষয় মজা করে উপস্থাপনে তাঁর জুড়ি নেই। রাজনৈতিক কারণে একাধিকবার কারাবরণকারী এই নেতা নিজের নিরাপত্তাবেষ্টনী নিয়ে একটু টিপ্পনী কেটেই বলেন, 'কারাগার থেকে কোর্টে নেওয়ার সময় আমার চারপাশে থাকত পুলিশ। দড়ি দিয়ে হাত বেঁধে রাখত। আর এখন দড়ি লাগে না। এমনিতেই বাঁধা আছি। উল্টো বাড়তি পাওনা হিসেবে কিছু স্যালুট পাই।' রসিকতা করে আরো বলেন, 'জেলখানায় থাকতে সন্ধ্যার পর জেলখানার বাইরে কারারক্ষীরা তালা দিয়ে রাখত। আর এখন তালা ছাড়াই আমার মনে হয় তালাবদ্ধ হয়ে আছি। ইচ্ছামতো চলাফেরা করতে পারি না। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে চাইলে ইনফর্ম করা লাগে। নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে থাকতে হয়।'
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.