জানেন? পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ হতে চায়!
পাকিস্তানের নয়া প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান
পাকিস্তানের ক্যাপিটেল টিভির টকশো’র একটি ছোট ক্লিপিং দেখছিলাম। ছিলেন তিনজন অতিথি ও সঞ্চালক। অনুষ্ঠানটি সম্প্রতি প্রচারিত, তা আলোচকদের কথা থেকেই বোঝা যায়। এই আলোচকদের একজন জায়গাম খান, তিনি বেশ জোরালো গলায় বললেন, ইমরান খান পাকিস্তানকে অনেক কিছু বানাতে চান। তিনি বলেন, অন্য কোনও দেশের উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই, পাকিস্তানের উচিত প্রথমে বাংলাদেশ হওয়ার চেষ্টা করা। তা হতে কমপক্ষে দশ বছর সময় লাগবে। ততদিনে বাংলাদেশ উন্নয়নের দিক দিয়ে অনেক দূর চলে যাবে। সেই আলোচনায় একটু পরে আসছি।
পাকিস্তানের ষোলোতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খান শপথ নিয়েছেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনও প্রধানমন্ত্রী তার পূর্ণ মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে প্রকাশ্য জনসভায় নিহত হয়েছিলেন। ইমরান খান মেয়াদ শেষ করতে পারবেন, তেমনটি অনেকে মনে করেন না। পাকিস্তানের সত্তর বছরের ইতিহাসে একটি মাত্র সরকার তার মেয়াদ সম্পূর্ণ করেছে। সেটি পাকিস্তান পিপল্স পার্টি আসিফ আলী জারদারির সরকার। তার সরকার ২০১৩ সালে নওয়াজ শরিফের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে।
পাকিস্তানে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তিনি কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, কোনও একটি সরকারকে কতদিন পর ফেলে দিতে হবে, তা নির্ধারণ করে দেশটির সেনাবাহিনী, উচ্চ আদালত ও আমলাতন্ত্র। পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কতদিন টিকবেন, তা অনেকটা নির্ভর করে সেই দেশের সেনাবাহিনীর ওপর। কারণ তিনি সরাসরি সেনা-সমর্থনের ওপর ভর করে ক্ষমতায় এসেছেন। তার আগে পূর্বসূরি নওয়াজ শরিফকে আদালত অদ্ভুত সব পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শুধু ক্ষমতাচ্যুতই করেননি, তার দলের চেয়ারম্যানের পদ থেকেও অপসারণ করেছেন এবং বলেছেন, নওয়াজ শরিফ আর কখনোই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
ইমরান খান ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর কিছুদিন বিয়ে-শাদি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনটি বিয়ে করেছেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে স্বীকার করেন, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের ফলে ভারতে তার পাঁচটি সন্তান আছে। ক্রিকেট ক্যাপ্টেন হতে তিনি পাকিস্তানের রাজনীতির ক্যাপ্টেন হওয়ার অভিপ্রায়ে ১৯৯৬ সালে বিভিন্ন দল হতে আসা দলছুটদের নিয়ে গঠন করেন ‘পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ পার্টি’ বা পিটিআই। যেহেতু একার পক্ষে তার পাকিস্তানের ঘোলাটে রাজনীতিতে সুবিধা করা সম্ভব নয়, তাই তিনি আঁতাত করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর তালেবানদের সঙ্গে। শুরুতে ইমরান খানের দল নির্বাচনে তেমন একটা সুবিধা করতে না পারলেও ২০১৩ সালের নির্বাচনে তার দল জামায়াত-ই-ইসলাম ও কওমি ওয়াতানের সঙ্গে আঁতাত করে খাইবার পাকতুনখোওয়া প্রদেশে (প্রাক্তন উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। নির্বাচনে তাকে জোরালো সমর্থন দিয়েছিল তালেবান ও আল-কায়েদা গোষ্ঠী ।
জায়গাম খান, বাম থেকে তৃতীয়। তিনিই বলেছেন পাকিস্তানকে বাংলাদেশ বানিয়ে দিতে
ইমরান খান যেহেতু একজন সফল ক্রিকেটার, সেহেতু তিনি গ্যালারিকে খুশি করার জন্য খেলতে ভালোবাসেন; যা অনেক সময় দলের বিপক্ষে যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরও তিনি অনেকটা সেই পথেই হাঁটছেন। ঘোষণা করেছেন, এখন থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রী ভবনে আর থাকবেন না। এই ভবনকে তিনি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানাবেন। উঠেছেন তার সামরিক সচিবের তিন কক্ষের বাড়িতে। ফরমান জারি করেছেন, কোনও সরকারি কর্মকর্তা এখন থেকে বিমানে প্রথম শ্রেণি ও বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণ করতে পারবেন না। কোনও সভায় চা ছাড়া আর কিছু মিলবে না। পাকিস্তানের অর্থনীতির এখন যে অবস্থা, তাতে কৃচ্ছ্রতাসাধন ছাড়া কোনও উপায় নেই। বহির্বিশ্বে এখন পাকিস্তানের দেনা ৯ হাজার ২০০ কোটি ডলার যার বিপরীতে বাংলাদেশের দেনা হচ্ছে ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। সরকারি সভায় খালি চা খাইয়ে যদি এই দেনা শোধ করা যায় ভালো। এই সব শুনে চারিদিকে ধন্য ধন্য রব পড়ে গেলো। কেউ কেউ তাকে খলিফা ওমরের সঙ্গে তুলনা করা শুরু করলেন। কেউ বললেন, তিনি পাকিস্তানের নতুন কামাল আতাতুর্ক।
আমাদের দেশের এক শ্রেণির সবজান্তা শমসের বললেন ‘আহ্ পাকিস্তানের কী ভাগ্য এমন একজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছেন। বাংলাদেশের এখন দরকার একজন ইমরান খান।’ এসবের রেশ কাটতে না কাটতেই পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন যেহেতু তার বাস ভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী দফতর পনের কিলোমিটার দূরে, সেহেতু সময় বাঁচানোর জন্য এখন থেকে তিনি রোজ হেলিকপ্টারে অফিসে যাতায়াত করবেন। আকাশ পথ এই দূরত্ব আট নটিক্যাল মাইল। আসা যাওয়া ষোলো কিলোমিটার। সেই দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতিদিন হেলিকপ্টারে দফতরে আসা-যাওয়া অনেক ব্যয়বহুল। হিসেবে দেখা যাচ্ছে প্রতি নটিক্যাল মাইলে খরচ বাংলাদেশি টাকায় এগারো হাজার টাকা। দিনে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে যাতায়াত বাবদ খরচ হবে এক লাখ ছিয়াত্তর হাজার টাকা। এরই মধ্যে দুঃসংবাদ এলো জঙ্গিবাদের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিন্ন না করার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুত ত্রিশ কোটি ডলারের খয়রাতি সহায়তা দেশটি পাচ্ছে না।
গত বৃহস্পতিবার ইমরান খান মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো পাকিস্তানের উন্নয়নে সুইডেনের মডেল ব্যবহার করা হবে। সুইডেন এক কোটি জনসংখ্যার দেশ। ঢাকা শহরের অর্ধেক। পাকিস্তানের জনসংখ্যা বিশ কোটি। সুইডেনের মানুষের চাহিদা আর পাকিস্তানের মানুষের চাহিদা এক নয়, কারণ ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো সুইডেনেও বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি। দেশটির মোট জনসংখ্যার বিশ ভাগের বয়স পঁয়ষট্টি বছরের ওপর আর সতের শতাংশের বয়স চৌদ্দ বছরের নিচে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সাড়ে চার ভাগ মানুষের বয়স পঁয়ষট্টি বছরের ওপর আর প্রায় বত্রিশ ভাগের বয়স চৌদ্দ বছরের নিচে। দুই দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো সম্পূর্ণ বিপরীত। এমতাবস্থায় দুই দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এক হতে পারে না। ইমরান খানের সেই বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে পাকিস্তানের গণমাধ্যম ফলাও করে প্রকাশ করেছে। বলেছে ‘পাকিস্তানের উন্নয়ন মডেল হবে সুইডিশ মডেল’।
সেই রাতেই বিভিন্ন টিভিতে বসলো এই বক্তব্য নিয়ে আলোচনা বৈঠক–টক শো । ক্যাপিটেল টিভির টক শোতে সেদিন এসেছিলেন সিনিয়র উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক জায়গাম খান, যার কথা শুরুতেই বলেছি। সঙ্গে আরও দু’জন আলোচক। জায়গাম বললেন, ‘সুইডেন নয় আমি খুশি হবো পাকিস্তান উন্নয়নে আগামী দশ বছরে বাংলাদেশকে ছুঁতে পারলে।’ তিনি তথ্য দিয়ে বললেন, বাংলাদেশ বিদেশে বছরে রফতানি করে ৪ হাজার কোটি ডলার আর পাকিস্তানের এই পরিমাণ হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ কোটি বিলিয়ন। ঢাকা স্টক এক্সচেইঞ্জে বছরে লেনদেন হয় ৩ হাজার কোটি ডলার আর পাকিস্তানে এর পরিমাণ ১০ হাজার কোটি ডলার। বাংলাদেশে বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার, যার বিপরীতে পাকিস্তানে এর পরিমাণ হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার।
প্রতিবছর পাকিস্তানে জনসংখ্যা বাড়ছে ২.৪ শতাংশ হারে আর বাংলাদেশে বাড়ছে ১.১ শতাংশ হারে। দুই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তুলনা করতে গিয়ে জায়গাম বলেন, যেখানে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ২.৪ শতাংশের ওপর উঠতে পারেনি, সেখানে বাংলাদেশ তা সাত শতাংশের ওপর ধরে রেখেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। অথচ আজকের বাংলাদেশ এক সময় পাকিস্তানের অংশ ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোনও একটি দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে হলে তার জন্য চাই যোগ্য নেতৃত্ব যা বাংলাদেশ দেখিয়েছে। দশ বছর পর বাংলাদেশ আরও অনেক দূরে চলে যাবে’। বাকি দু’জন আলোচকও তার সঙ্গে একমত পোষণ করলেন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.