এগুলো হত্যাকাণ্ড! দুর্ঘটনা নয়
আকিফা মৃতদেহ কোলে নিয়ে বাবা
দুনিয়ার সবচেয়ে ভারী জিনিস নাকি বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ, সাদা কাফনে মোড়ানো সেই সহস্র মণ ওজনের ভারী বোঝাটা বুকে চেপে ধরে বসেছিলেন তিনি, উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার বেদনা। তার আট মাস বয়সী মেয়েটাকে রাস্তায় পিষে ফেলেছে একটা বাস, সেই বাসের চালক আর সহকারী মিলে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে আট মাসের এই শিশুটিকে!
আকিফা নামের আট মাসের বাচ্চা মেয়েটা ছিল মায়ের কোলে, দুনিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে। ওকে কোলে নিয়ে গত মঙ্গলবার কুষ্টিয়ার চৌড়হাস মোড় এলাকায় রাস্তা পার হচ্ছিলেন মা রিনা খাতুন। একটা বাসকে থেমে থাকতে দেখে সেটার সামনে দিয়েই পার হতে গেলেন, বাসের চালক বা সহকারী যে তাকে দেখতে পায়নি এমনটা নিশ্চয়ই নয়, তবুও কেন তারা গাড়িটা চালিয়ে দিল, সেটা এই নরপশুগুলোই ভালো বলতে পারবে। বাসের সজোরে ধাক্কায় রিনা খাতুনের কোল থেকে ছিটকে রাস্তার ওপরে পড়েছিল আকিফা, ঘাতক বাসটার চাকা চলে গিয়েছিল তার ছোট্ট শরীরটার ওপর দিয়ে!
আকিফা ও তার মাকে ধাক্কা দিচ্ছে ঘাতক বাসচালক
গত মঙ্গলবার দুপুরে এই ঘটনার পরপরই গুরুতর আহত অবস্থায় আকিফাকে নিয়ে যাওয়া হয় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে। শারিরীক অবস্থার অবনতি হওয়ায় সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে পাঠানো হয় তাকে। একরত্তি মেয়েটা যমদূতের সঙ্গে দুটো দিন একটানা লড়েছে, বেঁচে থাকার আদিম অভিপ্রায়ে। শেষমেশ কুলিয়ে উঠতে পারেনি, হার মানতে বাধ্য হয়েছে আকিফা। গতকাল ভোররাতে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অন্য একটা ভূবনে পাড়ি জমিয়েছে আকিফা, যেখানে আট মাসের ছোট্ট শিশুকে রাস্তায় বাসের নীচে চাপা পড়ে মরতে হয় না, যেখানে অকালে ঝরে যায় না কোন প্রাণ। যে ভূবনে ওর জন্যে অপেক্ষা করে আছে দিয়া আক্তার মীম বা রাজীবের মতো অনেকেই…
দুর্ঘটনা বলবেন এটাকে? আকিফার বাসের নীচে চাপা পড়াটা কোন দুর্ঘটনা ছিল না, এটা পরিস্কার হত্যাকাণ্ড, ঠাণ্ডা মাথার খুন। রাস্তার পাশে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজে দেখা গেছে, থেমে থাকা বাসটার সামনে দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে আসছিলেন আকিফার মা রিনা খাতুন। হুট করেই কোন হর্ন না দিয়েই বাসটা চলতে শুরু করলো, রিনা খাতুন সরে যাবার সময়টাও পেলেন না। ড্রাইভিং সিটে বসে চালক রিনা খাতুনকে দেখতে পায়নি, এটা স্বয়ং স্রষ্টা এসে বলে গেলেও আমি বিশ্বাস করবো না। চোখ বন্ধ করে রাখলে বা অন্য কোনদিকে তাকিয়ে থাকলেই এভাবে একটা মানুষের গায়ের ওপরে গাড়ি উঠিয়ে দেয়া সম্ভব।
আকিফার আম্মু, ভয়াবহ সেই ঘটনার স্বাক্ষী
পরিবহন আইনের নতুন ধারায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজার বিধান রাখা হয়েছে, সেইসঙ্গে বলা হয়েছে, যদি ‘ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড’ প্রমাণীত হয়, তাহলে প্রচলিত আইনে খুনের মামলা হিসেবে বিচার হবে সেটির। আকিফার বাবা হারুন অর রশীদ যোগাযোগমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন, সিসিটিভি ফুটেজটা দেখার জন্যে। সামনে দিয়ে শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে হেঁটে যাওয়া একজন মহিলাকে কিভাবে একটা বাস ধাক্কা দিতে পারে, একটা আট মাসের শিশুকে কিভাবে চাকার নিচে পিষে ফেলতে পারে, সেটা দেখে এই ঘটনাটা দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকান্ড, সেটা বিচার করার দাবী জানিয়েছেন তিনি।
নিহত আকিফা
পুতুলের মতো ছোট্ট মেয়েটা চলে গেছে সবাইকে ছেড়ে। অনেক বড় হবার কথা ছিল আকিফার, পৃথিবীর রূপ-রস উপভোগ করার কথা ছিল প্রাণভরে, সেসবের কিছুই করা হলো না, সেই সুযোগটা তাকে দিল না মানুষের চেহারায় ঘুরে বেড়ানো কয়েকটা হায়েনা। কুষ্টিয়ার চৌড়হাসে, যেখানে আকিফাকে চাপা দিয়েছিল বাসটা, সেই এলাকারই একটা কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে ওকে, চোখের জলে ছোট্ট মেয়েটাকে বিদায় জানিয়েছে বাবা-মা আর আত্নীয়-স্বজনেরা।
আকিফার খেলার সাথী টেডি বিয়ারটা পড়ে থাকবে ঘরের এক কোণায়, বাচ্চা মেয়েটা সেটাকে জড়িয়ে ধরে খেলায় মেতে উঠবে না আর কোনদিন। রোজ রাতে খাওয়া নিয়ে মা’কে যন্ত্রণা দেবে না আর, বাবার কোলে ওঠার বায়না ধরবে না কখনও। আমি জানি না, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে কিনা, আসামীরা এখনও পলাতক! আমি শুধু চাই, এই পিশাচগুলোকে ধরে এমন কঠোর সাজা দেয়া হোক, যেন এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে আর কোনদিন কাউকে আকিফার মতো করুণ পরিণতি বরণ করে নিতে না হয়, আর কোন বাসচালক যেন খুনের নেশায় এভাবে মত্ত হয়ে উঠতে না পারে…
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.