বিদেশী পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর খুনের ঘটনা
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সেসময় বিশ্ব গণমাধ্যমে তা প্রধানতম একটি রিপোর্ট হিসেবে প্রকাশিত হয়। কারণ, এই হত্যাকাণ্ড ছিল বৈশ্বিক রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, স্নায়ুযুদ্ধের অংশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ছিল স্নায়ুযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়ে রক্তাক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, আর এর পেছনে মূল কারিগর ছিলেন বঙ্গবন্ধু। গণমাধ্যমগুলো বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের এই ভয়ংকর ঘটনার বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছিল।
ওয়াশিংটন পোস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার একদিন পর ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে বামপন্থী ও স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশ করেছিল-
“রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুসলিম ও পশ্চিমা বিশ্বের মদদপুষ্টরা বাংলাদেশের সরকার ক্ষমতা দখল করেছে। মুজিবের মৃত্যু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি আঘাতস্বরূপ; কারন, মুজিবের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাতান্ত্রিক অর্থনীতির বৈশ্বিক রাজনৈতিক মিত্র ছিলেন ইন্দিরা।”
টাইমস ডেইলি এপি’র বরাত দিয়ে ১৬ আগস্ট রিপোর্টে বলছে-
“বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান উৎফুল্ল। ইসলামাবাদে এক বিজ্ঞপ্তিতে ভূট্টো ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার কথা জানিয়েছে। পাকিস্তান বাংলাদেশের এই নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া প্রথম রাষ্ট্র।”
পত্রিকাটি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্রী মুশতাকের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বিশ্বাসঘাতকতার কথা উল্লেখ করে বলছে-
“মুজিবকে হত্যা করার পর নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়া মুশতাক আহমেদ মুজিবকে দুর্নীতি, দরিদ্র অর্থনীতি ও আত্মীয়করণের জন্য অভিযুক্ত করেছে। মুশতাক মুজিবের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। ১৯৭১ এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুশতাক গোপনে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার চেষ্টা করেছিল, যা প্রকাশ হয়ে যাবার পর তার পদচ্যুতি হয়।”
ডেটোনা মর্নিং জার্নাল ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে বামপন্থী ও স্বৈরাচারী উল্লেখ করে তাঁর হত্যাকান্ডের বিষয়ে রিপোর্টে বলছে-
“নানাবিধ সমস্যাতাড়িত নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে উত্তরণের জন্য মুজিব জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বিপ্লবের ঘোষণা দিয়েছিল। তার কিছুকাল পরেই তাকে হত্যা করা হলো।”
পত্রিকাটি মুশতাককে পশ্চিমাপন্থী হিসেবে উল্লেখ করে এবং রেডিওতে প্রচারিত তার ভাষণকে ভিত্তি করে জানায়, নতুন প্রেসিডেন্ট মুশতাক পাকিস্তান ও চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করবে। এদিকে ভূট্টো সম্পর্কে পত্রিকাটি জানায়, ভূট্টো মুশতাক সরকারকে স্বীকৃতি ও সহযোগিতা করতে মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আহবান জানায়। পত্রিকাটি ঢাকাস্থ কূটনীতিক সূত্র উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীর খুন হবার কথা জানিয়েছিল।
পিটবার্গ প্রেস ১৬ আগস্ট প্রকাশিত রিপোর্টে সংবাদসংস্থা ইউপিআইয়ের বরাত দিয়ে জানায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতিরোধ সংগ্রামে কমপক্ষে ২০০ জনের হতাহত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে একজন মার্কিন সরকারি মুখপাত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানায়-
“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেবে এবং কোন সন্দেহ নেই যে, আমরা একসাথে কাজ করবো।”
ইউজিন রেজিস্টার গার্ড পত্রিকাটি ১৭ আগস্ট এক রিপোর্টে বলছে-
“ভারত সরকার বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন বিষয় বলে উল্লেখ করেছে। তবে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করছে বলে জানিয়েছে। হত্যাকান্ডের শিকার মুজিবের প্রশংসা করে এই হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।”
পাকিস্তান সম্পর্কে পত্রিকাটি জানাচ্ছে-
“মুজিবকে হত্যা করে প্রতিষ্ঠিত সরকার বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা করেছে। ভূট্টো এই নতুন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে এবং প্রচুর বস্ত্র ও ৫০ হাজার টন চাল সহযোগিতা পাঠিয়েছে।”
নিউইর্য়ক টাইমসে ২২ আগস্টে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন আশঙ্কা করছে যে, মুজিব হত্যাকান্ডের ফলশ্রুতিতে সোভিয়েতের বদলে চীনের সাথে বাংলাদেশের সখ্যতা সৃষ্টি হবে।
সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপাত্র প্রাভদা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডকে বাংলাদেশের ভবিষ্যত ও উন্নতির জন্য অন্তরায় বলে অবিহিত করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পেছনে পশ্চিমা, চীনা ও দেশীয় ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয় পত্রিকাটি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে সবচেয়ে চমকপ্রদ রিপোর্টটি করেন লরেন্স লিফশুজ, যা গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২৮ আগস্ট প্রকাশিত হয়; এতে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পেছনে বৈশ্বিক ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কয়েক বছর পরে লিফশুজ তথ্যপ্রমাণসহ এটি দেখিয়েছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ছিল এক জঘন্য মহাষড়যন্ত্রের ফলাফল।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.