শিখরা কেন সারাক্ষণ পাগড়ি পরে থাকে?
শিখদের পাগড়ির বাহার
ছোটবেলায় লোকমুখে শুনেছি, শিখরা হচ্ছে মুসলিমদের বড় শত্রু। পানিপথের যুদ্ধে তারা মুসলিমদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর তারা সিদ্ধান্ত নিল যতদিন না তারা মুসলিমদের পরাজিত করতে পারবে ততদিন তারা মুসলিমদের মত করে পাগড়ি পরবে। এরপর বহু বছরেও তারা মুসলিমদের হারাতে পারেনি। ধীরে ধীরে প্রতিশোধের পাগড়ি তাদের নিজস্ব ধর্মীয় রীতিতে পরিণত হয়েছিলো। আসলে কি তাই? না আসলে সেরকম কিছু নয়। এটি কেবলই মুসলিম সমাজে চালু হওয়া লোককথা
শিখ ধর্মাবলম্বীদের চিনতে খুব বেশি অসুবিধা হয় না তাদের স্বতন্ত্র পাগড়ির কারণে। এই পাগড়িকে তারা খুবই গুরুত্ব দেন বোঝা যায়। কখনো এমন হয় না যে তারা পাগড়ি খুলে হাঁটছেন জনসম্মুখে। এর পেছনের ইতিহাসটা জেনে নেয়া যাক। গুরু নানকের পর থেকে প্রত্যেক শিখ গুরু পাগড়ি পরা শুরু করেন। শিখদের দশম গুরু গুরু গোবিন্দ সিং পাগড়ি পরাকে রীতি হিসেবে প্রচলিত করেন। এই পাগড়ি শুধু চুলকেই রক্ষা করে না, এটি শিখদের সাম্যবাদের প্রতীক এবং শিখ ধর্মাবলম্বীদের বিশেষ স্বকীয়তা।
শিখদের প্রতিক
১৬৯৯ সাল। পাঞ্জাবের আনন্দপুরে গুরু গোবিন্দ বৈশাখী উৎসবে তার সকল অনুসারীদের ডাকলেন। মূলত এই সমাবেশ থেকেই শিখ ধর্ম একটি রুপ পায়। আজকের শিখ ধর্ম যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে সেটির ভিত্তি দিয়েছিলেন শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিং। তিনি ‘খালসা’ প্রবর্তন করেন যার উদ্দেশ্য শিখ জাতিকে একত্রিত করা। একে তিনি ‘আকাল ফৌজ’ বা ঈশ্বরের সেনাদল নাম দেন। পাঁচটি বিশ্বাসের প্রিন্সিপাল দেয়া হয় এই সম্মেলনে।
১। চুল না কেটে লম্বা করা।
২। কাঙ্গা বা চিরুনি ব্যবহার করা।
৩। আত্মশক্তি ও আত্মসংযমের জন্য কড়া বা লোহার চুড়ি ব্যবহার করা।
৪। আত্মরক্ষার জন্য কৃপাণ বা ছুরি রাখা।
৫। হাঁটু অবধি লম্বা অন্তর্বাস ও মাথায় পাগড়ি পরিধান করা।
এই সম্মেলন থেকে পাগড়ি পরার ব্যাপারটি সর্বস্তরের শিখদের মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব পায়।
প্রথম দিকে উচ্চ বংশীয় এবং উঁচু পদমর্যাদার শিখরাই কেবল পাগড়ি পরতেন। যারা পাগড়ি পরতেন তাদের বলা হত সর্দার। গুরু গোবিন্দ সিং সাম্যবাদ প্রচলনের ইচ্ছায় সকল শিখকে সর্দার ঘোষণা করলেন এবং সবার জন্যে পাগড়ি পরার রীতি চালু করলেন। প্রত্যেক শিখের নামের শেষে ‘সিং’ এবং ‘কাউর’ পদবি ব্যবহার করার ব্যাপারটাও ঠিক করে দিলেন। সকল শিখকে সমান মর্যাদা দেয়ার জন্যেই এই ব্যবস্থা।
শিখদের বিয়ের আসর
শিখরা সাধারণত চুল কাটেন না। শুধু তাই নয়, তারা দাঁড়ি কিংবা শরীরের কোনো প্রাকৃতিক চুলের উপর কাঁচি চালান না। এটাকে তারা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার প্রতি বিশ্বাস বলে মনে করেন। তাদের কথা হলো, সৃষ্টিকর্তা যা দিয়েছেন সেটার বিরুদ্ধে যাওয়া উচিত নয়। যেহেতু চুল কাটেন না তাই মাথায় পাগড়ি তাদের বিশেষ সুবিধা দেয় ধুলাবালি থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে সাদা এবং কালো ও নীল রঙকে তারা প্রাধান্য দেন। এটিও শিখদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। লাল রঙের পাগড়ি পড়া হয় শিখদের বিয়েতে। বিভিন্ন উৎসবে শিখরা কালারফুল পাগড়ি পরে থাকেন।
শিখ নারীদের অবশ্য সেরকম কোন স্পেশাল পোষাক নেই।
শিখ নারীরাও কি পাগড়ি পরেন? শিখ পুরুষরা যে ধরণের ট্রেডমার্ক পাগড়ি পড়েন নারীরা সেরকম না পরলেও লম্বা স্কার্ফ মাথায় পরেন যাকে তারা বলে থাকেন ‘চান্নি’ বা ‘দুপাট্টা’। শিখদের পাগড়ি আসলে বিশ্বস্থতারও প্রতীক। তারা বিশ্বাস করে শিখদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই, সকলেই সমান। এই বিশ্বাসের মর্যাদা হিসেবে তারা পাগড়িকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় এবং সবসময় এটি পরিধান করে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, শিখদের কাছে পাগড়ি খুবই সম্মানের ব্যাপার। আপনার যদি কোনো শিখ ধর্মালম্বী বন্ধু কখনো হয় কিংবা শিখদের কারো সাথে পরিচিত হতে যান প্রথম দেখায় পাগড়ি নিয়ে অস্বস্তিকর কোনো প্রশ্ন করলে তারা এটিকে ইতিবাচক ভাবে অবশ্যই নেবে না। অনেকে শিখদের পাগড়ি স্পর্শ করে দেখতে চান কিংবা পাগড়ির রহস্য নিয়ে অদ্ভুত কিছু বলেন ফেলেন যা শিখদের বিব্রত করে। শিখদের কাছে পাগড়ি রক্ষা ধর্ম রক্ষার মতই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক
সৃষ্টিকর্তার একত্ব এবং মানুষের ভ্রাতৃত্ব গুরু নানকের শিক্ষার মূলনীতি। তিনি পুরোহিততন্ত্র, মূর্তিপূজা ও বর্ণাশ্রম প্রথার বিরোধী ছিলেন। তিনি হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের সারতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আপন ধর্মমত প্রচার করেন। তিনি সহনশীলতার বাণী প্রচার এবং হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক মিলনের চেষ্টা করেন। নানকের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের নৈতিক জীবনের সংস্কার করা। তাই হিন্দু-মুসলমানসহ অন্যান্য সকল ধর্মের লোকই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে।
গুরু নানক তাঁর এই শিক্ষা ও আদর্শ প্রচারের লক্ষ্যে ১৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেন। পরে চীন, ভুটান, মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশ ঘুরে পশ্চিমবঙ্গের মালদহে আসেন। সেখান থেকে কৃষ্ণনগর এবং বাংলাদেশের সিলেট হয়ে ঢাকায় পদার্পণ করেন। ঢাকার রায়েরবাজারে কুমার সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনি প্রথম ধর্ম প্রচার করেন। সেখানে পানীয় জলের জন্য তিনি একটি কূপ খনন করেন এবং জাফরাবাদে একটি শিখ ধর্মশালাও নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। তবে সে সবের কোনো চিহ্ন এখন আর নেই।
নবম শিখ গুরু তেগ বাহাদুর সিং ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৬৬৫ সালে পাঞ্জাব থেকে বিহারের পাটনা হয়ে ঢাকা আসেন। ঢাকার বাংলাবাজারে তিনি একটি শিখ ধর্মশালা (সঙ্গত্তোলা মন্দির) স্থাপন করেন এবং সেখানে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তেগ বাহাদুর পায়ে হেঁটে বা নৌকায় করে ভক্তদের নিকট চলে যেতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দশম এবং শেষ গুরু গোবিন্দ সিং ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন এবং এখানে কিছুকাল অবস্থান করেন।
শিখদের উৎসবের ছবি
শিখ গুরুদের জন্মদিন পালন, নবজাতকের নামকরণ, বিবাহ এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শিখদের প্রধান উৎসব। তবে উল্লেখযোগ্য উৎসব হলো অমৃতপান ও ধর্মীয় খালসার জন্মতিথি পালন। এদুটি উৎসবের মধ্যে ১ বৈশাখ (১৩ এপ্রিল) বৈশাখী দিবস পালন করা হয়। ধর্মযোদ্ধাদের মৃত্যু দিবসও সাড়ম্বরে পালিত হয়। এছাড়া শিখ সম্প্রদায়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও তারা জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করে। শিখদের মরদেহ দাহ করা হয় এবং চিতাভস্ম নিকটস্থ নদী বা খালে বিসর্জন দেওয়া হয়। শিখ পুরুষদের মাথায় থাকে লম্বা চুল, হাতে কড়া বা বালা এবং কৃপাণ। এছাড়া তারা মাথায় বড় পাগড়ি পরে এবং দাড়ি-গোঁফ কাটে না।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার অতি মুষ্টিমেয় সংখ্যক হচ্ছে শিখসম্প্রদায়। তারা বিদেশ থেকে এসে সাময়িকভাবে এখানে বসবাস করে। এ কারণে তাদের উপাসনালয়ের ধর্মীয় কর্মকান্ডও অনেকটা নীরবে সম্পন্ন হয়। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে শিখ গুরুরাও বাংলাদেশের মাটিতে স্থায়িভাবে বসবাস করেননি। মুগল ও ব্রিটিশ আমলে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পালনের জন্য শিখরা এ এলাকায় সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আসত এবং দায়িত্ব পালন শেষে ফিরে যেত। তাদের স্বাতন্ত্র্যবোধ ছিল তুলনামূলকভাবে প্রখর। তাই এতদঞ্চলের মানুষের সঙ্গে তাদের কোনোরূপ সম্পর্ক বা সখ্য গড়ে ওঠেনি। তাদের ধর্ম, ভাষা ও জীবনধারা এদেশের পরিবেশের অনুরূপ না হওয়ায় তাদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের সম্পর্ক তেমন গভীর হয়নি।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.