গুজবের জনক ও তার গুজবনীতি
গুজবের জনক এ কে এ পল জোসেফ গোয়েবলস
বাংলেদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত শব্দ গুজব। গুজবের ছড়াছড়িতে কোনটা সত্য আর কোনটা গুজব তা বিশ্বাস করা কঠিন। গুজবময় বাংলাদেশে আজ আমরা গুজবের জনকের কথা জানবো।
নাম তার গোয়েবলস। পুরো নাম এ কে এ পল জোসেফ গোয়েবলস। ধর্মবিশ্বাসে রোমান ক্যাথলিক। বর্ণবিভাজনে শ্বেতাঙ্গ। জাতিতে জার্মান। বাবা ফ্রেডারিখ গোয়েবলস। মা ম্যারিয়ান ওল্ডেনহ্উসেন। বাবা ছিলেন পেশায় একজন হিসাবরক্ষক। গোয়েবলসের জন্ম ২৯ অক্টোবর ১৮৯৭। জন্মস্থান রেদত, জার্মানি। আত্মহত্যা ১ মে ১৯৪৫। গোয়েবলস দম্পতির ছিল ছয় সন্তান। এক পুত্র। পাঁচ কন্যা। তারা খুন হন মা-বাবার হাতেই।
গোয়েবলস দম্পতি আত্মহত্যা করেন তাদের সন্তানদের খুন করার দিনটিতেই। দিনটি ছিল কন্যা ক্যাথারিনের জন্মদিন। এর আগের দিন হিটলার ও তার স্ত্রী ইভা ব্রাউন একযোগে আত্মহত্যা করেন। মজার ব্যাপার হলো, হিটলার আত্মহত্যার মাত্র ৪০ ঘণ্টা আগে ইভা ব্রাউনকে বিয়ে করেন। এর আগে দীর্ঘ দিন ধরে তাদের মধ্যে ছিল প্রেমের সম্পর্ক। গোয়েবলস দম্পতি তাদের আত্মহত্যার আগে খুন করেন তাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানদের। মানুষের জীবনের কী নির্মম পরিণতি! তারা সবাই আত্মহত্যা করেন ফুয়েরার বাঙ্কারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নিশ্চিত প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই হয়তো তাদের আত্মহত্যার মতো এই চরম পথই বেছে নিতে হয়েছিল।
গোয়েবলসের সন্তানদের ছবি
গোয়েবলসের জীবন মোটামুটি সাড়ে সাতচল্লিশ বছরের। খুব একটা দীর্ঘ জীবন নিশ্চয়ই নয়। তার পরও গোয়েবলস ইতিহাসের বহুল আলোচিত-উচ্চারিত-ঘৃণীত এক নাম। প্রোপাগান্ডা বা অপপ্রচার আর গোয়েবলসের নাম যেন সমার্থক। প্রোপাগান্ডা চালিয়ে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করার ক্ষেত্রে তার জুড়ি আজো পৃথিবীতে নেই। তিনি বলতেন, একটি মিথ্যাকে সত্য বলে চালাতে হলে সেই মিথ্যাটি বারবার প্রচার করতে হবে। তবেই এ মিথ্যা সব মহলের কাছে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা পাবে।
জার্মান নাৎসি পার্টির সদস্য জোসেফ গোয়েবলস ১৯৩৩ সালে নিয়োগ পান এডলফ হিটলারের প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার হিসেবে। হিটলার তার হাতে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা তুলে দেন জার্মান রেডিও, সংবাদপত্র, সিনেমা, থিয়েটার ও যাবতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের।
জনতার আবেগ-অনুভূতি আর প্রোপাগান্ডার আধুনিক সব পদ্ধতি-প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে হিটলারকে ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় যেতে সহায়তা করেন মিথ্যাচারের রাজা গোয়েবলস । গোয়েবলস এ ক্ষেত্রে হয়ে ওঠেন এক সফল ও যথার্থ প্রোপাগান্ডিস্ট বা প্রচারণাবাদী। হিটলারও এর প্রতিদান দিতে ভুল করেননি। সরকার গঠন করেই হিটলার তাকে বানান মিনিস্টার ফর প্রোপাগান্ডা অ্যান্ড ন্যাশনাল অ্যালাইনমেন্ট।
হিটলার ও তার প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার গোয়েবলস
এরপর আমৃত্যু তিনি হিটলারের পাশে ছিলেন এবং হিটলারের পথ ধরে আত্মহননও করেন সপরিবারে। প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার হওয়ার পর গোয়েবলস আমৃত্যু শিক্ষা ও গণমাধ্যমকে ব্যবহার করেছেন নাৎসিদের প্রোপাগান্ডা মিশনকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য। তার প্রচার-প্রচারণার ফলে হিটলারের ভাবমর্যাদা অনেকটা ঈশ্বরের সমান্তরাল হয়ে ওঠে। আর এমন ধারণাই জার্মানদের মধ্যে বদ্ধমূল হয় যে, জার্মানদের জন্মই হয়েছে গোটা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। ১৯৩৮ সালে গোয়েবলস নিয়োগ পান হিটলারের ক্যাবিনেট কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ১৯৪৪ সালে হিটলার তাকে দায়িত্ব দেন সার্বিক যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।
গোয়েবলসের প্রোপাগান্ডানীতির ওপর লিওনার্দ ডব্লিউ ডোব পাবলিক ওপিনিয়ন অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা নামে একটি বই লিখেন। দ্য সোসাইটি ফর সাইকোলজিক্যাল স্টাডি অব সোশ্যাল ইস্যুজ সম্পাদিত এ সম্পর্কিত আরেকটি বই হচ্ছে ‘অ্যা বুক অব রিডিং’। সে যা-ই হোক এখানে পাঠকসাধারণের কৌতূহল মেটানোর প্রয়াসে গোয়েবলসের কিছু প্রোপাগান্ডানীতি নিচের অনুচ্ছেদে উপস্থাপিত হলো। গোয়েবলসের সফল প্রোপাগান্ডা চালাতে হলে এসব নীতি মেনে চলতে হবে।
গোয়েবলসের প্রোপাগান্ডা নীতি
০১. প্রোপাগান্ডিস্ট অর্থাৎ অপপ্রচারবাদীদের অবশ্যই বিভিন্ন ঘটনা ও জনমত সম্পর্কিত গোয়েন্দা তথ্য জানতে হবে;
০২. প্রোপাগান্ডা বা অপপ্রচার চালাতে হবে পুরোপুরি পরিকল্পিত উপায়ে। এই প্রোপাগান্ডা কার্যকর করার জন্য থাকবে একটিমাত্র কর্তৃপক্ষ। এই কর্তৃপক্ষ জারি করবে সব প্রোপাগান্ডা ডিরেকটিভস বা অপপ্রচার সংশ্লিষ্ট নির্দেশনা। এই কর্তৃপক্ষ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের কাছে অপপ্রচার সম্পর্কিত সব নির্দেশনার ব্যাখ্যা দেবেন এবং তাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বজায় রাখার ব্যবস্থা করবে।
০৩. কোনো একটি অপপ্রচারকর্মের পরিণতি কী হতে পারে, সে বিষয়টিও পরিকল্পনার একটি বিবেচ্য হতে হবে;
০৪. প্রোপাগান্ডা অবশ্যই এমন হবে, যা বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করবে শত্রুপক্ষের নীতি ও কাজের ওপর। প্রোপাগান্ডার বিষয়-আশয় ছাপিয়ে শত্রুপক্ষের হাতে প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা তথ্য যেন চলে না যায়। খোলাখুলিভাবে প্রোপাগান্ডা চললে এর বিষয় ও ভাব শত্রুপক্ষের প্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করা যায়। শত্রুকে এমনভাবে তাড়না করতে হবে, যাতে সে নিজের সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য না পেতে পারে।
০৫. প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেইন অর্থাৎ অপপ্রচার অভিযান বাস্তবায়নের জন্য অবশ্যই প্রকাশ করে দেয়া গোপন তথ্য ও অপারেশনাল ইনফরমেশন অবশ্যই পাওয়া দরকার;
০৬. প্রোপাগান্ডাকে মানুষের কাছে উপলব্ধিকর করে তোলার জন্য প্রোপাগান্ডার মধ্যে এমন কিছু থাকা চাই, যা মানুষের স্বার্থকে তাড়িত করে। আর এই প্রোপাগান্ডা সম্প্রচার করতে হবে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণকর যোগাযোগ মাধ্যম দিয়ে;
০৭. বিশ্বাসযোগ্যতাই একমাত্র নির্ধারণ করতে পারে প্রোপাগান্ডার ফল সত্য না মিথ্যা;
০৮. শত্রুর অপপ্রচারের উদ্দেশ্য, বিষয় ও কার্যকারিতা; প্রোপাগান্ডার শক্তি ও প্রভাব এবং চলমান প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেইনের প্রকৃতি দেখে ঠিক করতে হবে, এই প্রোপাগান্ডা উপেক্ষা করা হবে, না একে বিবেচনায় আনতে হবে;
০৯. বিশ্বাসযোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা এবং যোগাযোগের সম্ভাব্য প্রভাবই ঠিক করবে প্রোপাগান্ডার বিষয়বস্তু সেন্সর করতে হবে কী হবে না;
১০. শত্রুর প্রোপাগান্ডার বিষয়বস্তুকেও প্রোপাগান্ডা অভিযানে ব্যবহার করা যেতে পারে, যদি তা শত্রুর মর্যাদাহানির জন্য সহায়ক হয় কিংবা প্রোপাগান্ডিস্টদের নিজেদের উদ্দেশ্য অর্জনে তা সহায়তা করে;
১১. হোয়াইট প্রোপাগান্ডার বদলে বরং ব্ল্যাক প্রোপাগান্ডাকে কাজে লাগানো যেতে পারে, যখন দেখা যাবে হোয়াইট প্রোপাগান্ডা অধিকতর কম নির্ভরযোগ্য কিংবা তা থেকে পাওয়া যায় অপ্রত্যাশিত প্রভাবফল;
১২. মর্যাদাপূর্ণ নেতারা সহায়ক হতে পারেন প্রোপাগান্ডা অভিযানে;
১৩. সতর্কতার সাথে প্রোপাগান্ডা চালানোর সময় নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিযোগী অপপ্রচারের মধ্যেও যোগাযোগটা পৌঁছাতে হবে শ্রোতাদের মধ্যে। একটি প্রোপাগান্ডা শুরু করতে হবে অপটিমাম মোমেন্টে অর্থাৎ মোক্ষম সময়ে। প্রোপাগান্ডা থিম চলতে পারে বারবার, তবে এর প্রভাব কমে যেতে শুরু করলে তা আর চালানো যাবে না;
১৪. প্রোপাগান্ডা হবে ঘটনা ও জনসংশ্লিষ্ট। এতে ব্যবহার করতে হবে অনন্য বাগধারা বা স্লোগান, যা শ্রোতাদের মনে থাকা প্রত্যাশাকে প্ররোচিত করে। প্রোপাগান্ডা হবে সহজবোধ্য। এর ব্যবহার চলবে বারবার, তবে অবশ্যই যথাযথ সময়ে।
১৫. স্বদেশে পরিচালিত প্রোপাগান্ডা যেন মিথ্যা প্রত্যাশার জন্ম না দেয়, নইলে তা ভবিষ্যতে বড় ধরনের অশুভ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে;
১৬. স্বদেশে প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে অবশ্যই সৃষ্টি করতে হবে একটি সর্বোচ্চ আশঙ্কামাত্রা। পরাজয়ের পরিণতি সম্পর্কে স্বদেশে উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলতে হবে জনমনে। পরাজয়ের বিষয়টি ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে জনমনে বিদ্যমান অতি উদ্বেগ কমিয়ে আনতে হবে প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে। এই উদ্বেগ জনতা কমিয়ে আনতে পারে না;
১৭. স্বদেশে পরিচালিত প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে হতাশার প্রভাব কমিয়ে আনতে হবে। অপরিহার্য হতাশার বিষয়টি আগে থেকেই উপলব্ধিতে রাখতে হবে। অপরিহার্য হতাশার বিষয়টি দৃষ্টিগোচরে আনতে হবে;
১৮. প্রোপাগান্ডা সহায়তা করবে ঘৃণার টার্গেট ঠিক করে নিয়ে আগ্রাসন স্থানান্তর করতে
১৯. প্রোপাগান্ডা প্রবল প্রতি-প্রবণতার ওপর তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাব না-ও ফেলতে পারে, বরং এর পরিবর্তে এর ফলে কোনো ধরনের ক্রিয়ার জন্ম বা দিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
২০. প্রোপাগান্ডা অবশ্যই হতে হবে বুমেরাং-প্রুফ।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.