ফোনে আড়িপাতা ও সরকারের ক্রমাগত অপরাধ
বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী
আড়িপাতা বিষয়টা অত্যন্ত আপত্তিজনক। বাংলাদেশের সরকার দেশের সকল রাজনীতিকের ফোন ঢালাওভাবে আড়ি পাতার কাজ করছে। আড়িপাতার বিষয়টি নিয়ে বিশ্বব্যাপীও বিতর্ক রয়েছে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি জৈল সিং রাষ্ট্রপতি ভবনের টেলিফোনে আড়িপাতার জন্য রাজীব গান্ধী সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন। ১৯৯০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথাবার্তা যখন চলছিল, সেই সময় চন্দ্রশেখরের টেলিফোনে আড়িপাতার অভিযোগ উঠেছিল।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত টেলিফোনে আড়িপাতার ঘটনায় ১৯৭৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বিদায় নিতে হয়েছিল। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো রয়েছে। একটি বিশেষ আদালতের অনুমতি ছাড়া সেখানে আড়িপাতা আইনত নিষিদ্ধ। এছাড়া রয়েছে সিনেটরদের নিয়ে গঠিত সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটি।
যুক্তরাষ্ট্রে যেসব বিতর্কিত আইনের ধারায় নাগরিকদের ফোনে আড়িপাতা ও তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে চলতি বছরের মে মাসে। মার্কিন সিনেটে এ ব্যাপারে নতুন করে মতৈক্য না হওয়ায় আড়িপাতাসংক্রান্ত আইনের মেয়াদ নবায়ন সম্ভব হয়নি।
মার্কিন নাগরিকদের ফোনে আড়িপাতা বন্ধ রয়েছে
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে সন্ত্রাসী হামলার পর জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাকে (এনএসএ) আবারো কোনো সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলা এড়াতে ফোনে আড়িপাততে অনুমতি দিয়েছিল কংগ্রেস। প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট নামে পরিচিত ওই আইনের ২১৫ ধারাসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ধারার মেয়াদ ৩১ মে শেষ হয়ে যায়। ফলে আপাতত মার্কিন নাগরিকদের ফোনে আড়িপাতা বন্ধ রয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে আড়িপাতার বিষয়টি ঢালাওভাবে সরকারের এখতিয়ার। তারা ঢালাওভাবে পুরো রাষ্ট্রের সকল মানুষের ফোনে আড়ি পাতছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে প্রাইভেসি রাইটস বা ব্যক্তির তথ্য সুরক্ষা ও গোপনীয়তা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,
আইনের দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের যোগাযোগের উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে।
জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণার ১৭ নাম্বার ধারায় বলা হয়েছে,
কোনো ব্যক্তির নিজস্ব গোপনীয়, পরিবার, বাড়ি ও অনুরূপ বিষয়কে অযৌক্তিক বা বেআইনি হস্তক্ষেপের লক্ষ্যবস্তু বানানো যাবে না, তেমনি তার সুনাম ও সম্মানের ওপর বেআইনি আঘাত করা যাবে না। এছাড়াও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণা (অনুচ্ছেদ ১২), জাতিসংঘের কনভেনশন অন মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স (অনুচ্ছেদ ১৪) এবং শিশু অধিকার সনদ (অনুচ্ছেদ ১৬)-তে ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তা’কে অধিকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বাংলাদেশ তথ্য অধিকার আইনেও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
আড়িপাতা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার কাজে করা যেতে পারে এবং সরকার সেই ক্ষমতা সংরক্ষণ করে। কিন্তু তাই বলে বিরোধী রাজনীতিকদের সকল কথা রেকর্ড করা একটি স্বৈরাচারী আচরণ।
এই কথাগুলো বলার কারণ কয়েকদিন আগে বিএনপি নেতা আমীর খসরুর একটি ফোনালাপ ছেড়েছে সরকার। সরকার এখানে দুটি অপরাধ করেছে। এক অন্যায়ভাবে তার ফোনকল রেকর্ড করেছে। দুই তার এই রেকর্ড মিডিয়ায় পাবলিশ করেছে।
আমীর খসরুর সাথে কথা বলা ব্যারিস্টার নওমী
এই দুটি অন্যায়ের উপর ভিত্তি করে পুলিশ আরো কয়েকটি অপরাধ করে যাচ্ছে। আমীর খসরু সেখানে বলেছেন লোকদের নামিয়ে দিতে। যা অনুমান করা যায় সেটা হলো 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলনে তিনি বিএনপি কর্মীদের নেমে যেতে বলেছেন।
বিএনপি এদেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। তারা যে কোন আন্দোলন নিজে করতে পারে। এই অধিকার তারা সংরক্ষণ করে। এছাড়া অন্য কারো আন্দোলনে সহায়তা করারও পূর্ণ অধিকার তারা সংরক্ষণ করে। এটা কোন অপরাধ নয়। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন যৌক্তিক। আমি মনে করি ছাত্রদের সাথে বিএনপি নয় শুধু সকল রাজনৈতিক দলকে এর জন্য ভূমিকা রাখা দরকার।
আমীর খসরু যদি এই আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন তবে বলা এটা তার মহৎ কাজ। জনগণের দাবীর সাথে তার এই একাত্মতা প্রশংসার দাবী রাখে। কিন্তু সরকার তার এই ভালো কাজকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
নওমীর পিতা কুমিল্লা সিটির কাউন্সিলর সিদ্দিকুর রহমান সুরুজ
সরকার আমীর খসরুর বিরুদ্ধে তথ্য-প্রযুক্তি আইনে মামলা করে অপরাধ করেছে। তার সাথে যে কথা বলেছিলো ব্যারিস্টার নওমী তাকে বেআইনিভাবে আটক করে অপরাধ করেছে। আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করার জন্য তাকে রিমান্ডে নিয়ে অপরাধ করেছে। শুধু তাই নয় তার বাবা কুমিল্লা সিটির কাউন্সিলর সিদ্দিকুর রহমান সুরুজকে ও আটক করে অপরাধ করেছে সরকার।
বাংলাদেশে সরকার ল্যান্ডফোন, মোবাইল ও তারবিহীন পিএসটিএনসহ সব ধরনের টেলিফোন গ্রাহকের কথোপকথন, ভয়েস ও ডাটা রেকর্ড করা হচ্ছে। সরকারের নির্দেশে ৬টি মোবাইল অপারেটর, বিটিসিএল ও ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জগুলো (আইসিএক্স) বাধ্যতামূলকভাবে এ রেকর্ড করছে। আন্তর্জাতিক কলের আদান-প্রদান রেকর্ড করছে আইসিএক্স।
অভ্যন্তরীণ কলগুলো রেকর্ড করছে সংশ্লিষ্ট অপারেটর। একই সঙ্গে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে ৭ হাজার টেলিফোনের কথোপকথন ও ডাটা রেকর্ড করছে। এজন্য তাদের নিজস্ব মেশিনপত্র ও সরঞ্জমাদি রয়েছে। এজন্য একটি গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়ে সাময়িকভাবে স্থাপন করা হয়েছে আড়িপাতার যন্ত্রপাতি। সেখানে পুলিশ, এসবি, এনএসআই আলাদা কক্ষে মুঠোফোন ও টিঅ্যান্ডটি ফোনে আড়িপাতছে।
ঢালাওভাবে আড়িপাতার এই সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশকে বের হতে হবে। নইলে এদেশে গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হবে। অবশ্য দেশে গণতন্ত্র থাকলেই তবে এসব কথা প্রাসঙ্গিকতা পায়। স্বৈরাচারের দেশে এগুলো কেবল অরণ্য রোদন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.