প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে রাষ্ট্র
একটি দ্রুত গতির বাসের চাপায় রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর ট্রাজিক মৃত্যুর পর গত এক সপ্তাহ ধরে রাজধানী কার্যত অচল হয়ে গেছে। শিশু-কিশোরদের এমন প্রতিবাদ বাংলাদেশের ইতিহাসে অতীতে আর দেখা যায়নি। হাজার-হাজার লাখ লাখ কিশোর-কিশোরী স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসেছে। তারা সৃজনশীল বিভিন্ন উপায়ে প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে। আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখেছি তারুণ্যের এই মহাজাগরণ!
সড়কপথে নিরীহ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা আমাদের দেশে নিয়মিত চিত্র। গড়ে প্রতিদিন ৮-১০জন মানুষের মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনায়। এই নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে অনেক কথাবার্তা হলেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ কখনও গ্রহণ করা হয়নি। ফিটনেসবিহীন গাড়ি, প্রশিক্ষণহীন চালক, চাঁদাবাজি, মাফিয়াবাজি, বিআরটিএর দুর্নীতিসহ নানা অব্যবস্থার কারণে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষের জীবন হারাচ্ছেন। অথচ যুগের পর যুগ ধরে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগগুলো মাটি-চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভুত ক্ষোভ এবার শিশু-কিশোরদের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটেছে। একথা ঠিক যে বর্তমান পরিবহন সেক্টরে যে সিস্টেম চালু আছে এতে বাসা থেকে বের হওয়ার পর কেউ-ই নিরাপদ নন। আজকে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ে রাস্তায় যে আন্দোলন করছে, সেটা বড়দের করার কথা ছিল। এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণের কথা ছিল রাষ্ট্রের। কিন্তু শিক্ষার্থীরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্র এবং বড়রা ব্যর্থ হয়েছে।
এবারের এই তারুণ্যের মহাজাগরণ অনেক নতুন কিছু নিয়ে এসেছে। নতুন অনেক কিছু শিখিয়েছে। সবচেয়ে বড় শিক্ষা রয়েছে সৃজনশীল স্লোগানে। অভিনব কিন্তু রাষ্ট্রের ভেতরের সমস্যাগুলোকে সহজ কথায় বুঝিয়ে দেয়ার সব স্লোগান।
স্লোগানগুলো একটু খেয়াল করুন: ‘শিশুরা পড়তে এসেছে মরতে নয়’, ‘ যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ’, ‘হয়নি বলে আর হবে না/আমরা বলি “বাদ দে!’/লক্ষ তরুণ চেঁচিয়ে বলে/”পাপ সরাবো হাত দে’, ‘৪৭ বছরের পুরানা রাষ্ট্রের সংস্কার কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত’, ‘আমরা যদি না জাগি মা ক্যামনে সকাল হবে’, ‘বিবেক তবে কবে ফিরবে?’ ‘মুজিব কোটে মুজিবকেই মানায়, চামচাকে না’, জনপ্রতিনিধিদের সপ্তাহে অন্তত তিনদিন গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হবে‘, ‘মা তুমি আমার জন্য আর অপেক্ষা করো না, আমি আর ঘরে ফিরবো না’, ‘আমরা ৯ টাকায় ১ জিবি চাই না, নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘4G স্পিড নেটওয়ার্ক নয়, 4G স্পিড বিচার ব্যবস্থা চাই’,
‘পুলিশ আংকেল, আপনার চা-সিগারেটের টাকা আমি আমার টিফিনের টাকা দিয়ে দিচ্ছি। তাও আপনি এসব গাড়ি চালাতে দিয়েন না’, ‘পুলিশের গাড়ির লাইসেন্স নাই’, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ চাই না, নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘বিচার চাই না, বিচার করতে হবে’ ‘ শিক্ষকের বেতের বাড়ি নিষেধ যে দেশে, পুলিশের হাতে লাঠি কেন সেই দেশে’, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের আপাতত রাস্তা সামলাতে দিন মন্ত্রী পুলিশকে স্কুলে পাঠান শিক্ষিত করতে’, ‘we want justice ‘, ‘দেশে একসময় বয়স্ক শিক্ষা স্কুল ছিল নিরক্ষরতা দূর করার জন্য। সেই স্কুল আবার দরকার কর্তাব্যক্তিদের ‘সেন্স’ ফিরিয়ে আনার জন্য’।
দেশের রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশ প্রশাসক, জনপ্রতিনিধি, এমপি-মন্ত্রী সবারই এই স্লোগানগুলো ভালোভাবে পাঠ করা দরকার। তরুণদের এই স্লোগানগুলোর মধ্যে কেবল নিরাপদ সড়কের দাবিই নেই, পাশাপাশি রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্লেদগুলিও কিন্তু উঠে এসেছে। দেশের মাননীয়রা, কর্তাব্যক্তিরা যদি এই স্লোগানগুলোর মর্মার্থ উদ্ধার না করেন, আগামীতে সাবধান না হন, তাহলে কিন্তু এই তরুণরাই উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে দিতে পারে। আমি মন্ত্রী, আমি এমপি, আমি আমলা, আমি পুলিশ, কাজেই আমার যা খুশি তাই করার অধিকার আছে, ক্ষমতা ও দাপট দেখানোর সুযোগ আছে-এই মনোভাব দেখিয়ে চললে কিন্তু এমন বিদ্রোহ আবার ফিরে আসতে পারে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ, ফোরজি এগুলোর চেয়েও যে মানুষের নিরাপত্তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ- এটা তরুণরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’ ওঠার আগে মানুষ যে নিরাপত্তা চায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি বুঝতে পারছেন?
এবারের এই নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে তরুণরা অনেক কিছু শিখিয়েছে। আন্দোলন কিভাবে করতে হয়, দাবিতে অটল থাকতে হয়, শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হয়। কোনো কাবাব-পরোটার আশা না করেই তারা সারাদিন না খেয়ে রোদে-পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় প্রতিবাদ করেছে। যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছে। লাইসেন্স পরীক্ষা করেছে। দিনশেষে রাস্তার সব আবর্জনা পরিস্কার করে ঘরে ফিরছে।
ক্রমবর্ধমান জবাবদিহির অভাবে, কীভাবে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা, একটা প্রজন্ম, গত কয়েকদিন তার একটা উজ্জ্বল নমুনা স্থাপন করেছে। পুলিশ, মিলিটারি, মন্ত্রীরাও এসব স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে জবাবদিহি করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। আইন-ভাঙ্গার অপরাধ কবুল করেছে। রাস্তায় শিক্ষার্থীরা গাড়ির লাইসেন্স চেক করছে, আর পুলিশ আইন-ভঙ্গকারীদের একের পর এক শাস্তি দিচ্ছে, এ এক অকল্পনীয় দৃশ্য।
মন্ত্রীরাও রেহাই পাননি। পানিসম্পদ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর গাড়ির লাইসেন্স না থাকাতে ওই গাড়ি আটকে রাখে শিক্ষার্থীরা। রং-সাইড দিয়ে গাড়ি চালানোর জন্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদকেও সোজা পথে চলতে বাধ্য করে শিক্ষার্থীরা। একজন সংসদ সদস্য ও আইনপ্রণেতা ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে, জনভোগান্তি বাড়িয়ে ব্যস্ত রাস্তায় রং সাইড দিয়ে তাঁর গাড়ি দিয়ে যাওয়াটা গোটা জাতির জন্যই লজ্জাজনক।
দেশটা আসলে এভাবেই চলছে। যদি আইনপ্রণেতা, আইনের রক্ষক, আইনপ্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যখন-তখন আইন না ভাঙতেন, তাহলে আমাদের এই প্রিয় স্বদেশটা হয়তো আরও অন্যরকম হতে পারত।
গত কয়েক দিনে ঢাকার রাজপথে যা ঘটেছে, এগুলো কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। এর ভেতরে ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তনের গভীর বার্তা আছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব বলে দিয়েছে, এখনকার এই ‘মগের মুল্লুক’ কিন্তু আর বেশি দিন চলবে না! সাধু সাবধান।
আরেকটা জিনিস যেটা এই আন্দোলনে স্পষ্ট হয়েছে তা হলো এদেশের ৯০% গাড়ি ও চালকের সঠিক কাগজপত্র নেই। একটি রাষ্ট্র এতদিন কীভাবে চলেছে? এটি একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। কতটা দুর্নীতি চললে রাষ্ট্র এমন হতে পারে!
ঔদ্ধত্য নয়, বিনয়; জেদ নয়, যুক্তিকে মেনে নিতে শিখতে হবে। ছাড় দেয়ার মানসিকতা লালন করতে হবে। পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী সংবেদনশীল উদ্যোগই হতে পারে এ মুহূর্তে সরকারের জন্য একমাত্র রক্ষাকবচ। মনে রাখতে হবে, শিশুরা চাইছে নিরাপদ সড়ক, সেটা নিশ্চিত করার প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব সরকারের। আর এটা তো শুধু শিশুদের দাবি নয়, এ দাবি সবার।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.