এদেশ দানবদের! এদেশে বিচার হয় না
ভাতের প্লেট নিয়ে ওদের মা হয়তো অপেক্ষা করছিলেন। আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েগুলো অপেক্ষা করছিল বাসের জন্যে। কে জানতো, কারো অপেক্ষাই আর কোনদিন ফুরোবে না! ঘাতক বাসের চাকার নীচে পিষ্ট হয়ে ছেলেমেয়েগুলো হারিয়ে যাবে চিরতরে, ওদের ছোট ছোট শরীরগুলো রক্ত-মাংসের দলা হয়ে পড়ে থাকবে রাস্তায়! নিজেদের কর্মে একদিন হয়তো ঠিকই ওরা পত্রিকার পাতায় জায়গা করে নিতো, কিন্ত তার অনেক আগেই খবরের শিরোনাম হয়ে যেতে হলো রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের এই ছাত্র-ছাত্রীদের।
হোটেল র্যাডিসনের উল্টোপাশে দাঁড়িয়েছিল ওরা। কলেজ ছুটি হয়েছে, এখন বাসায় যেতে হবে। খানিকটা দূরে বাসা হওয়ায় বাসেই যাতায়াত করতে হয় ওদের। ওরা হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি, সেই বাসই ঘাতক হয়ে হাজির হবে আজ! সিএমএইচ স্টপেজ থেকে জাবালে নূর পরিবহনের একটা বাসে উঠছিল ওরা। এমনই সময় যমদূতের মতো আরেকটা বাস এসে চাপা দিলো ওদের! সরে যাওয়ার সময়টাও পায়নি ওরা, বাসের ধাক্কায় ছিটকে পড়েছিল দুয়েকজন, বাকীরা কেউ চাকার নীচে, কেউবা ছিলেন বনেটের সামনে।
চাপ চাপ রক্ত, আহতদের আর্তনাদে মূহুর্তেই ভারী হয়ে উঠেছিল জায়গাটা। পথচারী আর পুলিশ মিলে দ্রুত আহতদের উদ্ধার করে কূর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন দুই ছাত্রছাত্রী। আর গুরুতর আহতদের ভর্তি করা হয়েছে সিএমএইচে। একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দিয়া আর দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আবদুল করিম আর কোনদিন বাড়ি ফিরবে না, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠবে না, আর কোনদিন ওদের কলেজ ক্যাম্পাসে দেখা যাবে না। রোনালদো’র ভক্ত করিম আর কখনও রাত জেগে ফুটবল ম্যাচ দেখবে না। পহেলা বৈশাখে শাড়ি পড়ে সেজে বাইরে ঘুরতে বের হবে না দিয়া।
সবগুলো পত্রিকায় লেখা হচ্ছে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’র কথা। এটা দুর্ঘটনা নয়, এটা খুন, ঠান্ডা মাথায় কিছু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আগেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। যাত্রীরা একটা বাসে উঠছেন, এরমধ্যে রাস্তার বামপাশের ছোট্ট জায়গাটা দিয়ে বাস ঢুকিয়ে দেয়াটা কোন ধরণের ড্রাইভিং রুলের মধ্যে পড়ে আমার জানা নেই। এদেশে বাস ড্রাইভারদের চেয়ে ভয়ংকর কোন প্রাণী এই মূহুর্তে বোধহয় আর কেউ নেই।
কয়েকদিন আগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পায়েলকে নৃশংসভাবে খুন করেছে হানিফ পরিবহনের ড্রাইভার আর হেল্পার মিলে। ছেলেটা বাসে উঠতে গিয়ে দরজার সঙ্গে আঘাত পেয়েছিল, সেই ঘটনা ধামাচাপা দিতে একটা মানুষকে খুন করে তার লাশটা গুম করে ফেলতে এই অমানুষগুলোর একটুও বুক কাঁপলো না। ফেসবুকে দুইদিন পরপর বাসের ভেতরে হেল্পার-ড্রাইভারদের হাতে নারী নির্যাতনের অভিযোগ শোনা যায়, এই ঢাকার ভেতরেই কয়দিন আগে রাজীবের হাত কেটে ফেলেছে ঘাতক বাস, ছেলেটা শেষমেশ বাঁচতেও পারেনি।
অথচ আমাদের রাজনৈতিক নেতারা, আমাদের মন্ত্রীরা তবুও এসব খুনীদের পক্ষে সাফাই গেয়ে যান, কার হাত জানালার বাইরে ছিল, কোন ‘দুর্ঘটনায়’ কার দোষ বেশি সেসব নিয়ে গবেষণা শুরু করেন! আজকের এই খুনের ঘটনাটার পরেও নিশ্চয়ই এমন কিছুই হবে বাসের জন্যে কেন ছেলেমেয়েরা রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়েছিল, রাস্তা তো বাস চলাচলের জায়গা, দাঁড়ানোর জায়গা তো নয়- এমন বাণী তো নিশ্চয়ই আসবে। গরু ছাগল চিনলে যে দেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়, সেদেশে এমন খুনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটবে, এতে আশ্চর্য্য হবার তো কিছু নেই! যেদেশে গরু ছাগল শ্রেণীর লোকজন মন্ত্রীর পদে বসে থাকেন, সেদেশে বাস ড্রাইভারেরাও যে গরু ছাগলই হবেন, সেটা তো সহজেই অনুমেয়।
এদেশে পরিবহন শ্রমিকরা হচ্ছে ছোটখাটো একেকজন দেবতা। আর তাদের পেছনে আছেন তাদের অঘোষিত এক ঈশ্বর! দেবতাদের দোষ নেই, ঈশ্বরের কোন ভুল নেই! সব ভুল জনগণের, সব দোষ আহত-নিহত মানুষের। এখন বরং যেসব ক্ষুব্ধ ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের সহপাঠীর মৃত্যুর পরে রাস্তায় নেমে বাস ভাংচুর করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। নইলে দেবতাদের অপমান করা হয়, ঈশ্বরের অসম্মান হয়!
শ্রমিকদের নেতা এবং নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল দুর্ঘটনার ব্যাপারে। তার মুখের তেলতেলে হাসিটা দেখে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের জিডিপি বুঝি দুই অঙ্কে পৌঁছে গেছে, নতুবা বাংলাদেশ দল ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতে গেছে বোধহয়! দুটো ছেলেমেয়েকে দিনে দুপুরে খুন করা হয়েছে, হাসপাতালে আরও কয়েকজন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, এমন সময়ে তার মুখে এমন তেলতেলে হাসি আসে কিভাবে?
মন্ত্রী বলেছেন, ভারতে দুর্ঘটনা নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি বা আলোচনা হয় না, যতোটা বাংলাদেশে হয়। মাননীয় মন্ত্রী, ভারতে বা সারা বিশ্বে যেগুলো হয় সেগুলো দুর্ঘটনা, বাংলাদেশে যেগুলো হচ্ছে সেগুলো মার্ডার, ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড। সেটা আপনি বুঝবেন না। আপনার কাজ নিজের লোকজনকে আগলে রাখা, সেটাই আপনি রাখছেন। আপনি শ্রমিকদের মন্ত্রী, জনগণের নন।
দিনকে দিন একদল ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন শহরজুড়ে, দেশজুড়ে তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। তারা রাস্তার মধ্যে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আমরা পড়ে আছি তাদের হাতের গিনিপিগ হয়ে। যেকোন দিন থেঁতলে যাওয়া শরীর নিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকবো, ঘন্টাকয়েক পরে জায়গা হবে হাসপাতালের মর্গে। স্বজনদের চোখের পানি শুকিয়ে যাবে একদিন, যেমনটা এখন দিয়া বা করিমের আত্নীয় স্বজন আর সহপাঠীদের হচ্ছে।
বিচার হবে না, এদেশে শুধু মানুষের বিচার হয়, দানবদের হয় না। তাই বিচার চেয়েও লাভ নেই। মন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী, সবাই এদের হয়ে সাফাই গায়, আদালত রায় দিলে এরা দেশ অচল করে দেয়, বিচারটা চাইবো কার কাছে বলুন?
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.