আসছে আতঙ্কের ৩০ জুলাই
আতঙ্কে আছেন আসামের বাঙালিরা
৩০শে জুলাইয়ের জন্য দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করছে অসমীয়া বাঙালিরা। শুধু অসমীয়া বাঙালীরা নয়, অন্য অনেক গোষ্ঠীর মানুষই অপেক্ষা করে আছে ওই দিনটার জন্য। আগামী সোমবার প্রকাশিত হবে জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর চূড়ান্ত খসড়া - যা নিয়ে আসামের কয়েক লক্ষ বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলমান আশংকায় আছেন যে তাদের নাম ওই তালিকায় থাকবে কিনা। যদি তালিকায় নাম না থাকে তবে তারা ভারতীয় নাগরিকত্ব খুইয়ে তারা অচিরেই পরিণত হবেন রাষ্ট্রবিহীন মানুষে।
ইতিমধ্যেই বিদেশী বলে বহু মানুষকে চিহ্নিত করেছে আসামের ফরেনার্স ট্রাইবুনালগুলি। প্রায় নয়শো মানুষ আটক রয়েছেন বন্দী শিবিরে। এমন বহু মানুষকে বিদেশী বলে রায় দিয়েছে ট্রাইবুনালগুলো, যাদের সব নথিপত্র থাকা স্বত্ত্বেও শুধুমাত্র শুনানীর দিন হাজিরা দেয় নি বলে একতরফা রায় হয়ে গেছে। পুলিশও আগে হাজিরার নোটিস দেয় নি, তাই এরা জানতেই পারে নি যে তাদের নামে ট্রাইবুনালে মামলা হয়েছে। অথচ সেই পুলিশই বিদেশী রায় হওয়ার আধ ঘন্টার মধ্যে লোককে খুঁজে বার করে থানায় ডেকে নিয়ে যায়। ছবি আর আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দেয়। অনেক মানুষ এভাবে বিদেশী বলে চিহ্নিত হয়ে গেছেন।"
এই বছরের প্রথম দিনেই অনিশ্চয়তার কবলে পড়েছেন ভারতের আসাম রাজ্যের ১ কোটি ৩৯ লাখ লোক। নাগরিকত্বের জাতীয় নিবন্ধনের (এনআরসি) খসড়া তালিকায় তাদের কারও নাম নেই। ইতিমধ্যেই তালিকায় নাম না থাকায় এক মণিপুরি মুসলিম আত্মহত্যা করেছেন। তালিকায় ১ কোটি ৯০ লাখ লোকের নাম ঠাঁই পেলেও বাদ পড়েছেন রাজ্যের চার বিধায়কসহ সাবেক মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট নাগরিকেরা। বাদ পড়া বিশিষ্টজনদের মধ্যে রয়েছেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য, আসাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ-এর মালিক-সম্পাদক তৈমুর রাজা চৌধুরী প্রমুখ। ভারতীয় সময় গত রোববার মধ্যরাতে তালিকা প্রকাশের পর রাজ্যজুড়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
আসামের বৈধ নাগরিকের তালিকা প্রস্তুত করছে NRC. যা প্রকাশ করা হবে ৩০ জুলাই।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন আসামের প্রাদেশিক সরকার আশঙ্কা করেছে, এই তালিকা প্রকাশের ফলে রাজ্যজুড়ে জাতিগত উত্তেজনা দেখা দিতে পারে। ভারতে যেসব রাজ্যে মুসলিমদের আনুপাতিক সংখ্যা বেশি, তাদের মধ্যে আসামের অবস্থান দ্বিতীয়। এজন্য তালিকা প্রকাশের আগে গোটা আসামজুড়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্তত পঁয়তাল্লিশ হাজার নিরাপত্তাকর্মী গোটা রাজ্যে মোতায়েন রয়েছে, সেনাবাহিনীকেও ‘স্ট্যান্ডবাই’ রাখা হয়েছে।
আসামের বিজেপি সরকার বলছে, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে, তাদের অবশ্যই ফেরত পাঠানো হবে। ২০১৪ সালের যে নির্বাচনে মোদি সারাদেশে জয়লাভ করছিল, ওই সময় জাতিগত সংঘাতের কবলে পড়ে আসামের নির্বাচন। ৪০ জনেরও বেশি মানুষ সে দাঙ্গায় নিহত হয়। তখন আসামে এক নির্বাচনি প্রচারণাকালে মোদি অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি থাকতে বলেছিলেন। ক্ষমতায় এলেই তাদের ফেরত পাঠানো হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।
এটা দাবি করা অসঙ্গত হবে যে, আসামে কোনও বাংলাদেশি নেই। আসাম একসময় বাংলার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেখানকার জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের যোগাযোগ প্রাচীন ও অত্যন্ত নিবিড়। ফলে ১৯৭১ সালে নির্যাতিত ও আতঙ্কিত বাংলাদেশিরা অনেকেই আসাম পাড়ি দিয়েছিলেন।
এনআরসির প্রতিবাদে দিল্লিতে তৃণমূল কংগ্রেসের এমপিদের বিক্ষোভ
কিন্তু ভারতে বিগত কয়েক বছরের ব্যবধানে ধর্মীয় উগ্রবাদ চরম রূপ ধারণ করছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এটা ঘটছে। ফলে আসামে থাকা বাংলাদেশিরা বৈধ না অবৈধ, তা নির্ণয় করা হচ্ছে ধর্মীয় পরিচয় দেখে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা আসামের সব মুসলিমদেরই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে সেখানকার মুসলিম অধ্যুষিত বরপেটা, দুবরি, করিমগঞ্জ, কাছাড় জেলার বাসিন্দারা। পশ্চিমবঙ্গেও অবৈধ বাংলাদেশি নাম দিয়ে মুসলিমবিরোধী প্রচারণা চলছে।
আসামের মুসলিমরা অবশ্য কেবলই আতঙ্কগ্রস্ত নন, তারা আন্দোলনও করছেন। তাদের দাবি, ১৯৭১ সালের আগে থেকে আসামে বাস করে এলেও নিরক্ষরতা ও অসচেতনতার জন্য তাদের পিতৃপুরুষরা অনেকেই কোনও কাগজপত্র তৈরি করেননি। তাই এখন তারা বিপদের মুখে আছেন। ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ এই আন্দোলনের নেতৃত্বে আসার চেষ্টা করছে। ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করার অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আমলে দীর্ঘদিন আন্দোলন করে সংগঠনটি। এর বর্তমান নেতা মাওলানা সৈয়দ আরশাদ মাদানি দিল্লিতে গত নভেম্বরের মাঝামাঝি ‘দিল্লি অ্যাকশন কমিটি ফর আসাম’ আয়োজিত এক সেমিনারে আসামের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘ভারতীয় নয় বলে এই মুসলিমদের যদি আপনি বের করার চেষ্টা করেন, তাহলে তো বলব আসামের বিজেপি সরকার এটাকেও আর একটা মিয়ানমার বানানোর চেষ্টা করছে।’
ভারতে মোদির নেতৃত্বাধীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের ক্ষেত্রে অবশ্য ভিন্ন নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের জন্য নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ করেছে মোদি সরকার। আইনে এমন সংশোধনী আনার প্রস্তাবও করা হয়েছে যে ২০১৬ সালের আগে যে হিন্দুরা, কিংবা মুসলিম ব্যতীত অন্য সংখ্যালঘুরা ভারতে এসেছেন, তাদের অবৈধ অভিবাসী বলে গণ্য করা হবে না।
ভারতের আসাম রাজ্যের মানচিত্র
অবশ্য আসামের বাংলাদেশি খেদাও আন্দোলনে কেবল বিজেপি নয়, জড়িয়ে আছে কংগ্রেসের নামও। ১৯৮৫ সালে প্রয়াত রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস সরকারের আমলে ‘আসাম চুক্তি’ সই হয় কেন্দ্রীয় সরকার, আসাম সরকার, সর্ব আসাম ছাত্র ইউনিয়ন ও সর্ব আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের মধ্যে। ছয় বছর আন্দোলনের পর পক্ষগুলো সমঝোতায় পৌঁছাতে সমর্থ হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৭১-এর ২৪ মার্চের পর যেসব বিদেশি অবৈধভাবে আসামে অভিবাসী হিসেবে ঢুকেছে, তাদের শনাক্ত করে ভোটার তালিকা থেকে নাম কেটে স্বদেশে ফেরত পাঠাতে হবে। ইতোপূর্বে চুক্তিটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ না দেখা গেলেও বিজেপি এটিকে হাতিয়ার করেই ক্ষমতায় এসেছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগেই সর্বানন্দ সোনোয়াল বলেছিলেন, তার সরকারের প্রথম কাজই হবে অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানো ও বাংলাদেশ-আসাম সীমান্তের চূড়ান্ত চিহ্নিতকরণ।
বিজেপির উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হিন্দুদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা গেলে তারা আজীবন বিজেপির ভোটব্যাংক হয়ে থাকবে। আর মুসলমানদের তাড়ানো গেলে বিরোধী ভোট কমে যাবে। তবে এর সঙ্গে যোগ আছে অসমীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেরও। বাংলাদেশিদের উপস্থিতিতে তারা বঞ্চিত বোধ করছে। দেখা যাচ্ছে, আদালতও এই বোধকে আমলে নিয়েছেন।
বাংলাদেশের ভূমিকা এই ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। অথচ আসামের ‘বাংলাদেশি খেদাও আন্দোলন’ সম্পর্কে এ দেশের সরকারের কোনও ভাষ্য নেই। চূড়ান্ত তালিকার কাজ শেষ। প্রকাশ হবে ৩০ জুলাই। এরপরই শুরু হবে বহিষ্কার। কিন্তু বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানিয়েছে, এভাবে অবৈধ বাংলাদেশিদের বহিষ্কার করার ব্যাপারে ভারত সরকারের কাছ থেকে কোনও তথ্য তারা পায়নি।
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সবকিছু ঘটে যাওয়ার পর সরকার হয়তো টের পাবে। কিন্তু আসামের এই বিষয়টি আদালতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় রাজনৈতিক সমঝোতা দিয়ে যে এর বিহিত করা যাবে না, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এখন থেকেই যদি সরকার কার্যকর ভূমিকা না নিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশকে অবশ্যই আসাম ফেরত মুসলমানদের জায়গা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অনুমিত সংখ্যাগুলো সঠিক হলে এটা রোহিঙ্গা সংকটকেও ছাড়িয়ে যাবে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.