২৫ মার্চের নেপথ্যে ছিল ৪ ঘন্টার একটি বৈঠক
নিউক্লিয়াস প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খান
বাংলাদেশের স্বাধীনতা কি হুট করেই পাওয়া? একটি দেশে কি হুট করেই মুক্তিযুদ্ধ হয়? না, তা হয় না। একটি দেশের স্বাধীনতার মত বড় ও অনেক ব্যাপক বিষয় কখনোই হুট করে হয় না। বাংলাদেশের মূলধারার ইতিহাসে আমাদের স্বাধীনতার পেছনের পটভূমি কখনোই সামনে নিয়ে আসা হয় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেপথ্যে যারা কাজ করেছে তারা হলো সিরাজুল আলম খানের 'নিউক্লিয়াস' সদস্যরা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ‘নিউক্লিয়াস’-এর কতিপয় সিদ্ধান্ত ও ঘটনা আজো প্রকাশিত হয়নি। স্বাধীনতার প্রশ্নে ‘নিউক্লিয়াস’-এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কও পুরোপুরি জানা যায়নি। ’৬২ থেকে ’৭১-এর ২৬ মার্চ পর্যন্ত ‘নিউক্লিয়াস’ এবং পরবর্তীতে ‘নিউক্লিয়াস’-এর রাজনৈতিক উইং ‘বিএলএফ’ এবং সামরিক উইং ‘জয় বাংলা বাহিনী’ সম্পর্কে কিছু অংশ প্রকাশিত হলেও অনেক কিছুই এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত।
একথা বুঝতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই যে, কোনো একটি ভাষণ (৭ মার্চ, ১৯৭১) অথবা কোনো একটি রেডিও থেকে বিশেষ বক্তব্য (২৬-২৭ মার্চ, ১৯৭১) অথবা পতাকা উত্তোলন (২ মার্চ, ১৯৭১) এবং ইশতেহার পাঠ (৩ মার্চ, ১৯৭১); এই ধরনের ঘটনা হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো বিষয় নয়। তাহলে ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটলো এবং এ ঘটার পেছনের ইতিহাস কি?
যুবক ও বিপ্লবী সিরাজুল আলম খান
বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ‘নিউক্লিয়াস-বিএলএফ’-এর আট বছরের অদম্য সাহসী ও বিচক্ষণমূলক সাংগঠনিক উদ্যোগ এবং ’৭১-এর ১ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ঘটনাবলী ও নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ নিয়ে হোমার-এর ‘ইলিয়াড’-এ বর্ণিত ট্রয় নগরীকে নিয়ে ঘটিত যুদ্ধের মতো কাব্যিক না হলেও উল্লিখিত কর্মযজ্ঞের মধ্যদিয়ে একটি জাতির নবজন্মের যে আত্মপ্রত্যয়ী ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার সূত্রপাত হলো তাকে নিয়ে ‘মহাকাব্য’ রচিত হতে পারে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন কেবল গণতান্ত্রিক অথবা সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ করলে তাও স্বাধীনতার পুরো ইতিহাসকে তুলে ধরা তো হবেই না বরং তা হবে জাতি গঠনে শত বছরের বীরত্বব্যঞ্জক ঘটনাবলী এবং ত্যাগের ইতিহাসকে পরবর্তী বংশধরদের কাছে গোপন করে রাখারই অপকৌশল। কেন এই অপকৌশল? আমাদের নতুন প্রজন্ম একদিন অবশ্যই তা জানতে চাইবে।
মার্চ মাসের প্রথম ২৬ দিনের প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতি ২৪ ঘণ্টা, পুরো সপ্তাহ এবং যতই ২৬ মার্চ ঘনিয়ে আসছিলো ততোই তখনকার জনগোষ্ঠীর মধ্যকার ছাত্র-যুবসমাজের যে অদম্য এবং সাহসী প্রত্যয়, অনেক জল্পনা-কল্পনা, অনেক পিছুটান, অনেক অনিচ্ছা এবং অনেক ধীরে চলার প্রচেষ্টাকে অতিক্রম করে স্বাধীনতার জন্য শেষ লড়াই সশস্ত্র যুদ্ধ সংঘটিত করার প্রস্তুতি নিয়েছিলো তা-ও প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন।
২২ মার্চ সংবাদপত্রসমূহে ইয়াহিয়া-ভুট্টো-মুজিবের আলোচনার সফলতা প্রকাশিত হলো।
পাকিস্তানকে রেখেই (নামে মাত্র হলেও) দুই অংশের দুই প্রধান মন্ত্রিত্ব নিয়ে এই আপস ফর্মুলা।
২৩ মার্চ এ আপস ফর্মুলার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার সৌজন্য সাক্ষাতের মাধ্যমে। আবার অন্যদিকে ২৩ মার্চ ছিলো পাকিস্তান দিবসের বিপরীতে ‘নিউক্লিয়াস’ ঘোষিত ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালন কর্মসূচি।
মুক্তিযুদ্ধের পরে সিরাজুল আলম খান (সর্ব বামে)
২৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু অনির্ধারিত সাক্ষাৎ করেন ইয়াহিয়ার সঙ্গে। জানাজানি হলো আপস-চুক্তি হবে না। এতদিনের যা অগ্রগতি হয়েছে তা বাতিল করে দিলেন শেখ মুজিব। জানিয়ে দিলেন শুধুমাত্র তাকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাদের তার অধীন করলেই সমস্যার সমাধান হবে। শেখ মুজিবের এই সিদ্ধান্তের ফলাফলই ২৫ মার্চে পাকিস্তানিদের আক্রমণ।
২৩ মার্চ গভীর রাতে ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চার ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়। এই বৈঠকে কী ঘটেছিলো যে কারণে বঙ্গবন্ধু আপস-ফর্মুলা থেকে বেরিয়ে আসলেন। বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষণার বক্তব্য ও ভাষা নিয়ে কয়েক ধরনের বিবরণ (version) শুনতে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার প্রকৃত কথাগুলো কি তা আজো অজানা।
তবে এটা ঠিক যে স্বাধীনতার এতদিনকার চিন্তা ভেস্তে যেত যদি শেখ মুজিব আপোস ফর্মুলায় রাজি হতেন ইয়াহিয়া ও ভূট্টোর সাথে। শেখ মুজিব সেদিকে এগুচ্ছিলেনও। কিন্তু নিউক্লিয়াস সে যাত্রা থেকে বঙ্গবন্ধুকে ঠেকিয়েছে। তারই ফলশ্রুতিতে আমাদের স্বাধীনতা।
- দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত সিরাজুল আলম খানের প্রবন্ধ অবলম্বনে
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.