দামি গাড়ি পরিচালনা করার অর্থ নেই আমার
অগ্নিকণ্যা মতিয়া চৌধুরী, ছবি- প্রথম আলো
অগ্নিকণ্যা মতিয়া চৌধুরী। মোটা ভাত ও মোটা কাপড়েই চলে বাংলার অগ্নীকণ্যার জীবন। এখনো বদলাননি একটুও। মোটা কাপড় পরেন। চলাফেরা সাদামাটা। নেই সাজগোজ। সরকারি গাড়ি কিংবা অফিসে এসি থাকলেও ব্যবহার করেন না। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী হলেও চলার পথে পুলিশ প্রটেকশনের গাড়ি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। আলোচিত এ ব্যক্তিত্ব হলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী।
রাষ্ট্রীয় কাজের ব্যস্ততার মাঝেও নিজেই বাজার-সদাই করেন। কারওয়ানবাজার থেকে সংসারের জন্য চাল, ডাল, শাকসবজি, মাছ ও মাংস কেনেন দরদাম করে। খাদ্য তালিকায় কোনো আভিজাত্যের ছোঁয়া লাগেনি। বরাবরের মতো মোটা চালের ভাত, শাকসবজি, ভর্তা আর তরি-তরকারিই আছে এখনো। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা একদিন ভালোবেসে তাকে ভাবতো অগ্নিকন্যা বলে।
সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি সবসময় বিদ্যমান ছিল তার মাঝে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের সাথে তার ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। ছবি- বিডি নিউজ ২৪
সেই নেত্রী ক্ষমতাধর হওয়ার পরও সাধারণ জীবনযাপন করছেন। কোনো লোভ-লালসা তাকে তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। সেই রাজপথের নেত্রী ক্ষমতাসীন হয়েও সদাসতর্ক। সম্প্রতি তিনি গণমাধ্যমের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন। সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন না। অনেকের কৌতূহল, নীরব কেন বেগম মতিয়া চৌধুরী?
সরকারের গুরু দায়িত্ব তার কাঁধে। সাপ্তাহিক ছুটি কিংবা সরকারি বন্ধের দিন ছাড়া ঘুম থেকে ওঠেন ভোরে। সকাল ৮টার মধ্যে নাশতা পর্ব শেষ করেন। সোয়া ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকার লোকজন ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সাক্ষাৎ দেন। এরপর সাড়ে ৯টার মধ্যে রাষ্ট্রীয় কিংবা দলীয় কর্মসূচি না থাকলে সচিবালয়ের নিজ দফতরে পৌঁছান। বিকাল ৫টা পর্যন্ত টানা আট ঘণ্টা অফিস করলেও সরকারি অর্থে কোনো খাবার গ্রহণ করেন না।
ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবন তার। রয়েছে নানা দুর্বিষহ স্মৃতি। একবার-দুইবার নয়, ১৫ বার জেলে গেছেন। বছরের পর বছর আত্মগোপনে কাটিয়েছেন। কিন্তু মাথানত করেননি। আর্থিক সমৃদ্ধির প্রলোভন দেখানো হয়েছে। তবুও নিজের অবস্থান থেকে একচুলও নড়েননি। দুঃখ-কষ্টের দিন শেষ করে আজ তিনি ক্ষমতায়। সরকারের মুখ্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। সেখানেও তার আদর্শ ও অবস্থান অবিচল। বেগম মতিয়া চৌধুরীর নামটি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও সম্মানের সঙ্গে উচ্চারণ করেন।
চারদলীয় জোট আমলে নির্যাতিত মতিয়া চৌধুরী, ছবি- gettyimages.co.uk
তার জন্ম ১৯৪২ সালের ৩০ জুন। পিরোজপুরের নজিপুর উপজেলার মাহমুদকান্দায় তার পৈতৃক নিবাস। পিতা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন মাদারীপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মা নুরজাহান বেগম গৃহিণী। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের এক গৃহশিক্ষকের কাছে। পিতার চাকরির সুবাদে মতিয়া চৌধুরীর শৈশব কেটেছে মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও জামালপুর শহরে।
১৯৫৮ সালে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কামরুন্নেসা গার্লস কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাস করেন। কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ইডেন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৬২ সালে বিএসসি পাস করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৩ সালে ন্যাপের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে ন্যাপ ছেড়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ১৯৮৬ সালে দলের কৃষি সম্পাদকের পদ পান।
১৯৯৬ সালে সরকার গঠন হলে তিনি কৃষি, খাদ্য ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০০২ সালে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালের ১৮ জুন পারিবারিকভাবেই খ্যাতিমান সাংবাদিক বজলুর রহমানের হাতে হাত রেখে নতুন জীবন শুরু করেন। ২০০৮ সালে স্বামীর মৃত্যু তাদের জীবনে বিচ্ছেদ ঘটায়।
সবসময় গণমানুষের সাথে ছিলেন মতিয়া চৌধুরী, ছবি- বাংলা ট্রিবিউন
সম্প্রতি মন্ত্রণালয় পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া একটি বিএমডব্লিউ মডেলের গাড়ি না নিয়ে আলোচনায় এসেছেন এই মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী তাকে সহ মোট পাঁচ জন সিনিয়র মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাকে এই মডেলের একটি করে গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। অন্যরা হচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। প্রত্যেককেই নিজ নিজ মন্ত্রণালয় দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার জন্যই এই উপহার দেন প্রধানমন্ত্রী। বাকি চার মন্ত্রী সানন্দে প্রধানমন্ত্রীর উপহার গ্রহণ করেন, তবে বিনয়ের সঙ্গে তা ফেরত দেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী।
এই ফেরত দেওয়াতে মহত্মের কিছু নেই বলেই প্রতিক্রিয়ায় জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, এটি বেশ দামি গাড়ি, আমি অপেক্ষাকৃত কম দামের গাড়িতে চড়ে অভ্যস্ত এবং তাতেই ভালো আছি। তিনি এও বলেন, এত দামি গাড়ি পরিচালনা করার অর্থ তার কাছে নেই।
মতিয়া চৌধুরী আরও বলেন, আজ আমি মন্ত্রী আছি, কাল মন্ত্রী নাও থাকতে পারি, তখন এই দামি গাড়ি চালানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, বিষয়টিকে গ্লোরিফাই করার কিছু নেই, প্রধানমন্ত্রী তার বদান্যতা দেখিয়ে আমাকে এই গাড়িটি দিয়েছিলেন, আমি প্রয়োজন নেই বলেই ফিরিয়ে দিয়েছি। আমি মনে করি অন্য কোনও মন্ত্রীকে তিনি এটি দিতে পারবেন।
শীতবস্ত্র বিতরণ করছেন মতিয়া চৌধুরী, ছবি- যুগান্তর
গাড়ি পরিচালনার খরচ মন্ত্রণালয় থেকেই বহন করা হবে, তাহলে আপত্তি কেন? এমন প্রশ্নে মতিয়া চৌধুরী বলেন, কয়েক দিনের জন্য সুখ বাড়িয়ে কোনও উপকার নেই। সুখ এক ধরনের আসক্তি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও সাদাসিধে জীবন-যাপন করেন, আমিও সাদাসিধে জীবনেই অভ্যস্ত। আমার বেশি কিছু পাওয়ার নেই। স্বামী প্রয়াত বজলুর রহমানের কথা উল্লেখ করে মতিয়া চৌধুরী বলেন, তার রেখে যাওয়া গাড়িতেই আমি চলছি, কোনও সমস্যা হচ্ছে না।
কারাগারে দুটি কম্বল পেয়েও জীবনের অনেক দিন কাটাতে হয়েছে, স্মরণ করেন মতিয়া চৌধুরী। বাংলাদেশ গর্বিত এমন একজন মানুষকে মন্ত্রী হিসেবে পেয়ে। আমাদের সব মন্ত্রীরা যদি এমন হতেন তবে হয়তো বাংলাদেশের চেহারা অন্যরকম হতো।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.