জয় বাংলা যেভাবে আমাদের স্লোগান হলো...
সিরাজুল আলম খান ও তার সহযোগী নিউক্লিয়াস সদস্যরা
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নির্ধারক ভূমিকা পালন করে! ‘জয় বাংলা’ এমন একটি স্লোগান যা বাংলাদেশের সশস্ত্র যুদ্ধের সময় জনগণকে তাঁদের স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রবল উদ্দীপক ও তেজোদীপ্ত করেছিলো। এর আগে বাঙালি আর কখনো এতো তীব্র, সংহত ও তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান দেয়নি, যার একটি পদেই প্রকাশ পেয়েছে রাজনীতি, দেশ, দেশপ্রেম, সংস্কৃতি, ভাষার সৌন্দর্য ও জাতীয় আবেগ।
‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিলো সশস্ত্র যুদ্ধকালীন সময়ে বাঙালির প্রেরণার উৎস। যুদ্ধে সফল অপারেশন শেষে কিংবা যুদ্ধ জয়ের পর অবধারিতভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা চিৎকার করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে চারপাশের জনগণকে বিজয়ের বার্তা পৌঁছে দিতো। কখন, কীভাবে কিংবা কী বিশেষ প্রয়োজনে এ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটির উৎপত্তি হয়েছিলো, তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হলো-
সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯। সেদিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি সভা ছিলো। মধুর ক্যান্টিনের সে সভায় ১৭ মার্চ ‘শিক্ষা দিবস’ যৌথভাবে পালনের জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা করছিলেন।
সেদিন, সর্বদলীয় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’র আহূত সভায় আলোচনার এক পর্যায়ে তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে (তৎকালীন জিন্নাহ হল, যা বর্তমানে সূর্যসেন হল) প্রথম বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা আফতাব উদ্দিন আহমেদ এবং দর্শন বিভাগে (ইকবাল হল, যা বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র ও ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক চিশতি শাহ হেলালুর রহমান (’৭১ সালে শহীদ) ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারণ করেন। সভা চলাকালীন সময়ে অনেকটা আকস্মিকভাবেই সকলকে চমকে দিয়ে চিৎকার করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন ছাত্রলীগ নেতা আফতাব উদ্দিন আহমেদ, পরক্ষণেই সেই স্লোগানের প্রত্যুত্তর দেন তৎকালীন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক চিশতি শাহ হেলালুর রহমান।
সঙ্গে সঙ্গেই আরো সাত-আটজন কর্মী প্রতিধ্বনি দিলো, ‘জয় বাংলা’। সেদিনের সেই সভায় আফতাব বেশ কয়েকবার ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি দেন এবং শেষের দিকে উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মীরাও এর প্রত্যুত্তর দেন। এরপর এভাবেই কিছুক্ষণ ওই স্লোগান চললো। বলা হয়ে থাকে সেটাই এ বাংলার বুকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের সর্বপ্রথম উচ্চারণ। আর এ দুই ছাত্রনেতাই ছিলেন ‘নিউক্লিয়াস’ বা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’-এর সদস্য।
যদিও তার বেশ আগেই ১৯৬২ সালে গঠিত গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’র নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্রলীগকর্মীরা যেকোনো আন্দোলনে স্বকীয়তা আর স্বাধীনতা প্রকাশ করার জন্য এবং আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘জয় বাংলা’কে প্রতীকী স্লোগান হিসেবে উচ্চারণ করতেন। এছাড়াও ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ তখন হাতে লেখা তিন পাতার একটি পত্রিকায় কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ করে যার নাম ছিলো ‘জয় বাংলা’।
রবিবার, ১৮ জানুয়ারি ১৯৭০। সেদিন, ঢাকা শহরের পল্টনে আওয়ামী লীগের জনসভায় সিরাজুল আলম খান সর্বপ্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারণ করেছিলেন। স্লোগানটি ছিলো বাংলা শব্দ। জয়+বাংলা= ‘জয় বাংলা’ অর্থাৎ বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার জয়। বাংলার জয়ের কথা বলা হচ্ছে, তাই এ স্লোগান সকলের ভালো লেগেছিলো। সকলেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও এ স্লোগান বেশ মনে ধরে। এরপর ’৭০-এর ৭ জুন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের বিশাল এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে প্রথম যুক্ত করেন এ স্লোগানটি এবং উচ্চারণ করেন ‘জয় বাংলা’।
আমাদের অস্তিত্বে ‘জয় বাংলা’ শব্দের / স্লোগানের/ ধ্বনির ব্যবহার ও কার্যকারিতা আরো ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের উৎপত্তি এবং জাতীয় স্লোগানে পরিণত হবার রয়েছে এক ইতিহাস। সংক্ষেপে তা হলো-
‘নিউক্লিয়াস’র পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্লোগান নির্ধারণের জন্য তিনটি ‘সেল’কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। এর মধ্যে একটি সেল ‘জিয়ে সিন্ধ’ বা ‘জিও সিন্ধ’ (জয় সিন্ধু)-এর মতো করে ‘জয় বাংলা’ শব্দটি কাজে লাগানো যায় কি না সিরাজুল আলম খান এর কাছে উপস্থাপন করা হয়। এ ‘সেল’টির মূল দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আফতাব উদ্দীন আহমেদ (পরবর্তীতে ড. আফতাব আহমেদ)।
সুবিধা মতো সময়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বিষয়টি ‘নিউক্লিয়াস’র বিবেচনায় আসে। ‘নিউক্লিয়াস’র সদস্যদের প্রত্যেকেরই ‘ভেটো’ (Veto) দেয়ার সুযোগ ছিলো। এ ‘ভেটো’ (Veto) প্রয়োগের কারণে প্রায় ৮-১০ দিন সময় লাগে ‘জয় বাংলা’কে অনুমোদন দানের ক্ষেত্রে। পাশাপাশি বলে দেয়া হয়েছিলো স্লোগানটিকে সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করার জন্য। যেন আর দশটা স্লোগানের মতো ‘জয় বাংলা’কে যত্রতত্র ব্যবহার না করা হয়।
‘তুমি কে? আমি কে?
বাঙালি-বাঙালি’;
‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’;
‘পিন্ডি না ঢাকা? ঢাকা-ঢাকা’;
‘ছয় দফা-ছয় দফা, না হলে এক-দফা’;
এগার দফা-এগার দফা, নাহলে এক-দফা’;
‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’;
‘স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।
এ স্লোগানগুলো ‘নিউক্লিয়াস সেল’র মাধ্যমে স্লোগান হিসেবে গ্রহণ করা হয়, যা পরবর্তীতে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এসব কোনো সাধারণ স্লোগান নয়, যেন একেকটি ঐশী বাণী। স্বাধীনতাকামী বাঙালির ‘প্রাণের স্পন্দন’, ‘স্বাধীনতার বীজমন্ত্র’, ‘মুক্তি ও বিজয়ের মূলমন্ত্র’, ‘সশস্ত্র যুদ্ধের অনুপ্রেরণা’ এবং এগারোশো বছরের পরাধীনতার শেকল ভেঙে বাঙালির কাঙ্ক্ষিত ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন’ বাস্তবায়নের এক শক্তিশালী অস্ত্র।
‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বিষয়ে ছাত্রলীগের দুয়েকজন এবং আওয়ামী লীগের সবাই ঘোর আপত্তি করতো। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটিতেও ‘জয় বাংলা’র বিষয়ে আলাপ আলোচনা হয় এবং তাঁরা ‘জয় বাংলা’কে নিয়ে ‘ভারত ঘেঁষা রাজনীতি’ করা হচ্ছে এ যুক্তি তুলে ধরেন। শুধু কমিটিতেই নয়, আওয়ামী লীগ সভার সকলেই ‘জয় বাংলা’র বিরুদ্ধে অবস্থান নেন (তাজউদ্দিন আহমদ ছাড়া)।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বৃহত্তর অংশই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের সরাসরি বিরোধিতা করেন এবং তাঁরা এ স্লোগানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কাছে অভিযোগও করেন। //এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি উত্তর ছিলো, ‘এ বিষয় নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই’। আওয়ামী লীগের বৃহত্তর অংশ এ আবদারমূলক রাজনীতির //প্রতি বঙ্গবন্ধুর কোনো রকম সমর্থন না পেয়ে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছিলো। তাঁরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে ভারতের ‘জয় হিন্দ’ ও সিন্ধুর ‘জিয়ে সিন্ধ’ বা ‘জিও সিন্ধ’ এর সঙ্গে মিশিয়ে এক ধরনের বিদ্রুপ করতো। আর সুযোগ পেলে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়া ছাত্রলীগ কর্মীদের ওপর চড়াও হতো।
১৮ জানুয়ারি ১৯৭০। সেদিন, পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভা হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওই দিনটিতে কৌশলগতভাবে ‘জয় বাংলা’ কে জনগণের কাছে প্রথমবারের মতো তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেয় ‘নিউক্লিয়াস’। গাজী গোলাম মোস্তফাকে (সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ) ‘নিউক্লিয়াস’র প্রতি পরোক্ষ একজন সহযোগী হিসেবে অতি নিপুণভাবে গড়ে তোলা হয়েছিলো।
মঞ্চে উপবিষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও গাজী গোলাম মোস্তফা ছাড়া আর কোনো আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন না। তবে আওয়ামী লীগ করতেন না কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রধান কাজে সদা ব্যস্ত থাকতেন এমন একজন ব্যক্তির সেই মঞ্চে উপস্থিতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর সেই ব্যক্তিটি ছিলেন সিরাজুল আলম খান।
গাজী গোলাম মোস্তফার উপর একটি দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো, যেভাবে হোক ‘বঙ্গবন্ধু’কে স্লোগান দেয়ার জন্য সিরাজুল আলম খানকে অনুরোধ করা। তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্যের পর বঙ্গবন্ধু মঞ্চে বসা অবস্থায় বললেন, ‘সিরাজ স্লোগান দে’। কথাটি বঙ্গবন্ধু দু’বার বললেন। সিরাজুল আলম খানও এ মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। যেনো অনেকটা যাদু দেখানোর মতো ভঙ্গিতে সিরাজুল আলম খান মাইকের সামনে এলেন।
এসে অত্যন্ত আবেগ মিশ্রিত বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, আজকের এ দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলাদেশের জন্য। প্রিয় ভাই-বোনেরা আপনারা দেখছেন ওই উপরে জ্বল জ্বল করছে দু’টি শব্দ ‘জয় বাংলা’। আসুন, সাত কোটি মানুষের পক্ষ হয়ে আমরা সকলকে জানিয়ে দিতে চাই, বাঙালি আমাদের পরিচয়। আসুন, যার কণ্ঠে যতো জোর আছে সবটুকু দিয়ে আমরা একই সঙ্গে বলে উঠি, ‘জয় বাংলা’। আজ থেকে ‘জয় বাংলা’কে আমাদের ভবিষ্যৎ আন্দোলনের স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
আসুন, আমরা সবাই কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আওয়াজ তুলি ‘জয় বাংলা’। তিনি আবারো বললেন, ‘জয় বাংলা’। তখন লক্ষ কণ্ঠের সমস্বরে আকাশ থেকে বাজ পড়ার মতো কানফাটা আওয়াজে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের ধ্বনি পল্টনকে মুখরিত করে তোলে। প্রত্যেক খুঁটির গোড়ায় চিরকুট ইতিমধ্যে খোলা হয়ে গেছে। নির্দেশ ছিলো ‘জয় বাংলা’কে প্রতিধ্বনিত করে ‘জয় বাংলা’ বলা।
পল্টনেই শুধু নয়, ফিরে যাবার মুহূর্তেও সকলের মুখে মুখে ধ্বনিত হচ্ছিলো ‘জয় বাংলা’! আত্মপ্রত্যয়ের এক শব্দ ‘জয় বাংলা’, বাঙালি জাতির পরিচয়ের এক শব্দ ‘জয় বাংলা’, যেনো একটি ব্যক্ত আবেগের শব্দ ‘জয় বাংলা’! সেই থেকে বাংলাদেশের জনগণ প্রথম জানালো তাদের আগামী দিনের স্লোগান ‘জয় বাংলা’। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ‘নিউক্লিয়াস’ (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ)-এর সিদ্ধান্ত অনুসারে আনুষ্ঠানিকভাবে এটাই প্রথম জনসম্মুখে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের উদ্বোধন।
তাজউদ্দীন আহমদের পর একে একে বক্তৃতা দিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। সভাপতি হিসেবে এবার বক্তব্য দিবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাও ঘোষণা করলেন সিরাজুল আলম খান।
‘জয় বাংলা’ মানে- সে সকল মানুষের জয়, যারা এ বাংলার মাটি ও মানুষকে শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে যুগে যুগে লড়াই করে হটিয়ে দিয়েছে- সেন, আর্য, সুলতান, মুঘল, পাঠান, মারাঠি, পর্তুগিজ, দিনেমার, ওলন্দাজ, ফিরিঙ্গি, বর্গি, ইংরেজ, নীলকর, কাবুলিওয়ালা, জমিদার-জোতদার, পাকিস্তানিসহ বিদেশি পরাশক্তিকে। আর বুঝিয়ে দিয়েছে ‘জয় বাংলা’ শুধু সাধারণ একটি স্লোগান নয়, ‘জয় বাংলা’ বাঙালির মটো (motto)।
তথ্যসূত্রঃ মানবজমিনে প্রকাশিত আর্টিকেল 'জয় বাংলা এবং আওয়ামী লীগ' থেকে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.