ফুটবল যেভাবে এলো পৃথিবীতে
পুরোনো দিনের ফুটবল
বিশ্বকাপ জ্বরে আক্রান্ত পুরো পৃথিবী। সারা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার নাম হচ্ছে ফুটবল। কিন্তু এই ফুটবল খেলাকে আজকের এই জনপ্রিয়তার পর্যায়ে আসার পেছনে রয়েছে এক ইতিহাস। এই ইতিহাস নিয়েও রয়েছে বেশ কিছু বিতর্ক। কেননা শুরুর দিকে এই ফুটবল খেলাকেই বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে খেলা হতো এবং বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। এই কারণেই ফুটবল খেলার আবিষ্কারক দেশ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।
বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের মতে ফুটবল খেলার আবিষ্কারক চীন দেশ হলেও বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে দেখা যায়, গ্রিক সভ্যতা এবং রোমান সভ্যতায় ফুটবল খেলার চল ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সালের দিকে গ্রিক ও রোমানরা বল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলা খেলত। গ্রিক ও রোমানদের বল নিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলার মধ্যে কিছু কিছু খেলা তারা পা দিয়ে খেলত। গ্রিক খেলা Episkyros এর উৎপত্তি হয়েছে রোমান খেলা Harpastum থেকে। সে সময়ের দু’জন লেখক এর লেখা থেকে এই বিষয়ে তথ্য উপাত্ত পাওয়া গিয়েছে। Antiphanes নামক এক গ্রিক নাট্যকার তার বিভিন্ন লেখাই খেলাগুলো সম্পর্কে বলেছেন। শুধু তিনি একা নন।
Clement of Alexandria নামে একজন ক্রিস্টিয়ান দার্শনিকও তার বিভিন্ন লেখায় সে সময়ের খেলাগুলো সম্পর্কে লিখেছেন। তাদের লেখা থেকেই এই বিষয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া এই বিষয়ে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় এক রোমান রাজনীতিবিদের লেখা থেকে। Cicero নামক এই রাজনীতিবিদ বলেন, খেলার সময় একজন মানুষ নাপিতের দোকানে দাড়ি কামানোর সময় বলের আঘাতে মারা গিয়েছিলেন এবং যে বল দিয়ে খেলা হতো সে বল গুলো বাতাস দ্বারা পূর্ণ থাকত অনেকটা বেলুনের মত।
চীনের ফুটবল খেলা, সে সময় এই খেলার নাম ছিল ‘ছু চিউই’
অন্য একটি মতে, জানা যায় ফুটবল খেলার জন্ম হয় যুক্তরাজ্যে। সময়টা ছিল ১২শ শতাব্দী। তবে এই একই মতানুসারে যুক্তরাজ্যের আরও আগে চীনে ফুটবল খেলার প্রচলন ছিল। শুধু তাই নয়, চীনাদের জনপ্রিয় খেলা ছিল এই ফুটবল। তবে সে সময় এই খেলার নাম ছিল ‘ছু চিউই’। ঘটনাটা আজ থেকে আরও আড়াই হাজার বছর আগের।
সে সময় চীনে বেশ ঘটা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্রীড়া উৎসবের আয়োজন করা হতো। তবে এই ক্রীড়া উৎসবকে সরাসরি ফুটবল খেলা বলা যাবে না। চীনা ভাষায় খেলাটির নাম ‘টু সু ছু পা’। চীনা ভাষায় ‘টু সু’ এর অর্থ পা দিয়ে লাথি মারা বোঝায় এবং ‘ছু পা’ অর্থ চামড়ার তৈরি বল। নামের দিক থেকেই বর্তমানের ফুটবল খেলার সাথে পুরোপুরি মিল রয়েছে। তখনকার বল চামড়া দিয়ে তৈরি হতো এবং ভেতরটা পূরণ করা হতো তুলা বা চুল দিয়ে। থাং ও সুং রাজবংশের সময় 'ছু চিউই' আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বিশ্ব ফুটবলের আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিফা প্রথমে প্রাচীন গ্রিক খেলা Episkyros কে ফুটবলের সর্বপ্রথম রূপ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। পরে ফিফা মত পরিবর্তন করে ‘cuju’ কে ফুটবল খেলার প্রথম রূপ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ‘cuju’ ছিল চীনের একটি খেলার নাম। চীনা ভাষায় এর অর্থ ‘kick ball’।
চীনে প্রথম দিকে এই খেলা শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রচলিত ছিল। সে সময় সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এই খেলার আয়োজন করা হতো। ঐতিহাসিক চাইনিজ সেনাবাহিনী গ্রন্থ Zhan Guo Ce যা প্রণীত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় থেকে ১ম শতাব্দীর মধ্যে যেখানে ফুটবল কথাটি খুঁজে পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে সেনাবাহিনীর একটা অনুশীলনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে যা cuju নামে পরিচিত। প্রতি দলে ৬ জন সদস্য থাকত এবং খেলার সময় ধাক্কা দেয়া ও একে অপরকে ফেলে দেয়া যেত। সে সময় এ খেলা সৈনিকদের সাহস ও শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির একটি কার্যকর মাধ্যম ছিল।
আবার অন্য একটি মতে, চীনে যে খেলাটির প্রচলন ছিল সেই খেলাটির ধরণ ছিল এমন – প্রতি দলে একজন কিংবা দুইজন খেলোয়াড় থাকত। মাঠের দৈর্ঘ্য ৩০ ফিটের মতো হতো। গোলপোস্ট ছিল এখনকার গোলপোস্টের চেয়ে আরও অনেক উঁচু। তবে পাশে ছিল মাত্র এক ফুট। এই এক ফুট জায়গা দিয়েই গোল করতে হতো। অনেক লম্বা হওয়া শর্তেও এই এক ফুট জায়গা দিয়ে গোল করা অনেক কষ্টকর ছিল। এখনকার মত সে সময় ও গোলপোস্টের পেছনে নেট ব্যবহার করা হত। গোলের ব্যবধানে হারজিত নির্ধারণ করা হত। নারী-পুরুষ সবাই এই খেলাটি খেলত।
চীন থেকে খেলাটি জাপানিদের মধ্যেও প্রচলিত হয়। তবে জাপানিরা যেই খেলাটি খেলত সেটির নাম ছিল ‘কিমারি’। এই খেলাটিও অনেকটা ‘টু সু ছু পা’ এর মতো। জাপানিদের এই ‘কিমারি’ খেলার নির্ধারিত কোনো নিয়ম-কানুন ছিল না। খেলার নিয়ম ছিল কয়েক জন মানুষ একটা বৃত্তাকার মাঠের ভিতর বল লাথি দিয়ে খেলবে তবে তারা চেষ্টা করত বল যেন মাটিতে না পড়ে বা শূন্যে ভেসে থাকে।
রোমানদের মধ্যে প্রচলিত খেলাটির নাম ছিল ‘হারপাস্টাম’
রোমানদের মধ্যে যে খেলাটির প্রচলন ছিল সেটির নাম ছিল ‘হারপাস্টাম’। সে সময়ের হারপাস্টাম খেলার ধরনও বর্তমানের ফুটবল খেলার মতো ছিল। আর রোমানদের মাধ্যমেই এই খেলাটি ইউরোপের দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রবিবার এই খেলাটি খেলা হত।
এবার আসা যাক ইংল্যান্ডের দিকে। আমরা অনেকেই জানি ফুটবল খেলার জনক হচ্ছে ইংল্যান্ড। কিন্তু ইতিহাস বলে ইংল্যান্ডে যখন এই খেলাটি আসে তখন সময়টা ছিল ১০৬৬ সাল। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই খেলাটি নিয়ে তেমন গন্ডগোল না হলেও ইংল্যান্ডে এসে খেলাটি রীতিমতো যুদ্ধে পরিণত হয়। অনেক যোদ্ধা এই খেলাটি খেলতে গিয়ে মারা গিয়েছেন। অনেকে হাত-পা ভেঙ্গে পঙ্গু হয়েছেন। যে যাকে পারত সেভাবেই মারত। এর মূল কারণ ছিল ইংল্যান্ডে খেলাটির কোনো নিয়ম কানুন ছিল না। তারপরও খেলাটির অনেক জনপ্রিয়তা ছিল। রাজপ্রাসাদ থেকে বারবার আদেশ করা সত্ত্বেও খেলাটি বন্ধ করা যায় নি। মানুষ বদ্ধ উন্মাদের মত খেলার নামে একে অপরের প্রাণ কেড়ে নিত।
এই একই সময়ে ইতালিতে ‘ক্যালচিও’ নামে এক খেলার আবির্ভাব হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে ইতালির ‘ক্যালচিও’ ছিল অত্যন্ত সাজানো গোছানো কৌশলময় একটি খেলা। ক্যালচিও শব্দটির উৎপত্তি হয় ‘ক্যালচিয়ার’ নামক একটি শব্দ থেকে। ‘ক্যালচিয়ার’ অর্থ হচ্ছে ‘কিক’। আর ‘ক্যালচিও’ অর্থ ফুটবল। ইতালির এই খেলাটিতে কোনো প্রকার মারামারির বিষয় ছিল না। খেলোয়াড়দের খেলা শেখানোর জন্য শিক্ষক থাকতেন। তারাই খেলা পরিচালনা ও প্রশিক্ষণ দিতেন।
আগে ফুটবল এত গোছানো ছিল না
এর প্রায় ৩শ বছর পর ঊনিশ শতকের দিকে ইংল্যান্ডের ‘রিচার্ড মুলকাস্টার’ নামক এক স্কুল শিক্ষক ইতালিতে এরকম সুন্দর সাজানো-গোছানো কৌশলময় ফুটবল খেলা দেখে ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্কুলে সাজানো-গুছানো কৌশলী ফুটবল খেলা চালু করার চেষ্টা করেন। পদে পদে তাদের অনেক বাঁধা এসেছে। তারপরও তারা ইংল্যান্ডের সেই মৃত্যুর খেলাটিকে সুন্দর সাজানো-গোছানো কৌশলময় খেলায় পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কিন্তু তখনও অনেক অগোছালো বিষয় ছিল। যেমন – দুই দলের খেলোয়াড়ের সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য। কোনো এক দলে খেলত ১৫ জন এবং প্রতিপক্ষ দলে খেলত ২০ জন। আর সে সময় গোলরক্ষক থাকত ৫ জন। এত বেশি পরিমাণ খেলোয়াড় মাঠের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করার ফলে এক ধরনের হট্টগোল লেগেই থাকত। তাই পরবর্তীতে ১৮৭০ সালে আইন করা হয় যে প্রত্যেক দলে ১১ জন করে খেলোয়াড় থাকতে হবে এবং এর মধ্য থেকে একজন গোলরক্ষক থাকবে একটি দলে। তাই ১৮৭০ সাল থেকেই আধুনিক ফুটবলের যাত্রা শুরু হয়।
১৯২৮ সালে সর্বপ্রথম আর্সেনালের পরিচালক পর্ষদ সহজে চেনার জন্য খেলোয়াড়দের জার্সিতে নম্বর বসানোর সিদ্ধান্ত নেন। তখন স্বাগতিক দলের জার্সি নম্বর থাকত ১-১১ পর্যন্ত এবং সফরকারী দলের নম্বর থাকত ১২-২২ পর্যন্ত। কিন্তু ১৯৪০ সালে সিদ্ধান্ত হয় যে একই নম্বর বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রাও নিতে পারবে কিন্তু নম্বর ঐ ১-২২ পর্যন্ত থাকতে হবে। ১৯৯৩ সালে সর্বপ্রথম জার্সিতে খেলোয়াড়ের নাম লেখা হয় এবং যেকোন নম্বর খেলোয়াড় নিতে পারবে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এই হল বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাস। তবে এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। তা হলো – ফুটবলের জনক কে? যদি বলি চীন তাহলে গ্রিক ও রোমানরা যে খেলাটি খেলত সেটিকে অস্বীকার করা হয়। তবে এখানে কথা হল চীনারা তো গ্রিক কিংবা রোমানদের দেখাদেখি ‘টু সু ছু পা’ খেলাটি শুরু করে নি। তাই চীনকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার যদি বলি ইংল্যান্ড আধুনিক ফুটবলের জনক তাহলেও ভুল বলা হতে পারে। কেননা ইংল্যান্ডের সেই শিক্ষক তো ইতালিতে দেখে এসে তারপর তার নিজের দেশে তা চালু করেছেন। ইতিহাস যাই হোক সারা বিশ্বের সকল বয়সের মানুষের কাছে ফুটবল তার নিজ মহিমায় জনপ্রিয়তা অর্জন করে নিয়েছে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.