কেমন ছিল রবীন্দ্র-নজরুলের রসায়ন?

আমাদের দেশে আমরা ভক্ত হতে গিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ি। এটা আমাদের বহুদিনের অভ্যাস। আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করলে ব্রাজিলের বিরোধীতা করতে হবে। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে থাকতে হলে নজরুলকে একহাত দেখিয়ে দিতে হবে।
ধর্মান্ধরা সব সময়ই ছিল, আছে এবং থাকবে। কিছু মানুষ আছেন যারা নিজে ধর্ম পালন করেন না অথচ অপর ধর্মাবলম্বীর সমালোচনা ও নিন্দা করেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে প্রগতিকে পিছিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা হয়েছে বারবার। সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব বাধিয়ে ইংরেজরা ভারতবর্ষ শোষণ করেছে প্রায় দু’শ বছর।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের ছিল গভীর সখ্য। গুরু-শিষ্য সম্পর্ক ছিল দৃঢ়। সেই সময় একটি চক্র তাঁদের দুজনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করত। যদিও তা সাফল্য পায়নি। আমরা ছোট সময় যখন স্কুলে পড়েছি তখনই শুনেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিংসা করতেন কাজী নজরুলকে। এই ডাহা মিথ্যা কথাটি পাকিস্তান সরকারও ব্যাপক প্রচার করেছিল তাদের ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী ছাত্র সংগঠন এনএসএফ কর্মীদের মাধ্যমে। আইয়ুব খানের শাসনামলে রবীন্দ্রনাথের রচনা যাতে কেউ না পড়ে এবং তাঁর প্রতি এদেশের বাঙালী মুসলমানদের মনে ঘৃণা জন্মানোর উদ্দেশ্যেই তা করা হয়।
কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে। দুজনের বয়সের ব্যবধান ৩৮ বছরের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয় ১৯১১-তে আর তিনি নোবেল পুরস্কার পান ১৯১৩ সালে। অর্থাৎ গীতাঞ্জলি যখন প্রকাশিত হয় তখন কাজী নজরুলের বয়স ১২ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন নোবেল পুরস্কার পান তখন কাজী নজরুল ইসলামের বয়স প্রায় ১৪ বছর।
নজরুল যেমন রবীন্দ্রনাথকে কবিগুরু বলে সম্মান করতেন রবীন্দ্রনাথও তেমনি তাঁর কবি প্রতিভাকে স্বীকৃতি জানাতে কুণ্ঠিত হননি। নজরুলের ‘ধূমকেতু'কে আশীর্বাদ জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/দুর্দিনের এই দুর্গাশিরে, উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন/অলক্ষণের তিলক রেখা/রাতের ভালে হোক না লেখা/জাগিয়ে দে রে চমক মেরে, আছে যারা অর্ধচেতন।’ ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আশীর্বাদটি প্রকাশিত হতো। নজরুল ইসলাম সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘লাঙল’-এর প্রচ্ছদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আশীর্বচন লেখেন : ‘ধর, হাল বলরাম, আন তব মরু-ভাঙা হল,/বল দাও, ফল দাও, স্তব্ধ হোক ব্যর্থ কোলাহল।’
কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্টদেবতাকে পূজা করে। ছেলেবেলা থেকে তার ছবি সামনে রেখে গন্ধ-ধূপ, ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল সন্ধ্যা বন্দনা করেছি। এ নিয়ে কত লোক ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছে।’ কথাশিল্পী মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায় একদিন নজরুলের এই ভক্তি-শ্রদ্ধার কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বললেন নজরুলের উপস্থিতিতেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেসে বলেছিলেন, যাক আমার আর ভয় নেই তাহলে। নজরুল সঙ্কোচে দূরে গিয়ে বসলেও রবীন্দ্রনাথ সস্নেহে তাকে কাছে ডেকে বসিয়েছেন। নজরুল নিজেই লিখেছেন, ‘তখন আমার মনে হতো আমার পূজা সার্থক হলো, আমি বর পেলাম।’
‘অনেক দিন তাঁর কাছে না গেলে নিজে ডেকে পাঠিয়েছেন। কতদিন তাঁর তপোবনে (শান্তিনিকেতন) গিয়ে থাকবার কথা বলেছেন। হতভাগা আমি তাঁর পায়ের তলায় বসে মন্ত্র গ্রহণের অবসর করে উঠতে পারলাম না। বনের মোষ তাড়িয়েই দিন গেল।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখা ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেন। নজরুল তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে কারারুদ্ধ। কবি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমে জেলখানায় বইখানি পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি উৎসর্গপত্রে নজরুলকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করে লেখেন, জাতির জীবনের বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি কবি নজরুলকে উৎসর্গ করছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছাকাছি যেসব কবি-সাহিত্যিক থাকতেন তাদের অনেকেই তখন অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন তাঁর প্রতি। এর জবাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়সহ উপস্থিতজনদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার বিশ্বাস তারা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করছে। আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ ও রসের সন্ধান করেনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছে মাত্র।... কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এও তোমাদের আবদার বটে। সমগ্র জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তাকে প্রকাশ করবে বৈকি। আমি যদি আজ তরুণ হতাম, তাহলে আমার কলমেও এই সুর বাজত।
দুখানা ‘বসন্ত’ দিয়ে একখানায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম দস্তখত করে দিয়ে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে বললেন, ‘তাকে (নজরুলকে) বলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমস্ত অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা যোগাবার কবিও তো চাই।’
এ কথা থেকে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে কবি স্বীকৃতি দিতে কত আন্তরিক উদার ও অকুণ্ঠ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে তার বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ডাকতেন ‘উদ্দাম’ বলে। নজরুল অনেকবার ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে কবিতা, গান ইত্যাদি শুনিয়েছেন এবং তাঁর কাছ থেকে প্রচুর উৎসাহ পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ চাইতেন না যে, নজরুল তাঁর কবি প্রতিভাকে যথার্থ সৃষ্টি কাজে না লাগিয়ে অন্য বিষয়ে নষ্ট করেন। এজন্য নজরুলকে তিনি একদিন (সঙ্গে ছিলেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর) তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচতে নিষেধ করেছিলেন। এই কথায় নজরুল ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আমার কৈফিয়ত কবিতায় তিনি লেখেন, ‘গুরু কন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচা।’ নজরুল পরে বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর তত্ত্বের কথা। নজরুল ইসলাম যৌবনে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। এ ছাড়া গীতাঞ্জলির সবগুলো কবিতা ও গান তাঁর মুখস্থ ছিল। এ কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবহিত হওয়ার পর খুবই খুশি হয়ে বলেছিলেন, আমারই তো মুখস্থ নেই। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, বিদ্রোহী, ভাঙ্গার গান পড়ে রবীন্দ্রনাথ অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন নজরুল ইসলামকে।
হুগলী জেলে কারারুদ্ধ নজরুল জেল কর্মকর্তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে অনশন শুরু করেন। একটানা ৩৯ দিন চলে অনশন। সমগ্র দেশবাসী উদ্বিগ্ন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে শুরু হয় মিটিং-মিছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সভাপতিত্বে ১৯২৩ সালের ২১ মে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে বিশাল জনসভা হয়। উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে অনশন ভঙ্গ করার জন্য টেলিগ্রাম পাঠান। টেলিগ্রামটি করা হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানায়। যেহেতু নজরুল তখন হুগলী জেলে তাই ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবেই ঠিকানা অস্পষ্ট লিখে টেলিগ্রামটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠিকানায় ফেরত পাঠান। নজরুল তাঁর বন্ধু কুমিল্লার বীরেন্দ্রকুমারের মা বিরজা সুন্দরী দেবীর হাতে লেবুর সরবত পান করে অনশন ভঙ্গ করেন।
১৯২৮ সালে নজরুল তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন ‘সঞ্চিতা’ রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন। বিভিন্ন রচনায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নানাবিধ উল্লেখ থাকলেও সম্পূর্ণ তাঁকে নিয়ে লেখা কবিতাগুলো হলো ‘নতুন চাঁদ’ গ্রন্থের ‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’ ও ‘কিশোর রবি’ এবং ‘শেষ সওগাত’ গ্রন্থের ‘রবিজন্মতিথি’।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুল ইসলামের আন্তরিক সম্পর্ক অটুট থাকুক এটা মৌলবাদী মুসলমানরা যেমন চাননি, তেমনি চাননি মৌলবাদী হিন্দুরাও। দুজনের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরানোর জন্য দুপক্ষ থেকেই নানা ধরনের সমালোচনা, আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র অবিরামভাবে চলে আসছিল। সাহিত্যের মর্মমূলে প্রবেশ করার যোগ্যতা বা অধিকার যারা রাখেন না, তারা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বিচার করেছেন ধর্ম দিয়ে। তারা বুঝতে পারেননি মানবিকতার সাধনাই করে গেছেন চিরকাল রবীন্দ্র-নজরুল। যে মহামানব হওয়ার সাধনা তাঁর চিরজীবনের, তাঁর পক্ষে যে কোন অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক হওয়া সম্ভব নয়, তা মূর্খদের যেমন বোঝানো সম্ভব নয়, তেমনই বোঝানো সম্ভব নয় জ্ঞানপাপীদেরও।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দুজনই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং সকল সংকীর্ণতার উর্ধে। রবীন্দ্র পরিবারে পৌত্তলিক কর্মকান্ডের সুযোগ না থাকলেও হিন্দু সংস্কৃতির আবহ অনেকটাই বিরাজমান ছিল। রবীন্দ্রনাথও পিতৃসূত্রে ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী হলেও হিন্দু সংস্কৃতির আধারে বেড়ে ওঠার পরও চিরকাল মানবধর্মের সাধনা করে গেছেন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.