২০২০ সালকে লক্ষ্য করে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে চীন
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সামরিক মহড়া ছবি- Pars Today
ক্ষমতার বৈশ্বিক ভারসাম্য দিন দিন জায়গা বদল করছে। বৈশ্বিক নেতৃত্বের জায়গা থেকে যুক্তরাষ্ট্র যখন নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইছে, ঠিক তখনই চীন তাঁর আন্তর্জাতিক প্রভাববলয় বিস্তৃত করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এতে পশ্চিমের অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের আশঙ্কা, চীনের ক্রমবর্ধমান এই প্রভাব এত দিন ধরে গড়ে ওঠা বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে উল্টেপাল্টে দিয়ে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। তাদের আশংকা যাই হোক চীন তার ক্রমবর্ধমান উন্নতি অব্যাহত রাখছে।
ইন্টারনেট সুবিধা
২০২০ সালের মধ্যে চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সব দরিদ্র গ্রামকে ইন্টারনেট সেবার আওতায় আনা হবে। এ লক্ষ্যে চীনের ১ লাখ ২৩ হাজার গ্রামে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেবে দেশটি সরকার। শহর ও গ্রামের মধ্যকার পার্থক্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এমন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার।
চীনের শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত পরিকল্পনা প্রতিবেদন মতে, চীনে নিবন্ধিত দরিদ্র গ্রামের সংখ্যা ১ লাখ ২২ হাজার ৯০০। এগুলোর ৯৮ শতাংশেরও বেশি এলাকায় ২০২০ সালের মধ্যে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়া হবে।
দেশটির গ্রামগুলোতে ব্রডব্যান্ড আর ৪জি ডাটা নেটওয়ার্ক এ দুই ধরনের ইন্টারনেট সেবা দিতেই কাজ করবে মন্ত্রণালয়। সেইসঙ্গে কম খরচে মানসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা দিতে এই এলাকাগুলোতে বিশেষ ছাড় দিতে টেলিকম অপারেটরদের উৎসাহ দেবে তারা।
চীনের একটি ইন্টারনেট ক্যাফে, ছবি- Gizmodo
চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত হিসাবে চীনে ১০৮ কোটি ৪জি নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারী রয়েছে। আর দেশের তিন বড় টেলিযোগাযোগ অপারেটর চায়না টেলিকম, চায়না ইউনিকম আর চায়না মোবাইলের ব্রডব্যান্ড গ্রাহকের সংখ্যা ৩৬ কোটি ৬০ লাখ।
আরো দু'টি নতুন স্যাটেলাইট
পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে মহাকাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করেছে চীনের দুইটি নতুন স্যাটেলাইট। একটি স্যাটেলাইট পৃথিবী পর্যবেক্ষণের জন্য এবং অপরটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
মহাকাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করেছে চীনের দুইটি নতুন স্যাটেলাইট, ছবি- Space.com
মহাকাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করা প্রথম স্যাটেলাইটটির নাম ‘গাওফেন-৬’। ‘লং মার্চ-২ডি’ নামক রকেটে করে স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ১৩ মিনিটে মহাকাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করে গাওফেন-৬। চীনের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত জিকুয়ান স্যাটেলাইট লঞ্চ সেন্টার থেকে রকেটটি উড্ডয়ন করা হয়। দেশটির কৃষি সম্পদের গবেষণা ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কাজ করবে এই স্যাটেলাইট।
অপরদিকে একই সময়ে লউজা-১ নামের আরেকটি স্যাটেলাইট পাঠানো হয় মহাকাশে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কাজ করবে এই স্যাটেলাইটটি। এই স্যাটেলাইট ও রকেটগুলো নির্মাণ করেছে চায়না এরোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি করপোরেশন। চীনের লং মার্চ রকেট সিরিজের এটি ২৭৬তম উতক্ষেপণ।
বুলেট ট্রেন
আগামী ১ জুলাই থেকে চীনে চালু হতে যাচ্ছে দীর্ঘ ফুক্সিং বুলেট ট্রেন। চায়না রেলওয়ে সাংহাই গ্রুপ গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতির মাধ্যমে এ ঘোষণা দেয়।
চীনে আগে থেকেও বুলেট ট্রেন থাকলেও এই বুলেট ট্রেন আগেরটি থেকে আকারে দ্বিগুণ। আগের বুলেট ট্রেনগুলোতে ৮টি করে বগি থাকলেও নতুন এই ফুক্সিং ট্রেনটিতে থাকছে মোট ১৬টি বগি। এটির দৈর্ঘ্য ৪১৫ মিটার। ট্রেনটি ঘন্টায় ৩৫০ কিলোমিটার বেগে একসাথে এক হাজার ১৯৩ জন যাত্রী পরিবহনে সক্ষম।
চীনের ফুক্সিং বুলেট ট্রেন, ছবি- China Plus
চীনে বিভিন্ন উৎসবে যখন রেলের ওপর চাপ পড়ে, তখন ৮টি বগির দুইটি বুলেট ট্রেন একসাথে সংযুক্ত করা হয়। তবে এতে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। যে কারণে চীন দীর্ঘ আকৃতির এই বুলেট ট্রেনটি নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়।
নতুন এই ফুক্সিং বুলেট ট্রেনের ফলে লোকমোটিভ দিয়ে আর দুইটি ট্রেন সংযুক্ত করা লাগবে না। পাশাপাশি একই সময়ে পরিবহণযোগ্য যাত্রীর ধারণ ক্ষমতাও বাড়বে বলে জানায় চীনের রেল সংস্থাটি।
সামরিক সক্ষমতা
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের চিন্তা-ভাবনাকে অতিক্রম করে চীনের সামরিক শক্তি দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের থিংকট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজস্ব সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে চীন।
বেইজিং সামরিক সরঞ্জামের আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে বেশি এগিয়েছে, বিশেষ করে নৌ ও বিমান বাহিনীর ক্ষেত্রে। আইআইএসএস’র ১৯৫৯ সালের বৈশ্বিক বিবেচনায় সামরিক দক্ষতা ও প্রতিরক্ষা ব্যয়ের মূল্যায়নকে কেন্দ্র করে বার্ষিক এই সামরিক ভারসাম্য বিবেচনা করা হয়েছে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে রোববার এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়, সম্প্রতি চীনের সামরিক সমৃদ্ধি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বলা যেতে পারে।
চীনের 'ডার্ক সোর্ড' প্রথম সিক্সথ জেনারেশন যুদ্ধ বিমান, ছবি- Sputnik
গত সপ্তাহের শেষ দিকে ২০১৮ সালের বার্ষিক সামরিক ভারসাম্য প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটিতে বিশ্বের সামরিক শক্তির উত্থানের গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, অতি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র (আলট্রা লং রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল) থেকে শুরু করে ৬ষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান- এসবের উদ্ভাবন চীনের অগ্রগতি এবং অসাধারণ প্রযুক্তিগত ক্ষমতারই প্রকাশ। গত বছর টাইপ-৫৫ ক্রুজার ছিল দেশটির সামরিক বহরে সংযোজিত সর্বশেষ যুদ্ধ জাহাজ- যা কিনা ন্যাটোভুক্ত যে কোনো নৌবাহিনীর জন্যই ভাবনার বিষয় হতে পারে।
এখন চীন কাজ করছে এমন একটি বিমানবাহী রণতরী নিয়ে, যা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যুগ্ম সামরিক সদর দফতর হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অস্ত্রশস্ত্র, বিমান প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে পদাতিক আক্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে তাতে, ঠিক যেমনটি যুক্তরাষ্ট্রেরও রয়েছে।
বর্তমানে বেশি আলোচনায় আছে চীনের ৬ষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। এতে রয়েছে ‘স্টেলথ প্রযুক্তি’, যার ফলে এটি শব্দের চেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন এবং এটি অতি সূক্ষ্ম বিমান প্রযুক্তি দিয়ে নির্মিত।
স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র অনেক বেশি এগিয়ে থাকলেও চীন এখন সে অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বলেই ইঙ্গিত দিয়েছে আইআইএসএস’র বিশ্লেষণ। আইআইএসএস’র প্রধান ড. জন চিপম্যান বলেন, ২০২০ সাল পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে চীন এই ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়ন ঘটিয়ে যাচ্ছে। তবে আধুনিকায়নের হিসেবে পিছিয়ে আছে চীনের পদাতিক বাহিনী। সেখানেও থেমে নেই চীন। ২০২০ সাল পর্যন্ত উন্নয়নের একটি লক্ষ্যমাত্রা ধরে তারা ‘যান্ত্রিক’ ও ‘তথ্যগত’ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, যার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে চীন। ছবি- CBC
চীন এসব সমরাস্ত্রের উন্নতি করে যাচ্ছে স্পষ্টতই একটি কৌশলকে সামনে রেখেই। সমরবিদ্যার ভাষায় একে বলা যায় ‘এন্টি এক্সেস এরিয়া ডিনায়াল’। এতে চীনের লক্ষ্য মার্কিন বাহিনীকে যতটা সম্ভব তার ভূমি থেকে দূরে রাখা। সেই কৌশলকে মাথায় রেখে দূরপাল্লার বিমান হামলা ও নৌবাহিনীর সক্ষমতা বাড়িয়ে যাচ্ছে চীন, যা কিনা মার্কিন রণতরীকে প্রশান্ত মহাসাগরের দূরবর্তী স্থানেই প্রতিহত করতে পারে।
অস্ত্র রফতানি
চীন কেবল সমরাস্ত্রের উন্নতি ঘটিয়েই প্রবল পরাশক্তি হচ্ছে না। অস্ত্র রফতানির বাজারেও চীনের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা তাৎপর্যপূর্ণ। মনুষ্যবিহীন যুদ্ধবিমান (ড্রোন) দেশটির বাজার দখল করেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র সবার আগে একে বিশ্বে পরিচিত করে তোলে। যুক্তরাষ্ট্র এসব মনুষ্যবিহীন যুদ্ধবিমান বিক্রিতেও যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্সের মতো মিত্রদের বেছে নেয়। চীনের এমন কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। দেশটির তৈরি সশস্ত্র মনুষ্যবিহীন যুদ্ধবিমান কিনেছে মিসর, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিয়ানমার।
অস্ত্র বাণিজ্যের দিক থেকে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে উদীয়মান হুমকি। বিশ্লেষকদের মতে, চীন যেসব অস্ত্র বিক্রি করে সেগুলো পশ্চিমা অস্ত্রের অন্তত ৭৫ ভাগ সক্ষমতা সম্পন্ন, দামও প্রায় অর্ধেক। স্থলযুদ্ধের সমরাস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে অবশ্য চীন এখনও কিছুটা পিছিয়ে। তাদের এখনও রাশিয়া বা ইউক্রেনের অস্ত্রের ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে।
আইআইএসএস’র বিশ্লেষকদের মতে, চীন এখন আফ্রিকার কিছু দেশের কথা মাথায় রেখে ট্যাংক তৈরি করছে। যেখানে রাস্তাঘাট খুব উন্নত নয়- সেসব দেশের জন্য হালকা ওজনের ট্যাঙ্ক বানানোর চেষ্টা চলছে। চীনের অত্যাধুনিক অস্ত্র উদ্ভাবন কেবল তাদের প্রতিবেশীদেরই নয়, অন্য অনেক দেশকেই এখন চিন্তায় ফেলছে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.