ঐতিহাসিক ৭ জুন এবং ভুলে যাওয়া সংগ্রাম
সাতই জুন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দিন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম এ দিনটি সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। জানবার কথাও নয়। তরুণদের তো আর দেশের ইতিহাস পড়ানো হয় না। যা পড়ানো হচ্ছে তা খণ্ডিত চিত্র, যা ঘটেছে তার বর্ণনা ও প্রতিক্রিয়া নয়।
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে যে প্রজন্ম জড়িত সে প্রজন্মের প্রত্যেকের কাছেই ৭ জুন পরিচিত তারিখ। সমর্থন অথবা বিরোধিতা, প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষদর্শী বিভিন্নভাবে এ প্রজন্মের সঙ্গে এ দিনটির পরিচয় ঘটেছিল। আজ সে প্রজন্মও হয়তো তা ভুলতে বসেছে। কারণ ব্যক্তিবন্দনা যখন পূজার পর্যায়ে চলে যায়, ব্যক্তিকে যখন দেবতার আসনে বসানো হয়, তখন বন্দনা বড় হয়ে দেখা দেয়। বাস্তবতা ঢাকা পড়ে যায় বন্দনার ছাইয়ের আড়ালে।
পাকিস্তানি শাসন-শোষণ ও নির্যাতনের শিকার বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন-সংগ্রামই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। ৬ দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র সমাজের ৫ দফা দাবি যুক্ত হয়ে ১১ দফা দাবিতে পরিণত হয় এবং এই ১১ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ৬৯ এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। গণঅভ্যুন্থানের পথ ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং মহান মুক্তিযু্দ্ধে বিজয় সূচিত হয়।
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে যেমন ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণ ব্রিটিশ শোষকদের এদেশ থেকে তাড়াতে ঐক্যমত্য হয়েছিল, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৬৬ সালে ঘোষিত ৬ দফাকে তৎকালীন পূর্ববাংলার জনগণ পাকিস্তানিদের এদেশ থেকে তাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ৬-দফার প্রতিটি দফা বাংলার আনাচে-কানাচে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাংলার জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এ ৬ দফা দ্রুত বাঙালির মুক্তির সনদে পরিণত হয়।
ছয় দফার প্রেক্ষাপটঃ
যে প্রেক্ষাপটে ৭ জুন সৃষ্টি হয়েছিল তার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ভৌগোলিক কাঠামোর মধ্যে ঔপনিবেশিক শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত পূর্ব পাকিস্তানিরা তাদের করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু বন্ধনমুক্তির পথটা পরিষ্কার ছিল না। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে মুক্তির পথ বাতলেছিলেন।
কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানিদের অসহায়ত্ব প্রকট আকার ধারণ করে ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময়। যুদ্ধ যে ক’দিন স্থায়ী হয়েছিল, ততদিন পূর্ব পাকিস্তানিরা ভাগ্য অথবা ভারতীয় করুণার ওপর নির্ভরশীল ছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তান নিয়েই ব্যস্ত ছিল।
এ কারণেই বলা হতো পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তাই পূর্ব পাকিস্তানকে নিরাপদে রাখবে। যেমনটা আজকাল বলা হয়- ভারতের সমৃদ্ধিই বাংলাদেশের সমৃদ্ধিকে নিশ্চিত করবে। অথচ আমরা খুব সহজেই ভুলে যাই যে, দুটি বক্তব্যই পরাধীন পূর্ব পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মর্যাদাবিরোধী।
পাক-ভারত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের রাজনীতিকরা পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি উপলব্ধি করলেও কেমন করে বিষয়টির অবতারণা করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কিন্তু পূর্ব প্রস্তুতির আলোকেই শেখ মুজিব ছয় দফা কর্মসূচিকে জনগণের কাছে পেশ করেছিলেন।
পাক-ভারত যুদ্ধের পর আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। তার ব্যর্থতার পরই শেখ মুজিব ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, দলের পূর্ব অনুমতি ছাড়াই। পুস্তিকা আকারে প্রথম যে ছয় দফা প্রকাশিত হয়েছিল তার ছোট্ট ভূমিকা ছিল : ‘ভারতের সাথে বিগত সতেরো দিনের যুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণে রেখে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো সম্পর্কে আজ নতুনভাবে চিন্তা করে দেখা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে শাসনকার্য নির্বাহের ক্ষেত্রে বাস্তব যেসব অসুবিধা দেখা দিয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই প্রশ্নটির কথা আজ অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জাতীয় সংহতি অটুট রাখার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রগাঢ় আন্তরিকতা ও দৃঢ় সংকল্পই দেশকে এই অস্বাভাবিক জরুরি অবস্থাতেও চরম বিশৃঙ্খলার হাত থেকে রক্ষা করেছে।’ এই কথার সূত্র ধরে দুটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন- বিরাজমান শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর জনউপযোগিতা এবং দেশ সম্পর্কে জনগণের মনোভাব।
ছয় দফার হেতু কী?
ছয় দফার কারণ কী ছিল বা এটা কেন দরকার ছিল এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে সুন্দর বলেছেন তাজউদ্দিন আহমদ। ছয় দফা সংবলিত একটি পুস্তিকার অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ ভূমিকায় পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘একটি রাষ্ট্রের উন্নতি, অগ্রগতি, সংহতি ও নিরাপত্তা নির্ভর করে উহার অভ্যন্তরীণ শক্তির উপর। সেই শক্তির উৎস সন্তুষ্ট জনচিত্ত। আঠারো বছর পূর্বে পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র্ররূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আজও উহার রাষ্ট্রীয় কাঠামো গণসমর্থনের মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড়াইতে পারে নাই।
পাকিস্তানের মূল ভিত্তি ১৯০০ সালের যে লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তান অর্জনের সংগ্রামে মানুষকে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করিয়া তুলিয়াছিল পরবর্তীকালে ঐ মূল ভিত্তি হইতে বিচ্যুতিই এই অবস্থার আসল কারণ। এই বিচ্যুতি ঘটাইবার মূলে ছিল একটি কায়েমী স্বার্থবাদী শোষক দলের স্বার্থান্বেষী কারসাজি।
ইহারা ইসলাম ও মুসলিমের নামে সারা পাকিস্তানের গোটা সমাজকে শোষণ করিয়া নিঃশেষ করিতেছে, অপরদিকে পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সুযোগ গ্রহণ করিয়া এই বিশেষ মহলেই পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের নামে অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাহাড় গড়িয়া পূর্ব পাকিস্তানে অবাধ শোষণ চালাইয়া যাইতেছে। ফলে একদিকে পূর্ব পাকিস্তানি জনসাধারণ সর্বহারায় পরিণত হইতেছে, অপরদিকে জুলুমের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতিবাদ সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝি ও তিক্ততার সৃষ্টি হইতেছে।’ এখানেও সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি : জনসন্তুষ্টি, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও নির্যাতন।
তাজউদ্দীন আহমদের নামে প্রচারিত এই পুস্তিকা প্রচারের কিছুদিনের মধ্যেই প্রকাশিত হয় ছয়-দফা কর্মসূচি সম্পর্কে শেখ মুজিবের পরিপূর্ণ ব্যাখা সংবলিত ‘আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা কর্মসূচি’ নামক আরেকটি পুস্তিকা। এই পুস্তিকার প্রচার এত বেশি হয়েছিল যে তা পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ঘরে ঘরে পৌঁছেছিল। ছয় দফা কর্মসূচি প্রচারিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালের প্রথম দিকে- যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা জারি থাকার সময়। সরকার চেয়েছিল জরুরি অবস্থা বহাল রেখে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে।
কিন্তু ছয় দফা কর্মসূচি সেই নিয়ন্ত্রণকে উপেক্ষা করে। ছয় দফা পরিণত হয় এক জনপ্রিয় কর্মসূচিতে। ছয় দফা কর্মসূচি রাজনীতিকদের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেনি। কিন্তু শেখ মুজিব তার লক্ষ্যে অচল থাকেন। এই কর্মসূচির কারণে আওয়ামী লীগকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়- অবশ্য আজকের মতো গুম, খুন, ক্রসফায়ার এবং নির্বিচার গুলির সম্মুখীন হতে হয়নি।
ছয় দফার জন্য সংগ্রামঃ
আওয়ামী লীগ ১৯৬৬ সালের ৭ জুন এককভাবে ছয় দফা দাবিতে হরতাল আহ্বান করেছিল। ছয় দফা ছাড়াও এই হরতাল আহ্বানে আওয়ামী লীগ তাদের প্রচারপত্র ও পোস্টারে তখনকার অন্যান্য জনপ্রিয় দাবি ও স্লোগানের উল্লেখ করেছিল। পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে সেদিন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানে বহু লোককে প্রাণ দিতে হয়েছিল। এই হরতালের মধ্য দিয়েই ছয় দফার প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সমর্থন প্রমাণিত হয়।
কিন্তু এই হরতালে কারা প্রাণ দিয়েছিলেন? প্রাণ দিয়েছিলেন সমাজের নিুবর্গের মানুষরা। তাদের স্বপ্ন ছিল এ আন্দোলন তাদের জীবনকে বদলে দেবে, তারা বৈষম্যের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবেন।
হরতালের দিনে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় পুলিশের গুলিতে প্রথম মৃত্যুবরণ করেন মনু মিয়া। এই মৃত্যু অন্যত্র আরও মৃত্যুকে উজ্জীবিত করে। গুলিতে আরও প্রায় ১১ জন নিহত হন। এখানে বিবেচ্য হরতালের তীব্রতা নয়- বিবেচ্য শ্রমিক-জনতার আত্মত্যাগ। এরা কেউই দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না, কিন্তু একটি দলীয় কর্মসূচির কারণে প্রাণ দিয়েছেন। সে কর্মসূচি এমনভাবে তাদের উদ্দীপ্ত করেছিল যে, তারা নিজের জীবনের অবস্থার সঙ্গে তাকে মেলাতে পেরেছিলেন।
ছয় দফা কর্মসূচির মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল মানুষের অধিকারহীনতা, অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও বৈষম্যের কথা। কর্মসূচিতে যাই থাক না কেন, এভাবেই তা জনগণের কাছে পৌঁছেছিল। সাধারণ মানুষ হয়তো এভাবেই প্রাণ দেয়। যেমন দিয়েছিলেন নূর হোসেন, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়। নূর হোসেন এটা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছিলেন স্বৈরাচার নিপাত গেলে, গণতন্ত্র মুক্তি পেলে জীবনে শান্তি আসবে- হয়তো কর্ম ও খাদ্যের নিশ্চয়তাও আসবে। নূর হোসেনের আত্মত্যাগ এরশাদের পদচ্যুতির সহায়ক হয়েছে, কিন্তু স্বৈরাচারের অবসান হয়নি, গণতন্ত্রও মুক্তি পায়নি।
পাকিস্তান আমলেও শুধু মনু মিয়া নয়, প্রতিটি আন্দোলনে প্রত্যেক আত্মত্যাগের পেছনের কারণগুলো ছিল অভিন্ন। আমরা বলি ১৯৫২ সালে শুরু হওয়া প্রতিটি আন্দোলন থেকে শেষ পর্যন্ত যত আন্দোলন হয়েছে তার পরিণতি ঘটেছে স্বাধীনতা আন্দোলনে। ছয় দফা আন্দোলন সেক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল সংযোজন।
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিগত ছেচল্লিশ বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, স্বাধীনতার জন্য প্রতিটি আন্দোলনের যে লক্ষ্য ছিল তার কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি। যারা বাস্তবায়িত করতে পারতেন তারা করেননি। যে আওয়ামী লীগ এসব আন্দোলনের ঐতিহ্যকে ধারণ করে দেশ পরিচালনা করতে পারত, তারা সে পথে যায়নি। কেন যায়নি সে প্রশ্নের জবাব তারা দিতে পারবেন।
সময়ের বিবর্তনে মানুষের জীবন ও উপলব্ধিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু কিছু সার্বজনীন বিষয় আছে যেগুলো পরিবর্তন হয় না। হয় না বলেই ভেনিজুলেয়ার মতো বাম ধারায় পরিচালিত রাষ্ট্রেও মানুষ তার অধিকারের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে।
জনগণের বিরোধী পক্ষ যখন ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে তখন এসব অভিযোগ অর্থহীন হয়ে যায়। আর এ কারণেই কেউ পেছনে ফিরে তাকাতে চায় না, স্মরণে আনতে চায় না সাতই জুনের আত্মত্যাগকে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.