সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এখন ইরান- ইসরাঈল যুদ্ধে পরিণত হচ্ছে
সিরিয়ায় আসাদ বাহিনীর বোমা হামলা, ছবি- The Express Tribune
সিরিয়ার যুদ্ধ নতুনভাবে মোড় নিচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে বলে মনে হলেও সিরিয়ায় যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রাশিয়া ও ইসরাঈলের মধ্যেকার মিত্রতা প্রভাব ফেলছে ইরান-রাশিয়া সম্পর্কে। সম্প্রতি রাশিয়া ইসরাইল সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে সিরিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশের সেনা না থাকার যে ঘোষণা দিয়েছে, তা মানবে না ইরান। মঙ্গলবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সম্পর্কিত বক্তব্যের পর বুধবার এক প্রতিক্রিয়া ইরানের এ অবস্থানের কথা তুলে ধরেছেন দেশটির ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল কাসেম আলী নেজাদ।
দামেস্ক সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে যত দিন প্রয়োজন তত দিন পর্যন্ত ইরানের সামরিক উপদেষ্টারা সিরিয়ায় অবস্থান করবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। জেনারেল আলী নেজাদ ইরানের সংবাদ সংস্থা ইরনাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সিরিয়ায় ইরানের সামরিক উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে দেয়া সহযোগিতার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, সিরিয়ায় যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেশটিতে ইরানের সামরিক উপদেষ্টাদের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা অনেক গভীর এবং এটি অব্যাহত রাখতে হবে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ, ছবি- Pars Today
এর আগে মঙ্গলবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ সাংবাদিকদের সামনে জানিয়েছিলেন, সিরিয়া-ইসরাইল সীমান্ত থেকে সিরিয়া ছাড়া অন্য দেশের সেনা সরিয়ে নিতে হবে। তিনি বলেছিলেন, শুধুমাত্র সিরিয়ার বাহিনীই ইসরাইল ও জর্দানের সীমান্ত এলাকায় উপস্থিত হওয়া উচিত, কারণ দক্ষিণ সিরিয়ায় বিদ্রোহীরা সরকারি সেনাদের দ্বারা সম্ভাব্য আক্রমণের জন্য প্রস্তুত। সাম্প্রতিক সময়ে, সিরিয়ার সরকার বিদ্রোহীদের দখলে রাখা এলাকা দিরায় যোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ করার জন্য বিমান দিয়ে সতর্কতা লিফলেট বিতরণ করেছে। অন্যদিকে রাশিয়ার বহুদিনের মিত্র ইসরাঈল রাশিয়াকে জানিয়েছে, সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদের প্রধান সহযোগী ইরান সিরিয়াতে একটি স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি সহ্য করবে না। তার সূত্র ধরে সিরিয়া যুদ্ধের মিত্রপক্ষ ইরান-রাশিয়ার সম্পর্কে চিড় ধরতে
শুরুতে সম্পর্কটি এটি ছিল অনেক সরল। ২০১৬ সালের অগাস্টে আসাদ সরকার সমস্যায় পড়লে মিত্ররা এগিয়ে এসেছিলো। মস্কো পাশে দাড়িয়েছিল তার সামরিক বিমান বাহিনী দিয়ে। আর ইরান এবং তার আর কিছু সশস্ত্র মিত্র - যাদের মধ্যে লেবাননের হেজবুল্লাহও রয়েছে - আসাদ সরকারকে সম্মুখ সমরে শক্তি যুগিয়েছে। সিরিয়ায় ইরান এবং রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল অঞ্চলটিতে সংহতি ফিরিয়ে আনা। রাশিয়া শীতল যুদ্ধের সময়ের মতো আবারও কিছু দীর্ঘমেয়াদী মিত্রের সন্ধানে ছিল।
একই সাথে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে আইএস গোষ্ঠী রাশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে এমন ভয়ও ছিল। সিরিয়ায় রাশিয়ায় একটি ছোট নৌঘাঁটিও রয়েছে - যার কলেবর আরও বাড়ানো হচ্ছে। ভূ-কৌশলগত বিবেচনায় রাশিয়া এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব আবারও ফিরে পেতে চায়, যা কিনা এখন ওয়াশিংটনের হাতে।
সম্প্রতি নেতানিয়াহু ও পুতিনের বৈঠক সিরিয়া যুদ্ধকে নতুন মাত্রা দিয়েছে, ছবি- Israel National News
ইরানেরও প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী মিত্র এবং তাদেরও ছিল ভূ-কৌশলগত হিসেব-নিকেশ। বিধ্বস্ত সিরিয়া ইসরায়েলের জন্যে খুব বেশী মাথাব্যাথার কারণ ছিল না। কিন্তু তার পাশে থাকা ইরান - যাদের পারমাণবিক বোমা তৈরির মতো সম্ভাবনা এবং ক্রমবিকাশমান সেনাবাহিনী রয়েছে, তাকে দীর্ঘমেয়াদে হুমকি হিসেবেই নিয়েছে ইসরায়েল। রাশিয়া এমন পরিকল্পনা করতে চায় যাতে করে ইরানের সমর্থনপুষ্ট বাহিনী যেন ইসরায়েলী সীমান্তের কাছাকাছি না থাকে। তাতে রাশিয়ার দুই মিত্রের সাথেই সম্পর্ক ঠিক থাকে।
কিন্তু সিরিয়ায় যদি আসাদ সরকার স্থিতিশীল হয় এবং সেখানে ভিন্নভাবে ইরানী বাহিনীই প্রতিষ্ঠা পায়, সেক্ষেত্রে ইসরায়েলের সীমান্তের জন্যে তা মোটেই সুখকর নয়। এই নিয়ে ইসরাঈল ও রাশিয়া যুগপৎভাবেই উদ্বিগ্ন।
ইরান এখন ইরাকে তাদের প্রভাব বাড়াতে যাচ্ছে। অন্যদিকে, আসাদ সরকার যেভাবে আবারও নিজের দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছে, তাতে করে ইরানকে দেশটির মধ্য দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাবার জন্যে হয়তো করিডর দিতে পারে। আর এটা সহায়ক হবে হেজবুল্লাহর জন্যে।
বর্তমানে ওই অঞ্চলে ইরানের বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম যায় আকাশপথে, যা কিনা যেকোন সময় বাধাগ্রস্থ হতে পারে বলে তেহরানের ধারনা। এদিকে আসাদ সরকার ধীরে ধীরে বিজয় অর্জন করতে শুরু করেছে। দেশটির বাহিনী গড়ে উঠেছে অনেকটাই ইরানী ধাঁচে, যেখানে রয়েছে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ, শিয়া মিলিশিয়া থেকে শুরু করে আছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের গোষ্ঠীও।
ক্রমবর্ধমান ইরান-ইসরাঈল উত্তেজনায় রাশিয়া আর ইসরায়েলের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সপ্তাহেই মস্কোতে সেদেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন ইসরায়েলী প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাভেগডর লিবারম্যান। আর এসবই ইঙ্গিত দেয় যে ইরানী স্থাপনায় ইসরায়েলী হামলা রাশিয়াকে উদ্বিগ্ন করেছে। কেননা রুশদের আশঙ্কা হলো, যদি এই অস্থিরতা চলতে থাকে তবে তা আসাদ সরকারের ক্ষমতায় থাকার জন্যে হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
এখন রাশিয়া এমন পরিকল্পনা করতে চায় যাতে করে ইরানের সমর্থনপুষ্ট বাহিনী যেন ইসরায়েলী সীমান্তে কাছাকাছি না থাকে। স্বল্পমেয়াদে এর অর্থ এই দাড়ায় যে দক্ষিণ গোলান অঞ্চলে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর কোনো তৎপরতায় ইরানী সমর্থনপুষ্ট বাহিনী থাকছে না।
তবে এটি কেবল একটি সাময়িক ব্যবস্থা হতে পারে। ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানী বাহিনীর স্থায়ী অপসারণ দাবি করতে পারে। আর ইরানের ক্ষেত্রেও নিজের স্বার্থে এটি মেনে নেয়া অসম্ভব হবে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সিরিয়া থেকে সব বিদেশী বাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। কিছুদিন আগে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভও বলেছিলেন যে দক্ষিণ অংশে শুধু সিরিয়ান বাহিনীই থাকবে। মি. পুতিনের আহ্বান ওই কথারই যেন প্রতিধ্বনি।
রাশিয়া এখানে ইরান এবং ইসরাঈল উভয়ের মিত্র হলেও উত্তম মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যর্থ হচ্ছে। ইরানের পক্ষে যেমন ইসরাঈলের দাবী মেনে নেয়া অসম্ভব তেমনি ইসরাঈলের পক্ষে ইরানের অবস্থান মেনে নেয়া নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। ইতিমধ্যে একচোট আক্রমণ উভয়ের মধ্যেই হয়ে গিয়েছে। রাশিয়া এখানে ছিল একেবারেই নিশ্চুপ। তাই ধারণা করা হচ্ছে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এখন ইরান-ইসরাঈল যুদ্ধে রূপান্তরিত হতে পারে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.