যে নিষিদ্ধ গ্রন্থগুলো বাঁচিয়ে রেখেছে কবি নজরুলকে
আজ ১১ জৈষ্ঠ্য। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৯ তম জন্মবার্ষিকী। মাত্র একুশ বছর বয়সে ধমকেতুর মতই কবি নজরুল বাংলার কাব্য আকাশে দেখা দিয়ে আবার হঠাৎ করেই যেন মিলিয়ে গেলেন। কিন্তু তিনি তাঁর জীবনের এই অল্প সময়েই বাংলার কাব্যমোদিদের জন্য রেখে যান বিষে ভরা চির বিদ্রোহের বাণী। সেই বিষের বাঁশির সুরে অর্ধচেতন, দিকহারা স্বাধীনচেতা স্বপ্নিল মানুষগুলো যেন এক নতুন মন্ত্রের ছোয়ায় বিদ্রোহী সাজে উজ্জিবিত হয়ে উঠেছিল। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে বিদ্রোহী পোষাকে সেই উত্তাল দিনে নজরুলের এই আবর্তন ছিল নিঃসন্দেহে এক সময়ের দাবী।
একদিকে গোটা ভারত বর্ষে শুরু হয়েছিল গান্ধীজীর নেতৃত্বে বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন,বেঙ্গল প্যাক্ট, সাইমন কমিশন,নেহরু রিপোর্ট আবার পাশাপাশি পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে রুশ বিপ্লব, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় বিপর্যয়। সব মিলিয়ে গোটা পৃথিবীতে যেন চলছিল এক নিদারুন মানবিক অস্থিরতার লড়াই। সীমাহিন অস্থিরতার সেই ধূসর দিনগুলোতে এক উত্তাল বিস্ফোরণ এর মতই আগুন হাতে নিয়ে ঝড়ো হাওয়ার মত আবির্ভাব ঘটেছিল এক নতুন কবির। সেটা ছিল ১৯২১ সাল।
দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে শেষ পর্যন্ত স্কুল শেষ না করেই ১৯১৭ সালে নজরুল নাম লেখান ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে। শুরু হয় নজরুলের সৈনিক জীবনে আরেক নতুন অধ্যায়। পরাধীনতা , ভারতবর্ষে উপর জেকে বসে থাকা বৃটিশ ভুত আর সাম্যবাদী চিন্তার শক্ত আঘাত আসে সৈনিক নজরুলের মনন আর চেতনায়। একদিন সৈনিক জীবনের পাতা মুড়িয়ে বিদ্রোহী নজরুল চলে এলেন কলকাতায়। মোসলেম ভারত এবং বিজলীতে একযোগে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম অগ্নিঝরা কবিতা ’বিদ্রোহী’।
’মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হবো শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ
ভীম রণভুমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত।’
বলার অপেক্ষা রাখে না যে সেদিনের এই ’বিদ্রোহী’ কবিতাটি বারুদের মত ছড়িয়ে পড়ল বাংলার সবখানে। নারী-পুরুষ, জোয়ান-বৃদ্ধ,শিশু-কিশোর সবার মুখে তখন শুধু একই জপমালা, ” বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হবো শান্ত”। বিদ্রোহের একি মন্ত্র শোনালেন নজরুল? স্বাভাবিক ভাবেই বৃটিশ রাজের লাল ইটের শক্ত দেওয়ালেও এই মন্ত্র বার বার ধাক্কা খেতে লাগল। সচকিত হয়ে উঠলো রাজশক্তি। রক্তচক্ষু সরকারী আমলাদের রোষ নেমে এলো নজরুলের উপর। শুরু হলো কবি নজরুল এবং তাঁর সৃষ্টির উপর উপর সরকারি গোয়েন্দাগিরী। যার ফলে নজরুলের পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ সরকারি রোষানলের শিকার হয়েছিল। এর প্রথম শিকার হয় কাব্যগ্রন্থ ’ যুগবাণী’ । ১৯২২ সালে বাংলা ফৌজদারী বিধির ৯৯-এ ধারা অনুসারে সরকার নজুুরুলের ’যুগবাণী’ বইটি নিষিদ্ধ ঘোষনা করে দেয়।
’যুগবাণী’ নিষিদ্ধ হওয়ার বছর দুয়েকের ভেতরই ১৯২৪ সালের ২২ অক্টোবর নিষিদ্ধ হয় নজরুলের কবিতার বই ’বিষের বাঁশি’ । তবে নিষিদ্ধ করেও বইটির প্রচার বন্ধ করে রাখতে পারেনি সরকার। মজার কথা হল বইটি উপরের মলাট ছাড়াই কলকাতার বিভিন্ন প্রেস থেকে ছাপা হতে থাকে। এতে বিপাকে পরে যায় বৃটিশদের পোষ্য তৎকালিন ভারতের গোয়েন্দা বিভাগ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে নজরুল গ্রন্থ যতই সরকারি রোষানলে পরতে শুরু করলো ততই যেন বাঙালি তরুনদের এই নিষিদ্ধ কবিতার বই পড়ার প্রতি উৎসাহ আরো প্রচন্ড ভাবে বেড়ে যেতে লাগল। সবার পকেটেই তখন মলাট বিহীন ’বিষের বাশি’।
’বিষের বাশি’ নিষিদ্ধ হওয়ার কিছুদিন পরই নিষিদ্ধ হয় ’ ভাঙার গান’। বইটি বাজায়াপ্ত হয় ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর। এই বইটিতে সরকার বিরোধী মসলার গন্ধ পায় বৃটিশ গোয়েন্দা বাহিনী। ১৯৩০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে নিষিদ্ধ হয় ’ প্রলয় শিখা’। এই কাব্যগ্রন্থটিও ফৌজদারী বিধির ৯৯এ ধারায় সরকার বিরোধী বিভিন্ন রকম উসকানি মুলক রসদ পাওয়ার অভযোগ পাওয়া যায়। তবে এই প্রথম বারের মত শুধুমাত্র বইটি বাজেয়াপ্ত করেই থেমে থাকেনি সরকার, এই পুস্তকের মুদ্রন এবং প্রকাশনার অপরাধে কবি নজরুল ইসলাম কে ছয় মাসের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয় এবং কবি গ্রেপ্তার হোন।
কবি রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন এবং গান্ধী –আরউইন চুক্তির পরপরই কবি এর থেকে মুক্তি পান। নজরুল কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও বইটির উপর বাজেয়াপ্ত আদেশ ঠিকই থেকে যায়। ১৯৩১ সালে নিষিদ্ধ হয় কবি নজরুল ইসলামের ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপে আর শ্ল্যাষেপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ ’চন্দ্রবিন্দু’। ’চন্দ্রবিন্দু’ থেকে কিছুটা অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরছি।
’ মসজিদ পানে ছুটিলেন মিঞা মন্দির পানে হিন্দু,
আকাশে উঠিল চির জিজ্ঞাসা করুন চন্দ্রবিন্দু”।
অথবা
আমার সুখের গৃহ শ্মশান করে
বেড়াস মা তায় আগুন জ্বালি’
’চন্দ্রবিন্দু' কাব্যগ্রন্থটি ছিল দেশাত্ববোধক তীব্র ব্যাঙ্গ বিদ্রুপে ভরা একটি কাব্যগ্রন্থ। বিশেষ করে বৃটিশদের পা চাটা দেশি সাহেবদের নিয়ে কৌতুক বিদ্রুপে মেশানো এই কাব্যগ্রন্থটি সেই সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ’চন্দ্রবিন্দুর’ প্রতিটি কবিতায় ব্যাঙ্গ আর বিদ্রুপের ভাষায় স্থান পায় লীগ অব নেশন, রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স, সাইমন কমিশন রিপোর্ট, প্রাথমিক শিক্ষার বিল ইত্যাদি বিষয়সমুহ। তবে চন্দ্রবিন্দুর উপর সরকারের রক্ত চোখ খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারে নি। ইংরেজ শাষন আমলেই বইটির উপর থেকে বাজেয়াপ্তের নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।
দেখা যায় নজরুলের মোট পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ এর আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেয়াপ্ত ঘোষনা করা হলেও পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েকটি কাব্য গ্রন্থের উপর সরকারি আক্রোশ ছিল। সেই গ্রন্থগুলো হল অগ্নিবিণা,সঞ্চিতা,ফণিমনসা,সর্বহারা, রুদ্রমঙ্গল। বলাইবাহুল্য সরকারের হাজারো আন্তরিক চেষ্টা থাকা সত্বেও বিভিন্ন কারনেই এই গ্রন্থগুলো অল্পের জন্য বাজেয়াপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যায়।
উল্লেখ্য যে দুটো কাব্য গ্রন্থের জন্য নজরুল ইসলাম কে কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছিল। ’প্রলয় শিখা’ কাব্যে বৃটিশ বিরোধী উস্কানিমুলক কবিতার জন্য ছয় মাসের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হোন কবি। দ্বিতীয়বার কবি দন্ডিত হোন তাঁর সম্পাদিত ধুমকেতুতে(১৯২২, ২৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যা) প্রকাশিত ’আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটির জন্য। কবিতাটি ছাপার জন্য কবিকে ভারতীয় দন্ডবিধির ১২৪-এ ধারা অনুসারে এক বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। কারাদন্ডের সময় নজরুল কে প্রথম প্রেসিডেন্সী জেলে নিয়ে যাওয়া হয় তারপর কারাদন্ডের পর তাকে আলিপুর জেলে দীর্ঘদিন আটক রাখা হয়।
ভারতের আলীপুর জেল, যেখানে বন্দি ছিলেন প্রিয় কবি।
এই জেলে থাকাকালীন সময়েই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ’বসন্ত ’ নাটকটি নজরুল কে উৎসর্গ করেন। আলিপুর জেল থেকে কবিকে যখন হুগলির জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তখন তিনি জেলের বিভিন্নরকম বৈষম্যমুলক অবিচার আর উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ অনির্দিষ্ট কালের জন্য অনশন শুরু করেন। স্বাভাবিক ভাবেই অনশনে কবির শারিরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। সারা দেশের মানুষ কবির এই শারিরিক বিপর্যয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পরে। শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে বাংলার সর্বত্রই নজরুলকে বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়ার জন্য সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষেভে ফেটে পরেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেন্ট্রাল জেলে কবি কে অনশন ভাঙ্গার অনুরোধ জানিয়ে জরুরী তার পাঠান, ” গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক, আওয়ার লিটারেচার ক্লেইমস ইউ।” শেষ পর্যন্ত কবির মাতৃস্থানীয়া বিরজাসুন্দরীর অনুরোধে ৩৯ দিন অনশন থাকার পর ২২ শে মে ১৯২৩ সালে নজরুল তাঁর অনশন ভঙ্গ করেন। এর কিছুদিন পরই কবিেেক হুগলির জেল থেকে স্থানান্তরিত করা হয় বহরমপুর জেলে পাঠানো হয়।
সেখানে শিকল পরেই কবি শিকল ভাঙ্গার গান বাঁধলেন,
’শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল’
তবে জেল জীবনে বন্দি হয়ে বদ্ধ ঘরে শিকল পরিয়ে বিদ্রোহী কবি নজরুল কে কখনোই পরাস্থ করা যায় নি। জেলের অন্যান্য কয়েদীদের সাথে হেসে-খেলে, আনন্দে-মাতিয়ে কবির সময় কাটতে থাকে। জানা যায় কলকাতার জেল থেকে কবিকে হুগলির জেলে আনা হয়েছিল কোমরে দড়ি বেধে। জেলে ঢুকেই কবি হাঁক দিলেন, ” দে গরুর গা ধুইয়ে।’ বলাই বাহুল্য জেলের অন্যান্য বন্দীরা কবি কে কাছে পেয়ে গানে, আবৃত্তিতে, মেতে থাকতেন সবসময়ই। কারণ নজরুল জেল-কারাগার কে কখনই ভয় পান নি, বৃটিশ রাজ শক্তিকে কখনোই তেমন আমল দেন নি। নজরুল ছিলেন প্রেমের কবি আবার অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আজন্ম বিদ্রোহী এক সত্বা। ধুমকেতুতে প্রকাশিত ’ অনন্দময়ী আগমনের’ যে কবিতাটির জন্য কবির এক বছর সশ্রম কারাদন্ড হয়েছিল সেই কবিতাটির কিছু অংশ তুলে ধরা হল।
’’ আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?
মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি
খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।
ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা,
মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা।
তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে
রক্ত-তৃষার ’ময়-ভুখা-হু’র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।-
অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা,
আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা।
দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা
দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।..
’ময় ভুখা হুঁ মায়ি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী
কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!
অত্যাচারী আর জুলমবাজদের বিরুদ্ধে কবি নজরুল যে বিদ্রোহের মন্ত্র তাঁর কাব্য আর গানের মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কে রোপন করেছিলেন সেই বিদ্রোহী হওয়ার দীক্ষাটি এখনো আমাদের প্রতিটা বাঙালি তাদের চিন্তা এবং চেতনায় লালান করে আসছেন। তাঁর সৃষ্টি আমাদের নিত্য প্রেরনা জোগায়,অন্যায়,অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে উদ্ধুদ্ধ করে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.