এক ভয়ংকর বিষ ব্যবসায়ীর গল্প
বিষের যাদুকর ও ব্যবসায়ী গিউলিয়া তোফানা, ছবি- Wikimedia Commons
ভাবতে পারেন প্রায় ৬০০ মহিলা তাদের স্বামীকে খুন করেছে একই বিষ দিয়ে। আর এই বিষের আবিষ্কারক ও বিক্রেতা হলেন গিউলিয়া তোফানা। তোফানার আবিষ্কৃত বিষের নাম 'একুয়া তোফানা'। সাধারণত দাম্পত্য জীবনে অসুখী মানুষেরা মেয়েরা ছিল সেই বিষের ক্রেতা। তারা এই বিষ দিয়ে তাদের স্বামীকে হত্যা করতো। গিউলিয়া তোফানা আনুমানিক ১৬২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন ১৬৫৯ সালে। তোফানা তার বিষ শুধু দাম্পত্য জীবনে অসুখী মহিলাদের কাছেই বিক্রয় করতেন। ফলে অনেকে তোফানাকে ভিলেন হিসেবে বা সিরিয়াল কিলার হিসেবে ভাবতে চান না। তারা মনে করেন তোফানার বিষের কারণে হত্যার যৌক্তিকতা খুঁজে বের করেন।
একুয়া তোফানাতে কী ছিল?
সেসময় যে বিষগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয় ছিল সেগুলো হল, কান্তারেলা, স্ট্রিকিনিন, হেমলক, বেলাডোনা, ফক্সগ্লোভ, একুয়া তোফানা এবং আর্সেনিক। তোফানা ইটালির দক্ষিণের দিকে বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবসা শুরু করলেন। তার সবচেইয়ে জনপ্রিয় দ্রব্য ছিল একুয়া তোফানা নামক বিষ। যা তিনি পাউডার মেক-আপ হিসেবে বিক্রি করতেন।
একুয়া তোফানার বোতলের ডিজাইন, ছবি- Mike Dash
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একুয়া তোফানা কোনো মেকাপ সামগ্রী ছিলনা। এটি ছিল আর্সেনিক, লেড এবং বেলাডোনার এক মিশ্রণ। আলাদাভাবে এই তিনটিই এক একটি ভয়ানক বিষ। একুয়া তোফানা এতটাই ভয়ংকর বিষ ছিল যে এর ৪ ফোটা ই যথেষ্ট ছিল একজন মানুষ এর মৃত্যুর জন্য।
একুয়া তোফানার মার্কেটিং
তোফানার প্ল্যান ছিল দরিদ্র মহিলারাও যেন এই বিষ ক্রয় করতে পারে সেভাবে তৈরি এবং বাজারজাত করা। যেন সব শ্রেণির মহিলারাই এটা কিনতে পারেন এবং এতে ব্যবসাও হবে লাভজনক। একুয়া তোফানা ছিল বর্ণহীন, স্বাদহীন এবং গন্ধহীন বিষ। একটি ছোট বোতলে করে একুয়া তোফানা বিক্রি হত। এবং বোতলের গায়ে সেন্ট নিকোলাস(Saint Nicholas) এর ছবি থাকতো। এই বোতল শোভা পেত অনেক নারীর ড্রেসিং টেবিলে অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রীর সাথেই। এর বোতলের ডিজাইন ই এমন ছিল যে ভুলেও কেউ সন্দেহ করতে পারতো না।
শিল্পীর কল্পনায় গিউলিয়া তোফানা, ছবি-rebelcircus.com
গিউলিয়া তোফানার মার্কেটিং কৌশল ভিন্ন ধরণের ছিল। তোফানা বিষ বিক্রি করতেন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মহিলাদের কাছে। যারা জীবনে অসুখী ছিলেন। সেই সময়ে বিবাহ পদ্ধতি ছিল আগে থেকেই ঠিক করে রাখা। এবং কেউ বিবাহিত জীবনে অসুখী হলে কিংবা শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেও ডিভোর্স এর কোনো কার্যকরী পদ্ধতি ছিলনা। অনেক নারীই ছিলেন যারা স্বামীর হাত থেকে মুক্তি চাইতেন।
অনেক নারীই তোফানার কাছে আসতেন, তারা ভয়ংকর ভয়ংকর নির্যাতনের কথা বর্ণনা করতেন যা তাদের উপর করা হতো। তোফানা তাদের সাহায্য করতে চাইতেন এবং স্বামীসহ পারিবারিক এসব নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বিধবা হওয়ার মাধ্যমে তাদের মুক্ত করতে চাইতেন।
গ্রেপ্তার ও মৃত্যুদন্ড
তোফানার ধরা পড়াটাও একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা। ১৬৫০ সালের শেষ দিকের কথা। তোফানার এক নারী গ্রাহক এক অঘটন করে বসলেন। সেই নারীর সাথে তার স্বামীর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না। একদিন সে তোফানার কাছ থেকে একুয়া তোফানার একটি বোতল নিয়ে যান এবং স্বামীর জন্য তৈরিকৃত স্যুপে মিশিয়ে দেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ওই মহিলার মন পাল্টে যায় এবং সে তার স্বামীর হাত থেকে স্যুপ এর বাটি কেড়ে নেয়। ওই মহিলার স্বামীর এতে সন্দেহ হয় এবং সে তাকে জেরা করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সেই মহিলা তোফানা এবং তার বিষের কথা সব বলে দেয়। তার স্বামী এই খবর কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে।
কিন্তু সুন্দরী তোফানা ছিলেন ব্যবসায়ী হিসেবে অনেক জনপ্রিয়। তার জনপ্রিয়তার কারণে তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এরপর তোফানা এক চার্চের কাছে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন এবং চার্চ তার আবেদন মঞ্জুর করে। এরই মধ্যে এক গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, তোফানা রোম এবং এর আশেপাশের এলাকার পানিতে তার তৈরিকৃত একুয়া তোফানা বিষ মিশিয়ে দিয়েছেন। এই গুজবের পর পুলিশ আবার নড়েচড়ে বসে এবং জোর করে চার্চ থেকে তোফানাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে যায়।
কল্পনায় গিউলিয়া তোফানার মৃত্যুদণ্ড, ছবি-ahistoryofmystery.com
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ এবং বিভিন্ন টর্চারের পর তোফানা স্বীকার করে তার তৈরিকৃত বিষে শুধু রোমেই ১৬৩৩ থেকে ১৬৫১ সালের মাঝে প্রায় ৬০০ জন মানুষ মারা গিয়েছিল। ১৬৫৯ সালে তোফানাকে তার মেয়ে এবং তাদের ৩ জন গৃহ পরিচারিকাসহ দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আর এভাবেই শেষ হয় ভয়ংকর বিষের যাদুকরের বর্নাঢ্য জীবন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.