মোহাম্মদ বিন সালমানের ক্ষমতাশালী হয়ে উঠা
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলোর মধ্যে একটি খবর হলো সৌদি যুবরাজ নিখোঁজ। কয়েকবছর ধরে সৌদি আরবে প্রবল ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে যিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন তিনি হলেন ৩২ বছরের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। সৌদি রাজকীয় আর্থিক অবস্থায় অন্যান্যদের চেয়ে গরিব ছিলেন তার বাবা বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ। ক্রাউন প্রিন্সের দাদা আব্দুল আজিজ ইবনে সৌদের অন্যান্য সন্তানরা যখন সম্পদশালী হচ্ছিলেন তখন তাদের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছিলেন বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ। অথচ মোহাম্মদ বিন সালমান এখন সৌদির সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তি।
২০১৫ সালে তার বাবা যখন সৌদি আরবের বাদশাহ হন, তখন থেকে মোহাম্মদ বিন সালমানের নাম আলোচনায় আসতে থাকে। ৩২ বছর বয়সে তিনি সৌদি আরবে হয়ে উঠেন প্রবল ক্ষমতাধর। মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স পদে আসীন করেন বর্তমান বাদশাহ। ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে যিনি আসীন হন, পরবর্তীতে তিনিই হবেন সৌদি আরবের বাদশাহ।
ফেসবুক কার্যালয়ে জাকারবার্গের সাথে মোহাম্মদ বিন সালমান, ছবি- The Daily Tribune
বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্ম ১৯৮৫ সালের ৩১শে আগস্ট। তৎকালীন সৌদি প্রিন্স (বর্তমানে বাদশাহ) সালমান বিন আব্দুল আজিজ-এর তৃতীয় স্ত্রীর বড় সন্তান হচ্ছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে অবস্থিত কিং সৌদ ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি আইন শাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজে করেছেন। ২০০৯ সালে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে তার বাবার বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তার বাবা সালমান বিন আব্দুল আজিজ তখন রিয়াদের গভর্নর ছিলেন। ২০১৩ সাল থেকে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে শুরু করেন।
বাদশাহ সালমানের সাথে মোহাম্মদ বিন সালমান, ছবি- The Express Tribune
বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটির দুর্নীতি বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে ও আধুনিক উপায়ে সৌদির অর্থনীতিকে গড়তে চান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল বাড়ির মালিক হয়েছেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। ২০১৫ সালে ৩২ কোটি ডলার মূল্যে ফ্রান্সের বিলাস বহুল রহস্যময় বাড়িটি কিনেন তিনি।এছাড়া ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির একটি পেইন্টিং কিনেছেন তিনি। এই পেইন্টিংটি তিনি পরবর্তীতে আরব আমিরাতকে দান করেছেন।
২০১২ সালের জুন মাসে যুবরাজ নায়েফ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ মারা গেলে প্রিন্স মুহাম্মদ ক্রমাঙ্কনের দ্বিতীয় অবস্থানে উঠেন, কারণ তার বাবা নতুন যুবরাজ এবং প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ২ মার্চ ২০১৩ তারিখে, ক্রাউন প্রিন্সের কোর্টের প্রধান প্রিন্স সৌদ বিন নায়েফ পূর্ব প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং সেই পদে প্রিন্স মুহাম্মদ দায়িত্ব পান। তাকে মন্ত্রী পদেও দেওয়া হয়। ২৫ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে প্রিন্স মুহাম্মদকে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল।
ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ২০৩০ সালকে লক্ষ্য করে সৌদি আরবের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ ঘোষণা করেন। দেশের বাইরে তিনি তার বাবা সালমান বিন আব্দুল আজিজের প্রতিনিধিত্ব করে বেইজিং, ওয়াশিংটন সফর করেছেন। ওয়াশিংটন সফরে গত মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করেন।
মোহাম্মদ বিন নায়েফ, যাকে অপসারণ করা হয়েছে ক্রাউন প্রিন্সের দায়িত্ব থেকে, ছবি- The National
২০১৭ সালের ২১ জুন মুহাম্মদ বিন নায়েফকে যুবরাজের পদ থেকে অপসারণ করা হয় এবং তার স্থলে মুহাম্মদ বিন সালমানকে যুবরাজ মনোনীত করা হয় একই সাথে রাজকীয় ফরমানের মাধ্যমে নায়েফকে তার সব পদ থেকে অপসারণ করে তার সকল ক্ষমতা মুহাম্মদ বিন সালমানকে দেয়া হয়। যুবরাজ হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তির দিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প মুহাম্মদ সালমানের এই "উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হওয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন।"
২৯শে জানুয়ারী ২০১৫ তারিখে, বিচ্ছিন্ন সুপ্রিম ইকনমিক কমিশনের পরিবর্তে প্রিন্স মোহাম্মদকে অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থার নতুন প্রতিষ্ঠিত কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়েছিল। ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স নিযুক্ত হওয়ার পর ৪৮ ঘণ্টার রাজকীয় ডিক্রি অনুসারে প্রিন্স বিন সালমান সৌদি এরামকোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। প্রিন্স বিন সালমানের ২০১৫-২০১৬ সালের বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে সৌদি আরবের অর্থনীতিকে আরও বৈচিত্রপূর্ণ এবং বেসরকারীকরণের কাঠামোর দিকে রূপান্তর করা উচিত।
এদিকে পুরুষানুক্রমে চলে আসা রক্ষণশীল সৌদি আরবকে পুরো মাত্রায় বদলে দিচ্ছেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। শিক্ষা, সংস্কৃতি, যুদ্ধ- সবখানেই সংস্কারের ছোঁয়া। শুধু তাই নয়, সৌদিদের জীবনযাপনের মানও বদলে দিতে চান তিনি। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে এবারের বাজেটে নতুন এক প্রকল্পের আওতায় ৩৪.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে সৌদি রাজপরিবার। নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে ‘কোয়ালিটি অব লাইফ প্রোগ্রাম ২০২০’ প্রকল্প ঘোষণা করেছে সৌদি আরবের অর্থনীতি ও উন্নয়ন কাউন্সিল। ৩৪.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কোয়ালিটি অব লাইফ প্রকল্পটি দেশটির অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যকরণ ও তেলনির্ভরতা কমাতে ভিশন ২০৩০-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভিশন ২০৩০ কে বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই এ প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছে। তিনি সৌদি বাদশাহ সালমানের নেতৃত্বে সৌদি অর্থনীতি, সামাজিক অবস্থান ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তিনি উদার ইসলামের চর্চা চান সৌদীতে। সৌদি আরবের মতো একটি দেশে এমন পরিবর্তনের সুর বিষ্ময়কর৷ কিছুদিন আগেই নারীরা গাড়ি চালানোর অধিকার পেয়েছেন৷ রেড সি’তে পর্যটকদের জন্য বিলাসবহুল আবাসনের ব্যবস্থা হচ্ছে, যার অর্থ নারীরা সেখানে বিকিনি পরতে পারবেন, উন্মুক্ত থাকবে বার৷ পরিবর্তনের এমন সুর কিছুদিন আগেও ছিল অকল্পনীয়৷
সৌদি যুবরাজের এই উদারপন্থি মনোভাবের কঠোর সমালোচনা করছেন অনেকে৷ একে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হটানোর কৌশল ভাবছেন অনেকেই৷ অনেকেই আবার বলছেন, এটা দেশে বিনিয়োগের আকর্ষণের কৌশল৷ অবশ্য অনেক সমালোচনা ভিত্তিহীনও নয়৷ এর মধ্যে সরকারের সমালোচনাকারী অনেক নেতা আটক হয়েছেন৷ রাজ্যের সত্যিকারের প্রয়োজন, যেমন গণতন্ত্র বা মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা নেই কোনো৷ অন্যদিকে, সৌদি যুবরাজের উদারপন্থি এই মনোভাবের কারণে রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতাদের বিরোধিতার মুখোমুখি হতে পারে রাজপরিবার৷
২০১৫ সালের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েই ইয়েমেনের সাথে যুদ্ধাবস্থা তৈরির পর তাঁকে দেয়া ক্ষমতার কতটা সদ্বব্যবহার তিনি করবেন, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়৷ দেশকে আধুনিক করা কেবল কয়েকটা বড় প্রকল্প হাতে নেয়ার উপর নির্ভর করে না৷ এর জন্য প্রয়োজন আরো বেশি কিছু৷ খুব অল্প সময়ে তা হবার নয়৷ এর সাথে যোগ হয়েছে তেলের রপ্তানিমূল্য কমে যাওয়া এবং সৌদি বাজেটের ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া৷ সবমিলিয়ে, সৌদি যুবরাজ বিন সালমানের পরিকল্পনা কতটা কাজ করবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়৷
সৌদি যুবরাজ অল্প সময়ের মধ্যেই দেশে ও বিদেশে প্রচুর শত্রু তৈরি করেছেন। দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের নাম করে গ্রেপ্তার করেছেন অনেক সৌদি যুবরাজকে। এভাবে দেশে তার বিরোধী তৈরি হয়েছে প্রচুর। আবার সিরিয়া, ইরান, লেবানন, ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ করতে গিয়ে বিদেশেও তৈরি করেছেন অনেক শত্রু। সব মিলিয়ে তিনি ভালোই চাপে ছিলেন। তাই তার দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিতি ব্যাপক সন্দেহের সৃষ্টি করে। আসলেই কি তিনি সুস্থ আছেন নাকি কিছু একটা হয়েছে?
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.