ইরানে ইসরাঈলী হামলায় রাশিয়ার ফায়দা কী?
রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনেয়ি, ছবি- NBC News
মুসলিমরা হলো পৃথিবীর পরাশক্তিদের দাবার গুটি। একসময় তাদের ব্যবহার করেছে আমেরিকা রাশিয়াকে ধ্বংস করার জন্য। আবার রাশিয়াও এখন তাদের ব্যবহার করছে আমেরিকাকে কন্ট্রোল করার জন্য। আফগানিস্তানের মুসলিমদের ব্যবহার করে রাশিয়াকে ভেঙ্গে দেয়ার কথাতো সবাই জানে। এরপর সেই আফগানিস্তানের মেরুদণ্ড ভাংতে এখনো কাজ করে যাচ্ছে আমেরিকা। সেরকম পরিস্থিতির দিকেই কি আগাচ্ছে রাশিয়া। ইরানকে ব্যবহার করছে আমেরিকার বিরুদ্ধে। আবার কৌশলে ইরানকেই সঁপে দিচ্ছে ইসরাঈলের হাতে।
ইরানের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক যে কতটা ঘনিষ্ট তা সবার কাছেই স্পষ্ট করে ইরান ও রাশিয়া। সিরিয়া যুদ্ধে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে বাশার আল আসাদকে রক্ষা করার জন্য। রাশিয়া এই নিয়ে তুরস্কের সাথেও যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল প্রায়। এর মধ্যে তুরস্কে ঘটে যাওয়া ব্যর্থ ক্যু ঘটনার মোড় অন্যদিকে নিয়ে যায়। তুরস্ক আমেরিকা বিরোধী হয়ে পড়ে। তারই ধারাবাহিকতায় ইরান-তুরস্ক-রাশিয়া জোটবদ্ধ হয় মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে।
হাসান রুহানী, পুতিন এবং এরদোয়ান। ছবি- Strategic Culture Foundation
এর মধ্যেই ইসরাঈলের সাঁড়াশী আক্রমণের শিকার হয় ইরান। নির্বিকার রাশিয়া। কিন্তু কেন? কেন রাশিয়ার এই নীরবতা? রাশিয়ার ফায়দাই বা কী?
৯মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে রাশিয়ার বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে রাশিয়া সফরে গিয়েছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। নেতানিয়াহুই ছিলেন বিশ্বের একমাত্র সরকার প্রধান, যিনি এ বছর দিবসটি উপলক্ষ্যে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন মস্কোতে। রাশিয়ার ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ দিবস উপলক্ষ্য আয়োজিত বার্ষিক সামরিক মহড়ার অনুষ্ঠানটি তিনি উপভোগ করেছেন পুতিনের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।
মস্কোতে পুতিন এবং নেতানিয়াহু। ধারণা করা হয় তারা একটি গোপন চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। ছবি- The Duran
যাত্রা শুরুর আগে নেতানিয়াহু সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছিলেন, সিরিয়াতে এই মুহূর্তে যা ঘটছে তাতে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর সাথে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের যে সামরিক সমঝোতা আছে, তার ধারাবাহিকতা পুনরায় নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নেতানিয়াহু নিশ্চিতভাবেই পুতিনের সাথে তার আলোচনায় আশানুরূপ সাড়া পেয়েছিলেন। কারণ রাশিয়া ত্যাগ করার পূর্বে সাংবাদিকদের সাথে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, এটা মনে করার কোনো ভিত্তি নেই যে, সিরিয়াতে ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপে রাশিয়া বাধার সৃষ্টি করবে।
নেতানিয়াহুর বক্তব্য যে নিছকই আনুষ্ঠানিকতা ছিল না, তার প্রমাণ পাওয়া যায় এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই। সেদিন রাত ১টার সময় ইসরায়েল তার বিমানবাহিনীর ২৮টি এফ-১৫ এবং এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান থেকে সিরিয়ার ভূমিতে অন্তত ৬০টি মিসাইল নিক্ষেপ করে। গোলান মালভূমি থেকে নিক্ষেপ করে আরো ১০টি স্থল থেকে স্থল মিসাইল। সেগুলো আঘাত হানে সিরিয়াতে অবস্থিত ইরানের প্রায় ৫০টি সামরিক স্থাপনার উপর। নিহত হয় অন্তত ২৭ জন, যাদের মধ্যে ছিল এগারো জন ইরানী এবং ছয় জন সিরীয় সেনা।
সিরিয়ায় ইরানী স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরাঈলের হামলা, ছবি- The Unshackled
সিরিয়ার ভূমিতে ইসরায়েলের এই আক্রমণ ছিল ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় আক্রমণ। অনেকেই আশা করেছিল, রাশিয়া যেহেতু সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল-আসাদ সরকার সবচেয়ে বড় মিত্র, তাই এই আক্রমণের পর রাশিয়া বেশ কঠোর জবাব দেবে। কিন্তু বাস্তবে রাশিয়া সেরকম কিছুই করেনি। কঠোর নিন্দা জানানোর পরিবর্তে রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক প্রতিনিধি মিখাইল বোগদিনভ মোটামুটি নিরপেক্ষ একটি বিবৃতি দেন, যেখানে নতুন করে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করা হয় এবং উভয় পক্ষকে উত্তেজনা প্রশমিত করার আহ্বান জানানো হয়।
নেতানিয়াহুর সফর, তার বক্তব্য এবং সবশেষে রাশিয়ার এই ভূমিকায় বিজনেস ইনসাইডার, জেরুজালেম পোস্ট, হারেৎজসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সন্দেহ প্রকাশ করা হয়, ইরানী স্থাপনার উপর ইসরায়েলের এবারের আক্রমণের পেছনে রাশিয়ার সবুজ সংকেত ছিল। এছাড়া, সাংবাদিক ও সামরিক ইতিহাসবিদ বাবাক তাগভাই রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্রের বরাত দিয়ে দাবি করেন, নেতানিয়াহুর সফরকালে পুতিন তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন, ইসরায়েল যদি ইরানের রেভোলিউশনারি গার্ডের স্থাপনার উপর হামলা করে, তাহলে রাশিয়া তাতে বাধা দেবে না।
আসাদ এবং পুতিন। ছবি- Al Arabiya
কিন্তু রাশিয়া এবং ইরান উভয়েই যেখানে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিশ্বস্ত মিত্র, এবং উভয়েই যেখানে আসাদ সরকারকে সাহায্য করছে, সেখানে কেন রাশিয়া ইরানের উপর ইসরায়েলি আক্রমণকে সমর্থন করবে? বিশ্লেষকরা বিভিন্নভাবে এর ব্যাখ্যা করেছেন। বাবাক তাগভাই তার সূত্রের বরাত দিয়ে দাবি করেন, রাশিয়া ইসরায়েলের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে এই শর্তে যে, ইরানের উপস্থিতি নেই এমন কোনো সিরীয় স্থাপনায় ইসরায়েল হামলা করবে না এবং ইসরায়েলকে তার শত্রু ইরানের উপর হামলা করার সুযোগ দেওয়ার বিনিময়ে ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর উপর তাদের শক্তিশালী প্রভাব ব্যবহার করে রাশিয়ার সাথে তাদের সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ করে দিবে।
তবে এটিই একমাত্র কারণ না-ও হতে পারে। একথা সত্য যে, রাশিয়া এবং ইরান উভয়েই বাশার আল-আসাদের বিজয়ের জন্য অপরিহার্য ছিল। রাশিয়ার বিমান আক্রমণ এবং ইরানের প্রশিক্ষণ দেওয়া শিয়া মিলিশিয়ারাই মূলত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বাশারকে জয়ী হতে সাহায্য করেছে। কিন্তু বর্তমানে সিরিয়ার অধিকাংশ এলাকাই বাশার আল-আসাদের নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় বিদ্রোহীরা বারবার এত শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে যে, তাদের পক্ষে পুনরায় হারানো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া খুবই কঠিন হবে। তাই এ মুহূর্তে সিরিয়াতে অবস্থানকারী দুই বিজয়ী পক্ষ রাশিয়া এবং ইরানের মধ্যে যে সিরিয়ার ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণের ভূমিকা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হবে, সেটি অনেকটাই অনুমিত।
এরকম পরিস্থিতিতে রাশিয়া হয়তো ইসরায়েলকে ইরানের ঘাঁটিগুলোর উপর আক্রমণ করতে অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে এক ঢিলে একাধিক পাখি শিকার করেছে।
প্রথমত, সিরিয়াতে তাদের অর্জনগুলোর বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের যে একটিমাত্র রাষ্ট্র বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেই ইসরায়েলের সাথে তারা সুসম্পর্ক তৈরি করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা ইউরোপ ও আমেরিকার সাথে উত্তেজনা প্রশমিত করার সুযোগ তৈরি করে নিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, তারা ইরানের সামরিক স্থাপনাগুলোর উপর আক্রমণ করানোর মধ্য দিয়ে সিরিয়ার ভবিষ্যত রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব নিশ্চিত করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা ইরানের স্থাপনাগুলোর উপর এমনভাবে হামলা করিয়েছে, যাতে ইরানের প্রভাব হ্রাস পাবে, কিন্তু বাশারের টিকে থাকার সম্ভাবনায় কোনো ঝুঁকির সৃষ্টি হবে না।
তৃতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যে যাতে ইরানের আধিপত্য এমনভাবে সৃষ্টি না হয় যাতে করে ইরান পরাশক্তিতে রুপান্তরিত হয়। ইতিমধ্যে ইরান বহুদিন আমেরিকা ও জাতিসংঘের অবরোধের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা দেখিয়েছে।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.