নাকবা, ইন্তিফাদা ও আল কুদস এগুলোর মানে কী?

ফিলিস্তিন পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনপদ। আজ প্রায় ৭০ বছর ধরে তারা তাদের নিজ ভূমিতে নির্যাতিত হচ্ছে। একথা সবার জানা। কিন্তু যখনি ফিলিস্তিনে নতুন করে সংঘাত হয় তখন কিছু শব্দ শোনা যায় বা কিছু পরিভাষা ব্যবহার হতে থাকে। এই পরিভাষাগুলোর মানে অনেকেই জানেন না। এর মধ্যে নাকবা দিবস, ইন্তিফাদা, আল কুদস দিবস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আজ আমরা এসব বিষয়ে ধারণা নেব।
আন নাকবা
আজ ১৫মে ছিল ৭০ তম ’নাকবা’ দিবস। আরবি শব্দ নাকবা মানে মহাদূর্যোগ, মহাবিপর্যয়। ১৫মে হলো বিশ্বের বুকে অবৈধভাবে ইহুদি রাস্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার দিন যা ছিল সত্যিকারভাবে ফিলিস্তিনিদের জন্য মহাবিপর্যয়! বেলফোর ডিক্লারেশনের পর থেকে সারা বিশ্বের ইহুদিরা জড়ো হতে শুরু করে ফিলিস্তিনে! ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার। ১৯৪৮ সালে সেখানে ইহুদীদের সংখ্যা ৬ লাখে উন্নীত হয়। সেই যে শুরু ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি ভূমি দখল, অবৈধ বসতি স্থাপনের কাজ তা এখন পর্যন্ত জোর গতিতে এগিয়ে চলেছে।

১৯৪৮ সালে বৃটিশদের সহায়তায় ইসরাঈলী দখলদারিত্বে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে ফিলিস্তিনিরা, ছবিঃ medium.com
৭০ বছর ধরে তারা নিজ বসতি ভিটা ছেড়ে শরণার্থী হয়ে আছে এবং এখনও হচ্ছে! আর ১৯৪৮ সালের আগে ইসরায়েল নামে কোনো রাস্ট্র পৃথিবীতে ছিল না! উড়ে এসে জুড়ে বসার মত ব্যাপারটা । ধরুণ, আপনি নিজ বাড়িতে বসবাস করেণ। একদিন অচেনা অজানা একদল লোক এসে বলল, আজকেই আপনার বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে! এখন থেকে এ বাড়ি আমাদের! ফিলিস্তিনে এটাই ঘটছে! মহাবিপর্যয়ের দিনটিকেই স্মরণ করতে ১৫ মে নাকবা দিবস পালন করে ফিলিস্তিনিরা।
ইন্তিফাদা
নতুন এক ইন্তিফাদার ডাক দিয়ে বিশ্বে তোলপাড় দিয়েছেন হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া। ‘ইন্তিফাদা’ শব্দটি আরবি। শাব্দিক অর্থ উত্থান। প্রচলিত অর্থে ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের গণঅভ্যুত্থান।

ইসমাঈল হানিয়া, হামাস প্রধান। ছবিঃ Getty Images
১৯৮০ এর দশকের শেষ দিকে গাজা এলাকায় ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন শুরু হয়। দুইটি বড় গণজাগরণের পর এখন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন তৃতীয় ইন্তিফাদার ডাক দিয়েছে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডের পশ্চিম তীর এবং গাজা এলাকা ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরাইলের দখলে আছে।
প্রথম ইন্তিফাদা ১৯৮৭-১৯৯৩ সাল পর্যন্ত চলে। এ ছয় বছরে আইডিএফ আনুমানিক ১,১৬২-১,২০৪ জন ফিলিস্তিনি হত্যা করে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা সংঘটিত হয়েছিল ২০০০-২০০৫ সাল পর্যন্ত। এ্যারিয়েল শ্যারন হাজার খানেক সৈন্যবাহিনী নিয়ে জেরুজালেমের পুরাতন শহর,মসজিদ আল আকসা ভ্রমণ করতে আসলে এই ইন্তিফাদা শুরু হয়। তার এই ভ্রমণ ফিলিস্তিনিদের চোখে ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ন মসজিদের উপর ইজরাইলি দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হিসাবে প্রতীয়মান হয়। ইসলামে ফিলিস্তিনের বায়তুল মাকদিস এর অবস্থান মক্কা ও মদীনার পরেই।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণার পর ফিলিস্তিনিরা প্রতিরোধ আন্দোলন বা তৃতীয় ইন্তিফাদা’র ডাক দিয়েছে। যদি ইন্তিফাদা শুরু হয়, অবারো রক্তাক্ত হবে ফিলিস্তিন। আবারো আরেক রক্ত নদীর ইতিহাস রচিত হবে। হয়তো এর মাধ্যমেই একদিন দখলমুক্ত হবে ফিলিস্তিন।
আল কুদস দিবস
রমজান মাসের শেষ শুক্রবার আল-কুদস দিবস। মুসলমানদের প্রথম কেবলা পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাসকে দখলমুক্ত করার আন্দোলনের প্রতীকী দিন।
বায়তুল মুকাদ্দাস বছরের পর বছর ধরে ইহুদিদের দখলে রয়েছে। ফিলিস্তিনের মূল অধিবাসীদের অধিকাংশকে বিতাড়িত করে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইহুদিরা সেখানে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল কায়েম করে। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করে। এর পর থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসকে দখলমুক্ত করার জন্য সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে আল-কুদস দিবস পালিত হয়ে আসছে। পবিত্র রমজান মাসের শেষ জুমার দিনকে আল-কুদস দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

ইরানী বিপ্লবের নায়ক ইমাম খোমেনী। ছবিঃ Pars Today
আল-কুদস দিবস বা আন্তর্জাতিক আল-কুদস দিবস ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনী (রহ.) এর আহবানে ১৯৭৯ সালে ইরানে প্রথম শুরু হয়েছিল। এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ, জায়নবাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ এবং ইসরাইল কর্তৃক জেরুযালেম দখলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ। জেরুজালেম শহরের অপর নাম ‘কুদস’ বা ‘আল-কুদস’ ।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইবরাহীম ইয়াজদি সর্বপ্রথম আল-কুদস দিবস র্যালি আয়োজনের ধারণা দেন। তারপর আয়াতুল্লাহ খোমেইনী ১৯৭৯ সালে ইরানে এর প্রবর্তন করেন। এর পর থেকে ইরানসহ আরও বিভিন্নদেশে প্রতি বছর আল-কুদস দিবসটি গুরুত্বের সাথে উৎযাপিত হযে আসছে।
বায়তুল মুকাদ্দাস ইসলামের প্রথম কিবলা এবং পবিত্র মক্কা ও মদিনার পরে তৃতীয় পবিত্র স্থান। মহানবী (সা.) মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদুন্নবী ও বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদের উদ্দেশ্যে সফরকে বিশেষভাবে সওয়াবের কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ পবিত্র ঘর থেকেই তিনি মিরাজে গমন করেছিলেন। বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদ এবং তার আশপাশের এলাকা বহু নবীর স্মৃতিবিজড়িত। হজরত ইবরাহীম (আ.) কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর হজরত ইয়াকুব (আ.) জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদ নির্মাণ করেন। এর পর হজরত সুলায়মান (আ.) এই পবিত্র মসজিদের পুনর্নির্মাণ করেন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.