মালয়েশিয়ান বিপ্লবের নায়ক আনওয়ার ইব্রাহীম
আনওয়ার ইব্রাহীম, ছবিঃ যুগান্তর
মালয়েশিয়ার কারাবন্দি নেতা আনওয়ার ইব্রাহিম আগামী তিন দিনের মধ্যে মুক্তি পেতে পারেন বলে জানিয়েছেন তার কন্যা নুরুল ইজ্জাহ। আগামী বুধবার মানে সতেরো তারিখের মধ্যে তিনি মুক্তি পেতে পারেন বলে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী গণমাধ্যম রয়টার্সকে শনিবার জানিয়েছেন নুরুল ইজ্জাহ। আজ আমরা মালয়েশিয়ার আনোয়ার ইব্রাহীমকে নিয়ে জানবো কীভাবে তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন কারাগারে থেকেই।
তিনি যখন ইউনিভার্সিটি মালায়ুর ছাত্র, সেই ২১ বছর বয়সেই তার মধ্যে লীডারশিপ যোগ্যতা দেখা যায়। ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ মালায়েশিয়ান মুসলিম স্টুডেন্টস প্রতিষ্ঠা করেন। এর নাম হয় পরে আবিম, বা আংকাতান বেলিয়া ইসলাম মালায়েশিয়া। ১৯৬৮-১৯৭১ সন পর্যন্ত তার নাম ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন স্থানে ছড়ায়ে পড়ে। নেতৃত্ব দেন ইংলান্ডে ইফসু, সৌদি ভিত্তিক ওয়ামি, আমেরিকা ভিত্তিক ট্রিপল আইটির এবং সারা বিশ্বে ছাত্র আন্দোলনে তিনি ক্যারিশমাটিক নেতা হিসেবে আবির্ভুত হন। ছাত্রজীবন শেষ হলে তিনি মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে সরাসরি প্রবেশ করেন। ১৯৭৪ সনে তিনি কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন যাতে সারা মালয়েশিয়াতে তার প্রভাব পর্যাবেক্ষন করে সবাই। তাকে আই এস আই বা ইন্টারনাল সিক্যুরিটি এক্টএ আটক করা হয়, এবং ২০ মাস বিনা বিচারে জেল খাটিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।
ছাত্রনেতা আনওয়ার ইব্রাহীম, ছবিঃ Says.com
আনওয়ার ইব্রাহীম ১৯৪৭ সালে মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় পেনাং রাজ্যের চিরোক তক্কুন গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ইব্রাহীম আব্দুল রহমান একজন হাসপাতালের কর্মচারী ছিলেন এবং পরবর্তীকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। তার মা চে ইয়েন হুসেন একজন গৃহিণী ছিলেন। আনোয়ার ইব্রাহীম তার শিক্ষাজীবন তার নিজ গ্রামে শুরু করেন। তিনি মালয় কলেজ কুয়ালা কানজার থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। ইউনিভার্সিটি অফ মালয় থেকে মালয় স্টাডিজ এ অনার্স এবং ১৯৭৪-৭৫ সালে জেলে থাকা অবস্থায় মাস্টার্স সমাপ্ত করেন।
মাহাথির মোহাম্মাদ ১৯৮১ সালে প্রধান মন্ত্রী হওয়ার পরে যাদের মাধ্যমে দেশোন্নয়নের কথা ভাবছিলেন, তার মধ্যে আনওয়ার ইবরাহীমকেও রেখেছিলেন। ক্রমে ক্রমে ১৯৮৩ সালেই তাকে সংস্কৃতি মন্ত্রী, ১৯৮৪ এগ্রিকালচার মন্ত্রী এবং ১৯৮৬ সালে তাকে শিক্ষা মন্ত্রীর দ্বায়িত্ব দেয়া হয়। মালায়েশিয়ার ইতিহাসে শিক্ষামন্ত্রীর দ্বায়িত্ব পাওয়া মানে প্রধান মন্ত্রী হওয়ার দিকে পা রাখা, এ বিষয়টা সবারই জানা ছিলো। ফলে এখান থেকেই আনওয়ার ইবরাহীম শত্রুতার কোপানলে পড়েন।
আনওয়ার ইব্রাহীম যখন শিক্ষামন্ত্রী তখন আনওয়ার ও মাহাথির। ছবিঃDin Merican
আনওয়ারের জনপ্রিয়তাকে হুমকি হিসেবেই দেখলেন মাহাতির। আনওয়ারকে স্যাক করলেন, তাকে মার দিলেন, ব্যাক বোন ভেঙে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। অন্ততঃ ৫ জনের সাথে আনওয়ার ইবরাহীমের সমকামী সম্পর্ক ছিলো প্রমান করতে স্পার্ম নিয়ে খেলা শুরু করলেন, ম্যাট্রেস প্রদর্শনী করেলেন। ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করে আনওয়ারকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলেন মাহাথির।
আনওয়ার ইবরাহীম ছিলেন আরেক মাহাথির। মূলত তাদের দুইয়ের ফসল হলো আধুনিক ও মুসলিম মালয়েশিয়া। মাহাথির আধুনিক উন্নত মালায়েশিয়ার রূপকার, আর আনওয়ার হলেন আধুনিক ইসলামি মালয়েশিয়ার কর্মকার। আনওয়ারকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার মাহাথিরীয় বুদ্ধি মাহাথিরকে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন করে। ক্ষমতা তাকেও হারাতে হয়, কারণ খ্যাতি চলে যায় জিরোর কোঠায়। ফলে তিনি পদত্যাগ করেন।
মাহাথিরের ষড়যন্ত্রে গ্রেপ্তার আনওয়ার ইব্রাহীম, ছবিঃ The Australian
কিন্তু ক্ষমতার মেইন ঘুটি হিসেবে থাকেন তিনি। প্রথমে আব্দুল্লাহ বাদাওয়ীকে তিনিই আনেন। তাকে দিয়ে কাজ হচ্ছিলনা বলে তাকে তিনিই তাড়ালেন। নাজিব রাযাককেও তিনি আনেন। বারবার আনওয়ারের বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করেছেন। কিন্তু তাকে দিয়েও মালয়েশিয়ায় তেমন উপকার দেখতে পাচ্ছেন না। এখন থেকে বছর দুই আগ থেকে তিনি আনওয়ারের প্রতি সুদৃষ্টি দেন। তাকে এই সব নেতাদের মধ্যে সব চেয়ে যোগ্য ও কাছের মনে করে তার সাথে করা অন্যায়ের জন্য তিন বার অশ্রুপাতও করেছেন। একবার বাকরূদ্ধও হয়েছেন। পরে আনওয়ারের মেরুদন্ডের ব্যাথা ও কিছুটা ভালো হবার পরে দুই বন্ধু ও বাবা ছেলে এক হয় পাকাতান হারাপান করেছেন। এবং সেই মাহাথির আবার তাকে ক্ষমতার শীর্ষে নেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছেন।
মাহাথির অকপটে স্বীকার করেছেন, তিনি ইব্রাহিমকে ফেলে দিয়ে ভুল করেছিলেন। সেটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছিল। সেই রাজনৈতিক ভুলের খেসারত দিয়েছেন তিনি। তবে সেটা মধুর। আনোয়ার বন্ধুবর মাহাথিরকে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর শর্তে প্রধানমন্ত্রী করে মধুর প্রতিশোধ নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর স্ত্রীর যোগ্যতা ও নেতৃত্বের প্রশংসা করতেই হবে। ইব্রাহিমের ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, ইব্রাহিমের স্ত্রী গোটা জাতীয় রাজনীতিতে একটি আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছেন।
ওয়ান আজিজাহ ওয়ান ইসমাইলি, আনওয়ারের ইব্রাহীমের মহীয়সী স্ত্রী। ছবিঃ Worldbulletin
আনোয়ারের স্ত্রী প্রমাণ করেছেন, উত্তরাধিকারের রাজনীতি মানেই হিংসার চাষাবাদ নয়, তিনি প্রমাণ রেখেছেন কীভাবে শুধু জনগণের শক্তির ওপর আস্থা রেখে কারারুদ্ধ স্বামীকে কাছে না পেয়েও পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে আনা যায়। অবশ্যই মাহাথিরের ক্যারিশমাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। তবে মালয়েশিয়ায় চলমান রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে মাহাথির নায়ক, সার্বিক দিকে বিবেচনায় ইব্রাহিমই মহানায়ক।
মাহাথির তাঁর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন, রাজা ইব্রাহিমকে ক্ষমা করে দেবেন। এটা কিন্তু একজন মাহাথিরের ঔদার্য নয়, এটা বন্দী ইব্রাহিমের অর্জন। যোগ্যতা থাকলে আইনের শাসনের সংজ্ঞা পাল্টে দেওয়া সম্ভব। মাহাথির হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি, যে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তিনি ইব্রাহিমকে কারাগারেই শুধু নয়, মাটিতে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেই ইব্রাহিমেই তিনি শুদ্ধ হবেন। ইব্রাহিম তাবৎ বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন, জনগণের শক্তিতে বিশ্বাসী ও বলীয়ান হলে রাষ্ট্রক্ষমতা ও মর্যাদা পুনরুদ্ধারে জামিন লাগে না।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.