মাহাথির মোহাম্মদের উত্থান হয়েছে যেভাবে
মালয়েশিয়ায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির পর প্রথমবারের মতো দেশটিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছে দেন তিনি। এই একটি কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার অনুকরণীয় রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হয়েছিলেন মাহাথির। যদিও নিজ দেশে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
গতকালের নির্বাচনে ২২২ আসনে মধ্যে মাহাথির মোহাম্মদের পাকাতান হারাপান জয় পেয়েছে ১১৩টি আসনে। অন্যদিকে, দেশটির ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বারিসান ন্যাশনাল ৭৯টি আসনে জয় পেয়েছে। কোনো দল বা জোট ১১২ আসনের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেই শাসনক্ষমতায় আসীন হতে পারে। ৯২ বছরে আবারো চমক দেখালেন মাহাথির মোহাম্মদ।
রাজনীতিতে মাহাথির মোহাম্মদের হাতেখড়ি ১৯৪৬ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিল মোটে ২১ বছর। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তখন উত্তাল মালয়েশিয়া। ওই সময়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও) যোগ দেন তিনি। ওই দলের মূল আদর্শ ছিল জাতীয়তাবাদ। এটি এখনো মালয়েশিয়ার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল।
টুংকু আব্দুল রহমান, ছবি: eBay
ইউনিভার্সিটি অব মালয় থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা করেছেন মাহাথির। এরপর জন্মভূমি কেদাহ রাজ্যে সাত বছর চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। মাহাথির ধীরে ধীরে ‘ডক্টর এম’ নামে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ইউএমএনও দলের হয়ে ১৯৬৪ সালে মালয়েশিয়ার পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। তবে ১৯৬৯ সালে ঘটে ছন্দপতন। দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে পার্লামেন্ট আসন হারান তিনি। মালয় সম্প্রদায়কে অবহেলার অভিযোগ তুলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টুংকু আব্দুল রহমানের কাছে খোলা চিঠি লিখেছিলেন মাহাথির। এতেই ক্ষমতাসীন দলের রোষের মুখে পড়েন তিনি।
রাজনৈতিকভাবে একঘরে হওয়ার পর বই লেখায় মনোনিবেশ করেছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। নিজের আদর্শ ও চিন্তাভাবনা নিয়ে একটি বিতর্কিত বই লেখেন তিনি। বইটির নাম ছিল ‘দ্য মালয় ডিলেমা’। ওই বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই মালয় সম্প্রদায়কে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে এবং দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছিল। আর এই বিষয়টি মেনে নিতে মালয় সম্প্রদায়কে বাধ্য করা হয়েছিল।
‘দ্য মালয় ডিলেমা’ বইয়ের প্রচ্ছদ, ছবি: FIRST DRAFT BOOKSTORE
দ্য মালয় ডিলেমা প্রকাশিত হওয়ার পর রাজনীতিবিদ হিসেবে ডক্টর এমের পুনরুত্থান ঘটে। পশ্চিমা নব্য ঔপনিবেশিকদের প্রতি মালয়েশিয়ার ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে-তা ঠিক করতে বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর ইউএমএনও দলের তরুণ নেতাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মাহাথির। দলে ফিরেই ১৯৭৪ সালে পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন তিনি। এরপর মন্ত্রিসভায় ঢুকে যান মাহাথির। পান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
মন্ত্রী হওয়ার চার বছরের মধ্যে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন মাহাথির মোহাম্মদ। ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) দ্বিতীয় প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মাহাথির।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ‘ডক্টর এম’ দেশ নিয়ে তাঁর চিন্তাগুলোর বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজ শুরু করেন। জাপানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি মালয়েশিয়াকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, স্টিল ও গাড়ির উৎপাদক দেশে পরিণত করেন। অথচ এর আগে মালয়েশিয়া শুধু রাবার ও টিন রপ্তানি করত। টানা ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। এই দীর্ঘ সময়ে মালয়েশিয়াকে এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেন তিনি। ২০০৩ সালে ক্ষমতা ছাড়েন মাহাথির।
দেশকে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে নিয়ে এলেও, মাহাথিরের সমালোচনাও কম হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, দেশের অনেক মানুষই তাঁকে ‘বর্ণবাদী’ হিসেবে দেখেন। বিশেষ করে, নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকেরা তাঁকে খুব একটা পছন্দ করেন না। মালয় সম্প্রদায়ের প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানোর পাশাপাশি নৃতাত্ত্বিক বৈষম্যের সূচনাও করেছিলেন মাহাথির।
সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়নের গুরুতর অভিযোগ আছে। তাঁর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ানো সব ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন মাহাথির। আনোয়ার ইব্রাহিম ছিলেন মাহাথির পরবর্তী যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। অথচ ১৯৯৮ সালে সেই আনোয়ারকেই বরখাস্ত করেন মাহাথির। পরে তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয় সমকামিতা ও দুর্নীতির অভিযোগ। সেই অভিযোগে সাজা পেয়েই এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি আনোয়ার।
আনোয়ার ইব্রাহিম, ছবি: FMT
তবে শুধু আনোয়ার নয়, ক্ষমতা ছাড়ার পর সব উত্তরসূরির সমালোচনাতেই মুখর ছিলেন ডক্টর এম। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় মাহাথিরই প্রথম নাজিবকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। নাজিব প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন তাঁর সমর্থন নিয়ে। এবার শিষ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মাহাথির বলছেন, আগে তিনি ভুল করেছিলেন! এবার সেগুলো শুধরে নিতেই ক্ষমতায় আসতে চান তিনি।
মালয়েশিয়ার বিরোধীদলীয় জোট পাকাতান হারাপান ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে মাহাথিরকে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে। নাজিবের পতনের জন্যই একসময়ের বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ডক্টর এম। আবার এও জানিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচিত হলেও বেশি দিন ক্ষমতায় থাকবেন না তিনি। ‘পুরোনো শত্রু’ আনোয়ার ইব্রাহিমকে ক্ষমতায় এনে বিদায় নেবেন। যদিও নিন্দুকদের ধারণা, ক্ষমতা পেলে বদলে যেতে পারেন এই ঝানু রাজনীতিবিদ।
নাজিব রাজাক, ছবি:WORLD OF BUZZ
ভোটগ্রহণের আগে টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন, বর্তমানে মালয়েশিয়ার সাধারণ মানুষ আর্থিক সংকটে আছে। এ জন্য প্রথমে নাজিবকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। তা না মানায় নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তিনি।
মনে রাখতে হবে, মাহাথির মোহাম্মদ এখন যে পরিস্থিতির বিরোধিতা করছেন, তা তাঁর নিজেরই তৈরি। মালয়েশিয়ার বর্তমান একদলীয় শাসন ব্যবস্থাকে তিনি শক্ত ভিত্তি দিয়েছিলেন। এখন সেটিই ভেঙে ফেলার কথা বলছেন তিনি। আর এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন নাজিবের বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতির অভিযোগকে।
একটি জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশটির বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, সর্বস্তরে শরিয়া আইন প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া রাজনীতিতেও এখন কট্টরপন্থী ইসলামি রাজনৈতিক দলের প্রভাব বেড়েছে। এদের মধ্যে শক্তিশালী পাস পার্টি। এবারের নির্বাচনেও তারা ভালো করেছে। জাতীয় পর্যায়ে ১৬% ভোট পেয়েছে ও দুটি প্রদেশে এককভাবে সরকার গঠন করার মত ভোট পেয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাহাথির বলেছেন, এ ধরনের ইসলামি রাজনৈতিক দল গঠন করা সঠিক নয়। আর এই দলগুলো যেভাবে শরিয়া আইন বাস্তবায়নের দাবি তুলছে, তাও ভালো নয়। এসব দলের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মাহাথির।
মালয়েশিয়ান ইসলামিক পার্টির (পাস) প্রধান আব্দুল হাদি, ছবি: Malay Mail
মালয়েশিয়ার সাধারণ ভোটারদের অর্ধেকই কিন্তু মুসলিম ও মালয় সম্প্রদায়ের। তাদের ভোটের ওপরই নির্ভর করছে নাজিবের ভাগ্য। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নির্বাচনের আগ দিয়ে নির্বাচনী সীমারেখা পরিবর্তন ও ভুয়া সংবাদ প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন করায় কিছুটা সুবিধা পেয়েছেন নাজিব রাজাক। তবে মাহাথির মোহাম্মদকে বাতিলের খাতায় ফেলার সাহস কারও নেই। কারণ মুসলিম মালয় সম্প্রদায়ের ভোটব্যাংক ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই আছে এবং এরই মধ্যে তিনি তা দেখিয়েও দিয়েছেন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.