মাতাহারি আসলেই কি রহস্যময় গুপ্তচর ছিলেন?
জার্মান গুপ্তচর মাতাহারি (মার্গারিটা গ্রিটুইডা জেল্যে), ছবি: www.history.com
নাম তার মার্গারিটা গ্রিটুইডা জেল্যে। ডাচ বংশোদ্ভূত এক প্রতিভাময়ী নর্তকী। মাতাহারি নামেই পরিচিত। যদিও প্রথম মহাযুদ্ধের সময় গুপ্তচরববৃত্তির অভিযোগে ফরাসি ফায়ারিং স্কোয়াডে প্রাণ দিতে হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাতাহারির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। আজো ফরাসি সরকার মাতাহারি সংক্রান্ত নথিপত্র প্রকাশে অনিচ্ছুক।
মাতাহারির জীবন বিশ্লেষণ করলে মনে হয় মাতাহারি আসলে একজন প্রকৃত শিল্পীই ছিলেন। তার জীবন পুরুষতন্ত্রের কাছে বিসর্জন দিতে হয়েছিল এবং মাতাহারিকে যতটা রহস্যময় বলে উপস্থাপন করা হয়েছে সত্যিই ততটা রহস্যময় কি না সে প্রশ্ন অনেকের। তবে এ কথা ঠিক যে, মাতাহারির জীবন বিচিত্র উত্থান-পতনে পরিপূর্ণ।
১৮৭৬ সালের ৭ আগস্ট হল্যান্ডের লিউওয়াডেনে মাতাহারির জন্ম। মা ছিল জাভানিজ অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়া জাভা দ্বীপের অধিবাসী। ওই সময়ে ইন্দোনেশিয়া হল্যান্ডের কলোনি ছিল বলেই এ রকম বিবাহ সম্ভব হয়েছিল। মা জাভানিজ বলেই মার্গারিটার মুখে এক ধরনের ভিন্ন সৌন্দর্য ছিল। মার্গারিটার বাবা টুপির ব্যবসা করতেন। অবস্থা বেশ সচ্ছলই ছিল।
বালিকা মার্গারিটা ভালো স্কুলে পড়ত। বালিকার মনটি ছিল শিল্পপ্রবণ। নাচগান ভালো লাগত। গাইতে পারত এবং নাচতেও পারত। হয়তো একা একা নাচত। মার্গারিটার যখন তেরো বছর বয়স তখন সংসারে বিপর্যয় নেমে এলো। বাবা দেউলিয়া হয়ে গেল। তারপর মা-বাবার মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটল। তবে মার্গারিটার একজন অভিভাবক ছিল। তারই সহযোগিতায় স্কুলের পড়াশোনা চালিয়ে যায় মার্গারিটা। কিন্তু স্কুলের হেডমাস্টার কিশোরী মার্গারিটার ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। তারপর আর মার্গারিটার পড়া হয়নি। মার্গারিটা একে সুন্দরী তার ওপর হাঁটাচলায় নৃত্যের ছন্দ। ১৮ বছরের এক কিশোরী পুরুষশাসিত পৃথিবীতে একা। একজন শক্ত-সমর্থ পুরুষের নিরাপত্তা বলয় অনুভব করছিল মার্গারিটা। এক বিজ্ঞাপনে বিয়ের আহ্বানে সাড়া দিল। ডাচ আর্মির সামরিক অফিসার কর্নেল ক্যাম্পবেল ম্যাকলয়েড।
তিনি বিয়ে করতে চান। কর্নেলের বয়স মার্গারিটার চেয়ে ২০ বছরের বেশি। কিন্তু কিছু করার নেই। ১৮৯৫ সালের ১১ জুলাই বিয়ে হলো। বিয়ের চার মাস পর স্বামীর সঙ্গে জাভা এলো মার্গারিটা। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে হয়। তবে একটি বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে। শিশুদের নার্সের প্রেমিক শিশু দুটিকে বিষ খাওয়ায়। ঠিক কী কারণে বিষ খাওয়ায় তা এখনো অজানা রয়ে গেছে। মেয়েটি বেঁচে গেলেও ছেলেটি মারা যায়। এরপর পারিবারিক দিক থেকে ঘনিয়ে আসে ভাঙন।
ক্যাম্পবেল ম্যাকলয়েড অ্যালকোহোলিক হয়ে ওঠে। সব সময় মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকে। মার্গারিটা হল্যান্ডের রাজধানী আমস্ট্রাডাম চলে আসে। মদ্যপ স্বামীর সঙ্গে সংসার করা কঠিন। বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে ১৯০৬ সালে। মেয়েটি অবশ্য বাবার কাছেই রয়ে গেল। এরপর পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াল মার্গারিটা। নাম বদলে রাখল মাতাহারি। জাভায় শেখা নাচ নিয়ে বার্লিন থেকে প্যারিস ছুটে বেড়াল। সে সঙ্গে মাতাহারি নামটিও ইউরোপে তীব্র আলোড়ন তুলল। প্রথম মহাযুদ্ধে হল্যান্ড ছিল নিরপেক্ষ। মাতাহারি হল্যান্ডের নাগরিক। কাজেই যুদ্ধকালে মাতাহারির পক্ষে ইউরোপীয় সীমান্ত অতিক্রম করা সহজ ছিল। যুদ্ধ চলাকালে নাচের দল নিয়ে জার্মান যেত মাতাহারি। ওখানে তার অনেক অনুরাগী ছিল। অনুরাগীদের মধ্যে জার্মান সামরিক অফিসার থাকাও তো বিচিত্র নয়। মাতাহারির ঘনঘন জার্মানি যাওয়ার বিষয়টি ফরাসি গোয়েন্দা বিভাগের নজরে আসে।
মাতাহারি ফরাসি না হওয়ায় তাদের সন্দেহ হয়। মাতাহারিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। স্পেনও প্রথম মহাযুদ্ধে নিরপেক্ষ ছিল। ফরাসি গোয়েন্দারা স্পেনে জার্মান নৌ ও সামরিক স্থাপনার খবরাখবর জানার জন্য মাতাহারিকে নির্দেশ দেয়। পরে আবার ফরাসি গোয়েন্দা বিভাগ মাতাহারিকে ডবল এজেন্ট ভাবে।
১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাতাহারি ফ্রান্সে ফিরে এলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। মাতাহারি জার্মান গুপ্তচর এই অভিযোগে তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। বিচার চলাকালে মাতাহারি অবশ্য কিছু প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেনি। মাতাহারির মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ১৯১৭ সালের ১৫ অক্টোবর।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.