শিয়া-সুন্নী বিরোধ শুরু হয় যেভাবে
শিয়া-সুন্নী বিরোধকে অনেকে ফিকহী বিরোধ মনে করলেও এটি আসলে রাজনৈতিক বিরোধ। এটি মোটেই ফিকহী কিছু নয়।আজ আমরা সেই বিষয়ে কিছু জানার চেষ্টা করবো। মুসলিম জাতিটির দুর্যোগ শুরু হয়েছে নবী মুহম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যুর পরপরই। একদিকে যখন রাসূল (সাঃ) এর দাফন নিয়ে ব্যাস্ত তখনই কিছু আনসার নেতা মুসলিমদের পরবর্তী নেতা নির্বাচনের জন্য একত্রিত হয়ে গেলেন। এই নিয়ে নবীজির মৃতদেহ দাফন না করেই মক্কার মুহাজির ও মদিনার আনসাররা সেদিন খিলাফতের নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলো। একটি সদ্য প্রতিষ্ঠিত আদর্শিক সংগঠনের এতো তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়া সত্যিই হতাশার।
ইসলাম যেকারনে এসেছিলো, তার মৌলিক উদ্দেশ্যটি কখনোই বাস্তবায়ন হতে পারে নি। মুহম্মদ (সাঃ) আরবের যতটুকু সংস্কার করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরেই তা আবার আগের দিকে ইউটার্ন নেয়। উনার ঘনিষ্ট লোকেরাই একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলো। আমরা যাদেরকে সাহাবী বলে থাকি। যাই হোক এরপর নবীজীর দাফন না হতেই নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে পরবর্তি খলিফা হযরত আবু বকর নির্বাচিত হন। পুরো বিষয়টা হযরত আলী রা: নিকট অজানা ছিল। এতে কষ্ট পান তিনি। কারণ নবীজির একমাত্র উত্ত্রাধিকার ছিলেন তিনিই।
ক্ষমতার দ্বন্দ্বটি ছিলো মূলত মক্কার কুরাইশ বংশের হাশেমি ও উমাইয়া গোত্রের মধ্যে। হাশেমি গোত্র ছিলো নবী মুহম্মদ (সাঃ) এর নিজ গোত্র। আর উমাইয়া গোত্র ছিলো হাশেমি গোত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী। হাশেমি গোত্রে একজন নবী এসেছেন, এটা উমাইয়া গোত্রের লোকেরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে নি। তাই শুরু থেকেই হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এবং ইসলামের প্রকাশ্য বিরোধীতা করেছে উমাইয়ারা। তাদের আশংকা ছিলো, মুহম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে হাশেমিরা আরবের নেতৃত্ব দখলে নিতে চাইছে। মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত উমাইয়া গোত্রের নেতৃস্থানীয় কেউই ইসলাম গ্রহণ করে নি। পরে অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা মুহম্মদ (সাঃ) এর আনুগত্য মেনে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু হাশেমি গোত্রের লোকদের কাছে এই আত্নসমর্পন তাদের জন্য ছিলো অপমানকর। তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। নবীজির মৃত্যুর পর তাদের সামনে সেই সুযোগটি আসে। সুযোগটি তারা কাজে লাগায়।
উমাইয়াদের চিন্তা ছিলো, কোনোভাবেই যেনো হাশেমিরা ক্ষমতায় যেতে না পারে। হাশেমি গোত্রের প্রতি এক ধরণের প্রতিশোধপরায়ণতা কাজ করছিলো তাদের মনে। কেননা, নবী মুহম্মদ (সাঃ) এর কারণে পুরো আরব জুড়ে ইতিমধ্যেই হাশেমিরা বেশ সম্মানজনক অবস্থানে পৌছে গিয়েছিলো। খলিফা নির্বাচনের সময় যখন আনসার বনাম মুহাজির দ্বন্দ্ব চরমে, সেই সংকটময় সময়ে হাশেমি গোত্রের অগ্রাধিকার ছিলো বেশি। যেহেতু এটা তাঁর নিজের গোত্র। এক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে একমাত্র হযরত আলী (রাঃ) ছিলেন হাশেমি গোত্রের। কিন্তু তিনি ছিলেন মুহম্মদ (সাঃ) এর শোকাহত পরিবারের কাছে, সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত। উমাইয়ারা নিজেদের কারো নামও প্রস্তাব করার সাহস করে নি। কারণ, প্রথমদিকে ইসলামের বিরোধীতা করায় তাদের অবস্থান ছিলো বিব্রতকর। যাইহোক, এমন পরিস্থিতিতে একজন নিরপেক্ষ গোত্রের ব্যক্তি প্রয়োজন। এমন একজন নিরপেক্ষ লোক ছিলেন তাঈম গোত্রের আবু বকর (রাঃ)। এবং আরেকজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব বনু আ’দি গোত্রের হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ) তাঁকে সমর্থন দেয়ায় পরিস্থিতি উমাইয়াদের অনুকূলেই যায়।
ইসলামের অন্যতম আদর্শিক মানব ছিলেন হযরত আবু বকর (রাঃ)। তাঁর বিশ্বাসের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ব্যক্তিজীবনেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত নির্লোভ। কিন্তু তাঁকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে ক্ষমতাপাগল উমাইয়ারা। আবু বকর (রাঃ) এর মৃত্যুর পর উমাইয়া নেতৃস্থানীয়রা আরেকজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে খলিফা হিসেবে দেখতে চাইলো। সেই নিরপেক্ষ লোকটি ছিলেন হযরত ওমর (রাঃ)। তবুও হাশেমি গোত্রের কাউকে নয়। হযরত ওমর (রাঃ) এর মৃত্যুর পর খলিফা হন হযরত উসমান (রাঃ)। যিনি ছিলেন উমাইয়া গোত্রের। ক্ষমতার পালাবদলে হাশেমিদের বঞ্চিত করে রাখাটা ভালো চোখে দেখেনি হাশেমি গোত্রের মুসলিমরা। তারা ক্রমেই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠে। তাদের ভাবগুরু ছিলো হযরত আলী (রাঃ)। এদিকে হযরত উসমান (রাঃ) যখন আততায়ীর হাতে নিহত হলেন, তখন এর দায় চাপানো হলো আলী (রাঃ) এর উপর। উমাইয়া গোত্রের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা দামেস্কের আমির মুয়াবিয়া ঘোষণা করেন, উসমান হত্যার বদলা না নেওয়া পর্যন্ত আলীর আনুগত্য মানবো না। এ কথা শুনে আলী (রাঃ) মুয়াবিয়কে দামেস্কের আমির পদ থেকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নেন।
সদ্যই নিহত খলিফা হযরত উসমান (রাঃ) ছিলো উমাইয়া গোত্রের। তাই উমাইয়া গোত্রের সকল মুসলিমদের মাঝে পুরনো গোত্র দ্বন্দ্ব আবার জাগ্রত হয়। তারা হাশেমি গোত্রের প্রতি প্রতিশোধপরায়ন হয়ে উঠে। এদিকে হাশেমি গোত্রও দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে উমাইয়াদের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ হয়ে ছিলো। ফলে যা হবার তাই হলো। আরব উপদ্বীপে রক্তপাত অবধারিত হয়ে পড়ে। হাশেমি ও উমাইয়া গোত্রের পুরনো বংশগত দ্বন্দ্ব আলী ও মুয়াবিয়ার মাধ্যমে পুনরায় সক্রিয় হয়। হযরত আয়েশা (রাঃ) ছিলো মুয়াবিয়ার পক্ষে। যেখানে নেতৃস্থানীয় সাহাবিরাও পরিষ্কার ভাবে দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। এই বংশগত দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে কারবালায় । যেখানে মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদের সৈন্যরা আলী’র পুত্র হোসাইন (রাঃ) ও তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
এরপর থেকে হাশেমিয়রা আবার দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। রাসূল সা: এর চাচা আব্বাসের বংশের লোকেরা ও তাদের অনুসারীরা আব্বাসীয় হিসেবে পরিচিত হন এবং ইমাম হাসান-হোসেনের বংশধরেরা ও তাঁদের সমর্থকেরা ফাতেমীয় হিসেবে পরিচিত হন। এই ফাতেমীয়রাই এখন শিয়া হিসেবে বিশ্বে পরিচিত।
হাশেমি ও উমাইয়া গোত্রের এই বংশগত দ্বন্দ্বই মূলত আজকের শিয়া ও সুন্নি বিরোধের মূল। যে দ্বন্দ্বের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে মুসলিম জাতির আরো অসংখ্য বিরোধ। যা তিলে তিলে শেষ করেছে একটি আদর্শিক সংগঠনের প্রকৃত সৌন্দর্যকে। এরপর এটি আরো মারাত্বক রূপ লাভ করে যখন ধর্মীয় গুরুরা এটিকে মাযহাবের দিকে নিয়ে গিয়ে ইবাদতের পদ্ধতিতে ভিন্নতা নিয়ে এসেছিলো।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.