টিপু সুলতান কি আসলেই খলনায়ক?
শিল্পীর কল্পনায় টিপু সুলতান, ছবি: Emit Post
মহীশুরের টিপু সুলতান উপমহাদেশের গর্ব। একমাত্র টিপু সুলতানের প্রতিরোধের কারণেই ইংরেজরা পুরো ভারত দখল করতে সমর্থ হয় নি। ইদানিংকালে ভারতীয়দের মধ্যে টিপুকে নিয়ে কিছু ইতিহাস বিকৃতি ছড়ানো হচ্ছে। টিপু সুলতানকে খলনায়ক বানানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে।
এটা শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে দেশটির কর্ণাটক রাজ্য একটি প্যারেড বের করা হয়, যাতে একবারে সম্মুখভাগে ছিলো তরবারি হাতে টিপুর একটি চলমান ভাষ্কর্য। প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতীয় জাতীয়তার প্রতীক হিসাবে টিপুকে গ্রহণ করা যেতে পারে কিনা, তাই নিয়েই উত্তপ্ত আলোচনা শুরু হয় টুইটারে। তাদের যুক্তি টিপুর আমলে হাজার হাজার হিন্দু ইসলাম গ্রহন করে এবং ভারতের হিন্দুদে সংখ্যা এতে অনেক কমে যায়। টিপুর অত্যাচারের স্বিকার হয়ে সাধারণ হিন্দুরা বাধ্য হয়ে ধর্মান্তারিত হয়। কিন্তু ঘটনা সত্যতা কতটুকু!?
টিপু সুলতান, ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে দেশটির কর্ণাটক রাজ্য প্যারেডে টিপু সুলতানের ভাস্কর্য, ছবি: Zee News
আজ থেকে কয়েকশ’ বছর আগে ভারতের কেরালা অঙ্গরাজ্যে হিন্দুদের মধ্যে এক প্রকার ট্যাক্স বা কর প্রচলিত ছিলো। করটির নাম- ‘স্তনকর’ বা ‘breast tax’। এর আরেকটি নাম মুলাককারাম (mulakkaram)।
স্তনকর বা ব্রেস্টট্যাক্স বা মুলাককারাম কি?
ঐ সময় নিয়ম ছিলো শুধূ ব্রাহ্মণ ব্যতিত অন্য কোন হিন্দু নারী তার স্তনকে ঢেকে রাখতে পারবে না। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ শ্রেণীর হিন্দু নারীরা তাদের স্তনকে একটুকরো সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পারতো, বাকি হিন্দু শ্রেণীর নারীদেরকে প্রকাশ্যে স্তন উন্মুক্ত করে রাখতে হতো। তবে যদি কোন নারী তার স্তনকে কাপড় দ্বারা আবৃত করতে চাইতো, তবে তাকে স্তনের সাইজের উপর নির্ভর করে ট্যাক্স বা কর দিতে হতো। এই নির্মম করকেই বলা হয় স্তনকর বা ব্রেস্টট্যাক্স।
১৮০৩ সালে নাঙ্গেলী (Nangeli) নামক এক নারী তার স্তনকে আবৃত করে রাখে। যথন গ্রামের ট্যাক্স কালেকটর তার থেকে স্তনকর চাইতে আসে, তখন নালেঙ্গী তা দিতে অস্বীকার করে এবং নিজের দুটি স্তনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে পাতা দিয়ে মুড়ে ট্যাক্স কালেকটরকে দিয়ে দেয়। তখন কাটা স্তন দেখে ট্যাক্স কালেকটর অবাক হয়ে যায়। স্তন কেটে ফেলার কিছুক্ষন পরেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য নাঙ্গেলীর মৃত্যু হয়। স্ত্রীর মৃত্যু শোকে নালেঙ্গীর স্বামীও সাথে সাথে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনার পর থেকেই স্তনকর রহিত হয়।
তুলির আঁচড়ে নাঙ্গেলি ও তার ঘটনা, ছবি: India TV
তবে স্তনকর রহিত হলেও দক্ষিণভারতে নারীদের স্তন আবৃত করার জন্য বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে। এমনকি বিষয়টি নিয়ে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা পর্যন্ত করতে হয়েছে তাদের। ১৯ শতাব্দীর মাঝে এসে যখন কিছু হিন্দু নারী তাদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করার অধিকার দাবি করে, তখন হিন্দু পুরোহিতরা স্পষ্ট করে বলে দেয়, নিচু বর্ণের নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করা ধর্ম বিরোধী। বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৯ সালে দক্ষিণ ভারতে একটি দাঙ্গা সংগঠিত হয়। এই দাঙ্গার উদ্দেশ্য ছিলো হিন্দু নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করার অধিকার আদায় করা। এই দাঙ্গায় ‘কাপড়ের’ দাঙ্গা হিসেবেও পরিচিত।
ইদানীং কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন- টিপু সুলতান নাকি তরবারির ভয় দেখিয়ে অনেক হিন্দু নারীকে মুসলিম বানিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। ইতিহাস বলছে, ঐ সময় টিপু সুলতান হিন্দুদের বর্ণপ্রথার এই অন্যায় রীতিকে মোটেও পছন্দ করেননি। তিনি চেয়েছেন এই নগ্নতা বন্ধ হোক। তিনি হিন্দু নারীদের আহবান করেছিলেন-
“যদি তোমরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো, তবে কাপড় পরার অধিকার পাবে।” – টিপু সুলতানের এ কথা শুনে হাজার হাজার হিন্দু নারী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলো।
এ সম্পর্কে হিন্দু ইতিহাসবিদ সুরজিত দাসগুপ্ত বলে- “ঐ সময় হিন্দু নিম্নবর্ণের লোকদের উর্ধাঙ্গ অনাবৃত রাখতে হত। সে সময় ভারতবর্ষের কেরালাতে অমুক হিন্দু নারী ইসলাম গ্রহণ করেছে এটা বলার প্রয়োজন ছিলো না, বলতে হতো শুধু ‘কুপপায়ামিডুক’ শব্দখানা। এ শব্দখানার অর্থ ‘গায়ে জামা চড়িয়েছে’। (সূত্র: বই-সুরজিত দাসগুপ্তের ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’, পৃষ্ঠা: ১৩০-১৩১)
‘কাউন্টার কারেন্টস’ এ প্রকাশিত এক লেখায় সুভাষ গাতাদি দাবি করেন, কর্ণাটকের উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী টিপু বিদ্বেষ ছড়িয়ে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করে। এই উগ্রবাদী শক্তিগুলোর রাজনীতির রূপ আবার নানা রকম। বছর পাঁচেক আগের কথা ধরা যাক। কর্ণাটক রাজ্যের বিজেপি থেকে বেরিয়ে গিয়ে কর্ণাটক জনতা পক্ষ নামের এক দল খোলেন হিন্দুত্ববাদী নেতা বি.এস. য়েদ্দিউরুপ্পা। নির্বাচনী প্রচারণার সময় মুসলিম ভোটারদের কাছে নিজেকে তুলে ধরতে অন্য রকম এক পদক্ষেপ নেন য়েদ্দিরুপ্পা। টিপু সুলতানের সেই বিখ্যাত তলোয়ার এবং তাঁর রণকৌশলের অনুকরণে এক সুন্দর মহড়া বা ‘সোর্ড ড্যান্স’-এর আয়োজন করেন তিনি।
এরপর গঙ্গায় অনেক জল বয়ে গেছে। নির্বাচনের বৈতরণী পেরিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালে নিজের গড়া দল নিয়ে ফের ভিড়েছেন বিজেপিতে। গদিতে বসার পরপরই রাজ্যের জনপ্রিয় উৎসব ‘টিপু জয়ন্তী’ বন্ধের উদ্যোগ নেন তিনি। এ লক্ষ্যে জোর জনসংযোগও শুরু করেন। ভারতের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক বিভেদ যতই জোরালো হচ্ছে, ততই জোরালো হচ্ছে টিপু বিদ্বেষ।
কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী দল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ও সত্তরের দশকে টিপু সুলতানের নামে এক জীবনী প্রকাশ করে, যেখানে তাঁর নামে কোনো ধরনের নিপীড়নের অভিযোগ আনা হয়নি। টিপু সুলতান ইস্যুতে আরএসএসের অবস্থান এখন প্রায় উল্টো।
ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে অর্থাৎ টিপু সুলতানের মৃত্যুর পরপরই অনেকগুলো লোকসংগীত ও শোকগাঁথা রচিত হয়, যা কালের ধারাবাহিকতায় এখনও জনপ্রিয়। কর্ণাটকের লোকসাহিত্যের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ব্রিটিশবিরোধী হাতেগোনা কিছু গোত্রপতি ছাড়া আর কোনো সম্রাটকে নিয়ে কর্ণাটকে শোকগাথা রচিত হয়নি। আর এই শোকগাথা বা ‘লাভানা’গুলোর জনপ্রিয়তাই এই নেতার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.