ম্যলেরিয়া কী? বাঁচবেন কী করে?
ম্যলেরিয়া জীবাণুর জীবনচক্র, ছবি: যুগান্তর
ইতালিয় শব্দ Mal (অর্থ- দূষিত) ও aria (অর্থ- বায়ু) হতে Malaria (ম্যালেরিয়া) শব্দটি এসেছে। তখন মানুষ মনে করতো দূষিত বায়ু সেবনে এ রোগ হয়। ম্যলেরিয়া হল মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীদের একটি মশা-বাহিত সংক্রামক রোগ যার মূলে রয়েছে প্লাজমোডিয়াম গোত্রের প্রোটিস্টা। এটি এক ধরনের অণুজীব।
সংক্রমিত স্ত্রী আনোফেলিস মশার কামড় সাথে এটি শুরু হয়, যা তার লালা মাধ্যমে প্রোটিস্টর সংবহন তন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে এবং শেষে যকৃতে পৌছায়, যেখানে তারা পরিপক্ক হয় এবং বংশবৃদ্ধি করে। ম্যালেরিয়ার সাধারণ রোগের লক্ষণসমূহ হল জ্বর এবং মাথা ব্যাথা, যা খুব গুরুতর ক্ষেত্রে কোমা বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। রোগটি ক্রান্তীয় অঞ্চল, উপ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং অনেক সাহারা-নিম্ন আফ্রিকা, এশিয়া এবং আমেরিকা অঞ্চলসহ বিষুবরেখা ঘিরে ব্যাপক বিস্তৃত।
এনোফিলিস মশা, ছবি: ডিএমপি নিউজ
মানুষের দেহে পাঁচটি প্রজাতির প্লাজমোডিয়াম প্রেরণ এবং সংক্রমণ ঘটতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হল প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম, প্লাজমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স, প্লাজমোডিয়াম ওভাল এবং প্লাজমোডিয়াম ম্যালেরি, সাধারণত এটি ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ঘটায় যা খুব কম ক্ষেত্রেই মারাত্মক হয়ে থাকে।
ম্যালেরিয়া ক্রান্তীয় অঞ্চল, উপ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বেশি দেখা যায় কারণ বৃষ্টিপাত, উষ্ণ তাপমাত্রা, এবং বদ্ধ জলাশয় হল মশার ডিমের জন্য আদর্শ আবাসস্থল। মশারি এবং পোকা তাড়ানোর ঔষধ ব্যবহার করে মশার কামড় থেকে বাঁচা যায় অথবা কীটনাশক স্প্রে ব্যবহার এবং স্থায়ী পানি নিঃশেষিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে রোগের বিস্তার থেকে বাঁচা যায়।
ম্যালেরিয়া সাধারণত ব্লাড ফিল্মস ব্যবহার করে রক্তের দূরবীক্ষণ পরীক্ষা অথবা অ্যান্টিজেন-ভিত্তিক দ্রুত ডায়গনিস্টিক পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। আধুনিক প্রযুক্তিতে প্যারাসাইটের ডিএনএ সনাক্ত করার জন্য পলিমারেজ শৃঙ্খল বিক্রিয়ার ব্যবহার উন্নত করা হয়েছে, কিন্তু এর খরচ ও জটিলতার জন্য ব্যাপকভাবে ম্যালেরিয়া-কবলিত এলাকায় ব্যবহার করা হয় না।
২০১০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আনুমানিক ২১৯ মিলিয়ন ম্যালেরিয়ার ঘটনার স্থান নিশ্চিত করেছে। সেই বছরই, ৬,৬০,০০০ থেকে ১.২ মিলিয়ন মানুষ ম্যালেরিয়ার রোগে মারা যায়, যাদের অধিকাংশই ছিল আফ্রিকার শিশুরা। প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা নিশ্চিতভাবে জানা যায় নি, কারণ অনেক গ্রামীণ এলাকার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। ২০১১ সালে ৯৯টি দেশের একটি রিপোর্ট অনুসারে ম্যালেরিয়া সংক্রমণের কারণে ১,০৬,৮২০ জনের মৃত্যু হয়। ম্যালেরিয়া জনিত মৃত্যু সাধারণত দারিদ্রতার সাথে সম্পর্ক যুক্ত।
প্রত্যেক বছর প্রায় ৫১.৫ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন এবং প্রায় দশ থেকে ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারান যাদের মধ্যে বেশিরভাগই আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের শিশু। ম্যালেরিয়া খুবই পরিচিত একটি সংক্রামক রোগ এবং এটি একটি বৃহৎ জনস্বাস্থ্য সমস্যা।
ম্যলেরিয়ার লক্ষণ:
১. প্রথম দিকে মাথাধরা, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, অনিদ্রা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
২. দ্বিতীয় পর্যায়ে রোগীর শীত শীত অনুভূত হয় এবং কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। জ্বর ১০৫°-১০৬° ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। কয়েক ঘণ্টা পর জ্বর কমে যায়। পরে আবার আসে। ৪৮ ঘণ্টা পর পর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা Plasmodium vivax দ্বারা সৃষ্ট ম্যালেরিয়ার প্রধান লক্ষণ।
৩. তৃতীয় পর্যায়ে রোগীর দেহে জীবাণুর সংখ্যা অসম্ভব ভাবে বেড়ে গেলে দ্রুত রক্তে লোহিত রক্ত কণিকা ভাঙতে থাকে, ফলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। যকৃত বড় হয় ও সংক্রমিত হয়। প্লীহা, মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে।
চিকিৎসা:
ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় আগে মুখে খাওয়ার ঔষধ ক্লোরোকুইন ব্যবহার করা হতো৷ ক্রমে এর কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় বর্তমানে অন্যান্য বিভিন্ন ঔষধ ব্যবহার করা হয়৷ যার মধ্যে বাংলাদেশে কো-আর্টেম ব্যবহার করার নিয়ম সম্প্রতি চালু হয়েছে৷ যদিও ভাইভেক্স ম্যালেরিয়ায় এখনো ক্লোরোকুইন কার্যকর ঔষধ হিসেবে বাংলাদেশে স্বীকৃত৷ সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া (মারাত্মক ম্যালেরিয়া)-র রোগীকে মুখে খাওয়ার ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়৷ ফলে এদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হয়৷ এখনো কুইনাইন ইনজেকশন স্যালাইনের মাধ্যমে প্রদান করাই হচ্ছে মারাত্মক ম্যালেরিয়ার মূল চিকিৎসা৷ এ ধরনের রোগীর প্রয়োজনীয় নার্সিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধের উপায়:
ম্যালেরিয়াবাহী মশা মূলত সন্ধ্যা থেকে ভোরের মধ্যে কামড়ায়। এ সময়টাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। সন্ধ্যা থেকে শোয়ার আগে আর শোয়ার পর থেকে ভোর পর্যন্ত বিছানায় যাওয়ার আগে শরীরের খোলা অংশগুলোতে মশা তাড়ানোর ক্রিম লাগানো যেতে পারে। কিন্তু এ ক্রিমগুলোর কার্যকারিতা স্বল্পস্থায়ী। মশারি ব্যবহার না করলে মশা তাড়ানোর ধুপ ও ম্যাট ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়িঘর ও আশপাশে যাতে মশা বংশবৃদ্ধি করতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কোথাও অবাঞ্ছিত পানি জমতে দেওয়া যাবে না। ওষুধ খেয়ে ম্যালেরিয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পদ্ধতিটি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয়। কোনো অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব থাকলে সে স্থানে যাবার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কলোরোকুইন বা প্রগুয়ানিল জাতীয় ঔষধে এ রোগের প্রকোপ থেকে বাঁচা যায়।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.