পৃথিবীর জাহান্নাম গুয়ানতানামো বে
গুয়ানতানামো বে কারাগার, বাইরের দৃশ্য। ছবি: The Onion
বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কারাগারটির নাম গুয়ানতানামো বে। সিআইএ ও মার্কিন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন গুয়ানতানামো বে বন্দীশিবির বিশ্বব্যাপী কোটি মানুষের আগ্রহের এক কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি না থাকায় প্রায় এক দশক সেখানে বহিরাগত কারও পা পড়েনি। বেশ কয়দিন আগে একাধিক সাংবাদিকের সুযোগ হয়েছে কারাগারটি পরিদর্শনের। আর তাদের বর্ণনায় উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর এ কারাগারের দুর্ধর্ষ চিত্র।
গুয়ানতানামো বে কারাগারে আটক কিছু বন্দিদের দেখা যাচ্ছে। ছবি: The Daily Beast
বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন্দীশিবির। আরও সহজ করে বললে, বন্দী নির্যাতনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক আলোচিত কারাগার। এ কারাগারের মালিক পরাশক্তির শীর্ষ দেশ যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রশাসনের চোখে যারা ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী, তাদের আটক করার পর সেখানে বন্দী করে রাখা হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদের বিচারের জন্য নেওয়া হয় বিচ্ছিন্ন এ কারাগারে।
শাস্তি দেয়া হচ্ছে বন্দীদের, ছবি: The Independent
২০০২ সাল থেকে বন্দী নির্যাতনের জন্য আলোচনায় আসে গুয়ানতানামো বে কারাগার। মার্কিন সামরিক ঘাঁটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এ দ্বীপে সাধারণ পর্যটক তো দূরের কথা, কোনো সংবাদকর্মী বা মানবাধিকার কর্মীর প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। তবে ২০০২ সালে যখন বন্দী নির্যাতনের জন্য বিশ্বব্যাপী এ কারাগারটি নিয়ে মার্কিন প্রশাসন নিন্দার মুখে পড়ে, তখন বেশকিছু ভিডিওচিত্র গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। ওইসব ভিডিওচিত্রে দেখানো হয়, মার্কিন সেনারা বন্দীদের কমলা রঙের পোশাকে আবৃত করে চোখ-মুখ বেঁধে অমানবিক নির্যাতন করছে। এর পর থেকে দীর্ঘদিন কোনো সংবাদকর্মীকে এ কারাগারের ধারেকাছে ভিড়তে দেওয়া হয়নি।
২০০৮ সালে বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের দ্বিতীয় দিনেই কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে কারাগার বন্ধের জন্য লিখিত আদেশ দেন। তিনি বলেছিলেন কারাগারটির স্থাপন, পরিচালনা সবই অসাংবিধানিক। কাজেই যত দ্রুত সম্ভব এর কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলেন কিন্তু এখনো তার সেই নির্দেশ বাস্তবায়ন করা হয়নি।
আল-জাজিরার এক নিবন্ধে বলা হয়, গুয়ানতানামো দ্বীপটি যেন আইনের বাইরে। মার্কিন বাহিনী নিয়ন্ত্রিত গুয়ানতানামো বে কারাগারে এখনো জঙ্গি, সন্ত্রাসী সন্দেহে বিভিন্ন দেশের ১৭১ জন বন্দী আটক আছে। ইতোমধ্যে ৮০০ বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। গুয়ানতানামো বে কারাগারে বর্বরভাবে বন্দীদের নির্যাতন করা হয়। তাদের নির্দয়ভাবে পিটানো হয়। ঘুমাতে দেওয়া হয় না ঠিকভাবে। মানসিক নির্যাতনও চলে। অতি উচ্চ বা নিম্ন তাপমাত্রায় রাখা হয়। আর দীর্ঘদিন ধরে অন্ধকার এক প্রকোষ্ঠে আটকে রাখা হয়। যাদের গুয়ানতানামো কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, মনে করা হয়, তারা সবাই সন্ত্রাসী, জঙ্গি। তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ধরে আনা হয়েছে। তাদের কোনো আইনি অধিকার নেই। প্রকৃতপক্ষে, মোট বন্দীদের মধ্যে কেবল কিছুসংখ্যক বন্দীকে মার্কিন বাহিনী গ্রেফতার করে। বেশির ভাগ বন্দীই পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জঙ্গি, বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠীর সদস্য ও অন্যান্য কর্মকর্তা।
চোখ বেঁধে শাস্তি দেয়া হচ্ছে বন্দীদের, ছবি: Gray Panthers - San Francisco
গুয়ানতানামো বে কারাগারে প্রতিনিয়ত মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে মার্কিন বাহিনী। যার ফলে বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত মানুষের মানবাধিকারের রক্ষক হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র রীতিমতো প্রশ্নের সম্মুখীন। মার্কিন সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তা আছেন, যারা স্বীকার করেন গুয়ানতানামো বে কারাগারের কারণে অনেক সময় নতুন করে জঙ্গি, সন্ত্রাসী তৈরি হচ্ছে। তারা অনেক বেশি হিংস্র ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে মার্কিন বাহিনীর ওপর। প্রতিশোধপরায়ণও হয়ে উঠছে অনেকে। ফলে মার্কিনিদের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় আরও বাড়ছে। এ পর্যন্ত মাত্র ছয়জন বন্দীকে শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। ফলে কারাগারটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে অনেকে।
এ বন্দীশিবিরে যাদের আটক রাখা হয়েছে, তারা সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু বলে পরিচিত। এদের কেউ অস্ত্র নির্মাতা, কেউ সন্ত্রাসীদের শীর্ষ নেতা, আবার কেউ বা যুক্তরাষ্ট্রে বিধ্বংসী হামলা পরিচালনার পরিকল্পনাকারী। তাছাড়া বিশ্বজুড়ে পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত যুদ্ধে নিয়োজিত ব্রিটিশ ও মার্কিন সেনাদের হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে বন্দীদের এখানে আনা হয়। বিশেষ করে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারে হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটক সব সন্ত্রাসীকে রাখা হয়েছে এখানে। সব মিলিয়ে বর্তমানে এ কারাগারে বন্দীর সংখ্যা প্রায় ২০০।
ভয়ংকর ওয়াটার ট্রিটমেন্ট দেয়া হচ্ছে এক বন্দীকে, ছবি: firejohnyoo.net
বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, গুয়ান্তানামো বে-জেলবন্দীদের নিঃসঙ্গ খাঁচায় আটকে রাখা হয়। শোয়ার জন্য ১টি শক্ত শিট, দু’ভাঁজ করা ১টি কম্বল, পরার জন্য কমলা রংয়ের ইউনিফর্ম, পাতলা চপ্পল স্যান্ডেল দেয়া হয়। পৃথক কোন বাথরুমে যেতে দেওয়া হয় না। বরং ওই খাঁচাতেই ছোট ২টি বালতিতে তাদের মল-মূত্র ত্যাগে বাধ্য করা হয়। এমনকি সেগুলো সেখানেই রেখে দেওয়া হয়। আবার তাদের দিয়েই পরিষ্কার করানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় নিষ্ঠুর মারপিঠ করা হয়, দেওয়া হয় ইলেকট্রিক শক, নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়া হয়, বরফের উপর শুইয়ে রাখা হয়। উলঙ্গ করে হাত-পা বেঁধে শিকারী কুকুর লেলিয়ে দেয়া হয়।
৯/১১-এর পরবর্তী সময়ে ‘শত্রু যোদ্ধা’দের আটক রাখতে ২০০২ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এ কারাগার চালু করেন। দক্ষিণ কিউবায় অবস্থিত মার্কিন সেনাঘাঁটিতে এ কারাগার অবস্থিত। ১৯০৩ সালের হাভানা চুক্তির আওতায় কিউবা থেকে ইজারা নিয়ে মার্কিন ঘাঁটি তৈরি করা হয়। কারাগারটি চালু করার পর থেকে বেশ দ্রুত এর কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়ায়। খাঁচার ভেতর বেড়ি ও হাতকড়া পরা কয়েদিদের ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর এ কারাগার ঘৃণার প্রতীক হিসেবে পরিচিত হয় মানুষের কাছে।
কুকুর দিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে এক বন্দীকে, ছবি: alaskareport.com
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বারবার এ কারাগার বন্ধ করার ঘোষণা দিলেও কংগ্রেসের বাধার কারণে তাঁর উদ্যোগ আংশিক ব্যাহত হয়। কংগ্রেস এ কারাগার যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তর করতে চায়নি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই কারাগারটি আবার চালু করার ঘোষণা দিয়েছে।
বর্তমানে ওই কারাগারে বন্দীর সংখ্যা ১৪৯ জন। এর মধ্যে ৭৮ জনকে ‘যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি না হওয়ায়’ মুক্তি দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫৮ জন ইয়েমেনি, পাঁচজন তিউনিসিয়ান, চারজন আফগান ও চারজন সিরীয় নাগরিক রয়েছেন।
বাকি ৭১ জন বন্দীর ১০ জন ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সেনা কমিশন কর্তৃক অভিযুক্ত হয়ে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আর ৩৮ জনকে মামলা পুনর্বিবেচনা করার জন্য যোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। গত সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া পাঁচজন তালেবান নেতা এই ৩৮ জনের মধ্যে ছিলেন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.