ভারতের জাতীয় পতাকা উড়ছে ধর্ষকের জন্য
যারা এখন আসিফার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার বিবরণ পড়ে চমকে উঠছেন, তাদের কাছে অনুরোধ, একে নিছক খুন না ধর্ষণ হিসেবে দেখবেন না। একের পর এক ঘটনাবলী দেখুন।
আসিফার অন্তর্ধানের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে, গুজার সম্প্রদায় প্রতিবাদ ডাকে। অবরোধ করে মহাসড়ক। তখনই পুলিশ বাধ্য হয়ে দুই কর্মকর্তাকে তদন্তে নিয়োগ দেয়। কিন্তু এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার একজনকেই খোদ পরে এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়। ওই পুলিশ সদস্যের নাম দীপক খাজুরিয়া।
পাঁচদিন বাদে আসিফার লাশ পাওয়া যায়। লাশ পাওয়ার খবর পেয়েই স্বামীর সঙ্গে দৌঁড়ে বনের দিকে যান নাসিমা। তিনি বলেন, ‘আসিফাকে নির্যাতন করা হয়েছে। তার পা ভাঙ্গা ছিল। তার নখ কালো হয়ে ছিল। তার বাহু আর আঙ্গুলে নীল আর লাল ছোপ ছোপ দাগ ছিল।’
তদন্তকারীরা কী মনে করেন?
২৩শে জানুয়ারি, অর্থাৎ আসিফার লাশ উদ্ধারের ছয় দিন পর, জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি রাজ্য পুলিশের বিশেষ ইউনিটকে এই ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তকারীরা বলছেন, আসিফাকে বেশ কয়েকদিন স্থানীয় একটি মন্দীরে বন্দী রাখা হয়। তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে অচেতন করে রাখা হয়। চার্জশিটে বলা হয়, আসিফাকে ‘কয়েক দিন ধরে ধর্ষণ, নির্যাতন করে শেষ অবদি হত্যা করা হয়।’ তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। পরে তার মাথায় পাথর দিয়ে দু’বার আঘাত করা হয়।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, সঞ্জি রাম নামে ৬০ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারী কর্মকর্তা পরিকল্পনা করে এই কাজ করেন। তাকে সহায়তা করেন সুরেন্দ্র ভার্মা, আনন্দ দত্ত, তিলক রাজ ও খাজুরিয়া নামে চার পুলিশ কর্মকর্তা। সঞ্জি রাম ছাড়াও তার ছেলে বিশাল, তার ভাতষ্পুত্র ও তার বন্ধু পরবেশ কুমারের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়।
পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরেক ধরণের। খাজুরিয়া সহ চার পুলিশ কর্মকর্তা আসিফার রক্তাক্ত লাশ ও কর্দমাক্ত কাপড় পরা অবস্থায় পেলেও, তা ধুয়ে মুছে তারপর ময়নাতদন্তের জন্য পাঠান। তদন্তকারীদের ধারণা, অভিযুক্তরা গুজার সম্প্রদায়কে জম্মু ছাড়তে বাধ্য করতেই এই অপরাধ সংঘটন করেন। যাযাবর এই সম্প্রদায় পশুপালনের কাজে জম্মুর সরকারী ও বনের জমি ব্যবহার করেন।
আসিফা একটি ৮ বছরের শিশু। কাশ্মীরের বাখারওয়াল মুসলিম উপজাতির সদস্য। জম্মুর কাঠুয়া অঞ্চল থেকে এই উপজাতি দলটিকে বিতাড়ন করবার উদ্দ্যেশ্যে তাদের ভয় দেখাতে হবে। তাই আসিফাকে অপহরণ এবং ধর্ষণ। এখানে ধর্ষণ হলো রাজনৈতিক রণকৌশল। বা হয়তো শুধু কৌশল নয়, ধর্ষণই রণনীতি।
এক এক করে দেখি আসুন। আসিফাকে অপহরণ করে তাকে একটি মন্দিরের পুজোগৃহে হাত পা বেধে রাখা হলো প্রায় ৭ দিন ধরে। তাকে ওষুধ খাইয়ে আছন্ন রাখা হলো। বারংবার ধর্ষণ করা হলো। ধর্ষণের সময় অঞ্চল থেকে বাখরাওয়ালদের পলায়ন চেয়ে ধর্ষকরা পুজোআচ্চাও করলো। ধর্ষকরা ডেকে আনলো স্পেশ্যাল পুলিশ অফিসারকে। সেও ধর্ষণ করলো। এরমধ্যে একজন মীরাট থেকে তার বন্ধুকে ডেকে পাঠালো। সে মীরাট থেকে ধর্ষণ করতে চলে এলো। রেপ ট্যুরিজম। এরপর আসিফাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হলো। তারপর তার দেহ ফেলে দেওয়ার আগে শেষবারের মতন আরেকজন ধর্ষণ করলো। এরপর তার মৃতদেহকে বনে ফেলে দিয়ে পাথর দিয়ে মাথা থেতলে দেওয়া হলো।
পুলিশ প্রথমে মিসিং পার্সনস কমপ্লেন নেয়নি। নেওয়ার পর একে একে যখন গ্রেপ্তার করা শুরু করলো তখন অপরাধীদের সমর্থনে মিছিল মোর্চা মিটিং শুরু হয়ে গেলো। হিন্দু একতা মঞ্চ তৈরি হলো। বিজেপির এমএলএ, মন্ত্রী ধর্ষকদের সমর্থনে দাঁড়িয়ে গেলো। মহিলারা ধর্ষকদের সমর্থনে গায়ে আগুন দেওয়ার হুমকি দিলো। হিন্দু একতা মঞ্চ জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করলো। ভারতের তেরঙ্গা পতাকা কে ওড়ানো হলো ধর্ষণের বিজয়োৎসব পালন করতে। এই গোটা সার্কাসটার পরে যখন কোর্টে চার্জশীট ফাইল করতে গেলো পুলিশ, তখন জম্মু বার এসোশিয়েশনের উকিলরা অবরোধ করে স্লোগান দিলো 'জয় শ্রী রাম'। তারও পরে কোর্টের বিচারপতিরা পুলিশকে ৬ ঘন্টা অপেক্ষা করালো। চার্জশিট তারা নেবে না। ৬ ঘন্টা অপেক্ষারত পুলিশের থেকে শেষমেষ চার্জশিট গ্রহণ করা হলো।
আপনারা ভাবছেন এরকম কেন? ধর্ষকের সমর্থনে কি করে এতগুলো মানুষ মিছিল করে, জাতীয় পতাকা ওড়ায়, জয় শ্রীরাম স্লোগান দেয়? এতক্ষনে তাহলে আপনি সঠিক প্রশ্নটি করেছেন।
পুলিশ, এসপিও, এমএলএ, মন্ত্রী, উকিল, জাজ - এটাই হলো ভারত রাষ্ট্র। আর ওই ৮ বছরের শিশু আসিফা - ওটা হলো কাশ্মীর। এই প্রত্যেকটি লোক যারা মিছিল করছে, স্লোগান করছে - তাদের মাথায়, চেতনায়, তাই। তাই জন্যে ওদের কাছে এটা স্রেফ ধর্ষণ নয়, এখানে অপরাধীরা স্রেফ ধর্ষক নয়, আসিফা স্রেফ একটি বাচ্চা মেয়ে না। ওরাও জানে, একদম সবার চোখের সামনে ওরা প্রকাশ করে ফেলেছে ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্র আর কাশ্মীরের সম্পর্কটা ঠিক কি। সেই কাশ্মীর, যেখানে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রত্যেক তিনজন পুরুষের মধ্যে একজন ধর্ষিত। হ্যা ঠিক পড়েছেন, প্রত্যেক তিনজন পুরুষের মধ্যে একজন।
ওরা আসলে ধর্ষকদের স্বপক্ষে মিছিল করছে না। করছে নিজেদের স্বপক্ষে। কারন ওরা জানে, ওরা প্রত্যেকে এই অপরাধে অংশ নিয়েছে। এবং ওরা চায় আপনিও অংশীদার হন। তাই আপনার ধর্মীয়বোধকে উস্কাতে জয় শ্রীরাম, আপনার জাতীয়তাবোধকে উস্কাতে তেরঙ্গা পতাকা।
একটি ৮ বছরের ধর্ষিতা শিশুর মৃতদেহ লড়ছে। লড়ছে শুধু ধর্ষকদের বিরুদ্ধে না, কাশ্মীরে ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। ওদের তেরঙ্গা, ওদের ধর্ম পক্ষ বেছে নিয়েছে। ধর্ষকের পক্ষ।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.