শুভ জন্মদিন দ্য ভিঞ্চি

লিওনার্দোর জন্ম হয়েছিল ১৪৫২ সালের ১৫ এপ্রিল রাতে। তুসকান এর পাহাড়ি এলাকা ভিঞ্চি তে, আর্নো নদীর ভাটি অঞ্চলে। তিনি ছিলেন ফ্লোরেন্সের এক নোটারী পিয়েরে দ্য ভিঞ্চির এবং এক গ্রাম্য মহিলা ক্যাটরিনার অবৈধ সন্তান । ধারণা করা হয় তাঁর মা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত দাসী ছিলেন। আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে লিওনার্দোর নামে কোন বংশ পদবী ছিল না। “দ্য ভিঞ্চি” দিয়ে বোঝায় তিনি এসেছেন ভিঞ্চি নগরী থেকে। তাঁর পুরো নাম “লেওনার্দো দাই সের পিয়েরো দা ভিঞ্চি” এর অর্থ হল পিয়েরোর পুত্র লিওনার্দো এবং সে জন্মেছে ভিঞ্চিতে।
১৪৬৬ সালে লিওনার্দোর বয়স যখন ১৪, তখন তিনি ভ্যারিচ্চিও (Verrocchio)-র কাছে শিক্ষানবীশ হিসেবে যোগ দেন। ভ্যারিচ্চিও-র পুরো নাম “আন্দ্রে দাই সায়ন”, তিনি ছলেন সে সময়ের একজন সফল চিত্রকর। ভ্যারিচ্চিও-র কর্মস্থলে তৎকালীন গুণী মানুষদের সমাগম হত। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন গিরল্যান্ডিও (Ghirlandaio), পেরুগন (Perugino), লরেঞ্জো দাই ক্রিডি (Lorenzo di Credi)। এখানে কাজ করে লিওনার্দো হাতে কলমে প্রচুর কারিগরি জ্ঞানার্জন করেছিলেন। তার সুযোগ হয়েছিল কারুকার্য, রসায়ন, ধাতুবিদ্যা, ধাতু দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানানো, প্রাস্টার কাস্টিং, চামড়া দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানানো, গতিবিদ্যা এবং কাঠের কাজ ইত্যাদি শেখার। তিনি আরও শিখেছিলেন দৃষ্টিনন্দন নকশাকরা, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য তৈরি এবং মডেলিং। ভ্যারিচ্চিও বেশ কয়েকটি কাজে লিওনার্দো মডেল হিসেবে ছিলেন। যেমন- “ডেভিড” চরিত্রে “দি বার্জেলো” ( Bargello) নামক ব্রোঞ্জ মূর্তিতে, “আর্চঅ্যাঞ্জেল মাইকেল” হিসেবে “টোবিস এন্ড অ্যাঞ্জেল“(Tobias and the Angel) এ।
তিনি ছিলেন ইতালীয় রেনেসাঁসের কালজয়ী চিত্রশিল্পী। বহুমুখী প্রতিভাধর লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অন্যান্য পরিচয়ও সুবিদিত- ভাস্কর, সংগীতজ্ঞ, সমরযন্ত্রশিল্পী এবং বিংশ শতাব্দীর বহু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেপথ্য জনক। ১৪৭৮ সাল থেকে ১৫১৬-১৭ এবং ১৫১৯ সাল অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত গির্জা ও রাজপ্রাসাদের দেয়ালে চিত্রাঙ্কন এবং রাজকীয় ব্যাক্তিবর্গের ভাস্কর্য নির্মাণের পাশাপাশি বেসামরিক ও সামরিক প্রকৌশলী হিসাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান জ্ঞানের প্রয়োগ, অঙ্গব্যাবচ্ছেদবিদ্যা, জীববিদ্যা, গণিত ও পদার্থবিদ্যার মত বিচিত্র সব বিষয়ের ক্ষেত্রে তিনি মৌলিক উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দেন।
তাঁর বিখ্যাত শিল্পকর্ম গুলোর মধ্যে মোনালিসা, দ্য লাস্ট সাপার অন্যতম । লিওনার্দো যে ধারণাগুলোকে আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু প্রকাশ করেননি সেই সমস্ত ধারণাসমূহ আবার নতুন করে আবিষ্কার করেছেন অন্য বিজ্ঞানীরা । নিউটনেরও দু’শো বছর আগে লিওনার্দোর সময়ে একমাত্র যে উপায়ে বৈজ্ঞানিক ধারণাসমূহ প্রকাশ করা যেত তা হচ্ছে সেই বিষয়ে একটি বই প্রকাশ করা । এভাবেই গ্যালিলিও এক গাদা বই প্রকাশের মাধ্যমে বিজ্ঞানের ইতিহাসের গতিপথ পালটে দিয়েছিলেন । তার উল্লেখ্যযোগ্য দু’টো বই হচ্ছে, Dialogue on the Chief World Systems, Ptolemaic and Copernican (1632), এবং Discourses Concerning Two New Sciences (1638)। কিন্তু লিওনার্দোর অসংখ্য এক্সপেরিমেন্টস এবং সেগুলো থেকে প্রাপ্ত ফলাফল লিখে রাখা নোটবুকগুলো থেকে গেছে অজ্ঞাত । লিওনার্দো ঠিক কখন থেকে নোটবুক লেখা শুরু করেছিল সেটা বলা মুশকিল । কিছু কিছু ছবির পিছনে লিওনার্দো ব্যাক্তিগত নোট লিখে রাখতেন বা যাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে তাদের নাম ধাম লিখে রাখতেন । তিনি খুব কম সময়ই তার লেখালেখিতে তারিখ দিয়েছেন এবং তার আইডিয়া যাতে কেউ চুরি করতে না পারে সেজন্য লিওনার্দো মিরর ইমেজের মত অদ্ভুত উপায়ে তার নোটগুলোকে লিখতেন । ডান থেকে বামে লিখতেন তিনি এবং অক্ষরগুলো উল্টোদিকে ঘোরানো থাকতো । আয়নার সামনে নিলেই শুধুমাত্র প্রতিবিম্ব দেখে বোঝা যেতো আসলে কি লেখা আছে । এছাড়া সেগুলোর মধ্যেও তিনি তার নিজস্ব কোড ঢুকিয়ে দুর্বোধ্য করে দিতেন যাতে করে কেউ বুঝতে না পারে তিনি কি লিখেছেন । লিওনার্দোর মত আইজাক নিউটনও তার নোটে বেশিরভাগ সময়ই সন তারিখ লিখতেন না । কিন্তু তার নোটগুলোকে ছয়টি পরিষ্কারভাগে ভাগ করা যায় যেখানে তার হাতের লেখা বা তার লেখার উপকরণ অনেকখানি ভিন্ন ।
খেয়ালী এই মানুষটি এলোমেলোভাবে নোটবুকের পৃষ্ঠায় তার চিন্তাভাবনা লিখে রেখে গেছেন । তার নোট এবং ড্রয়িং থেকে দেখা যায় যে লিওনার্দো ব্যাপক বৈচিত্র্যময় বিষয়ের প্রতি আগ্রহী ছিলেন । তার চুড়ান্ত চিন্তাভাবনা কি তা বর্তমানে জানা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আর মজার বিষয় হচ্ছে যে, সবকিছুই তিনি অসমাপ্ত রেখে গেছেন । আসলেই কি লিওনার্দোর সবগুলো কাজ তার একক চিন্তাশক্তির ফসল নাকি তিনি অসংখ্য মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে আরও ব্যাপক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তুলে এনেছেন শক্তিশালী করে ? "ইটালিয়ান রেনেসা", ১৩ শতকের শেষ থেকে ১৬ শতক পর্যন্ত এই সময়টি ছিলো পৃথিবীর ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় । এই সময়ে ইউরোপের বিশেষ করে ইটালির জ্ঞান-বিজ্ঞান এর প্রত্যেকটি শাখা চরম উন্নতি সাধন করে । লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির তৈরী করা উড়োজাহাজ এর বিভিন্ন মডেল নিয়ে গবেষণা হয়েছে অনেক । কিন্তু ইতিহাস ঘটলে দেখা যায় যে, এই ধরনের কাজে গবেষণা শুরু হয়েছে লিওনার্দো এর জন্মের প্রায় এক শতাব্দী আগে থেকেই । চিন্তাশক্তি ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে লিওনার্দো তার উড়োজাহাজের মডেলগুলো নির্মাণ করলেও সেগুলোর বাস্তবিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ সফল হয়নি । Pascal Cotte নামের একজন প্রকৌশলী তার উদ্ভাবিত শক্তিশালী একটি ক্যামেরা দিয়ে সর্বপ্রথম "মোনালিসা" চিত্রকর্মটি বিশ্লেষণ করেন । সাধারণ পেশাদারী ক্যামেরা অন্তত ২০ মেগাপিক্সেল ক্ষমতার হয়ে থাকে যা কিনা মৌলিক তিনটি রং নিয়ে কাজ করতে সক্ষম । কিন্তু Pascal Cotte এর এই বিশেষ ক্যামেরা ২৪০ মেগাপিক্সেল ক্ষমতার যা কিনা ১৩টি তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিয়ে কাজ করতে সক্ষম, যার মাঝে ৪টি আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে ।
"মোনালিসা" তৈরির সময় সাদা ক্যানভাসের উপরে বিভিন্ন স্তর তৈরির জটিল পদ্ধতি ব্যবহার করেন লিওনার্দো । আর এতে তিনি এতটাই দক্ষ আর সফল ছিলেন যে পরবর্তিতে আর কেউই এই পদ্ধতিতে সমানভাবে সফল হয়নি । বিভিন্ন অনুপাতের মিশ্রনের তৈলাক্ত স্তর ব্যবহার করে কাজটি করেন লিওনার্দো । এতে বিভিন্ন স্তরে আলাদা আলাদা ভাবে রং মিশিয়ে তিনি ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন "মোনালিসা" এর । শুধু মোনালিসাই নয় আরও বেশ কয়েকটি চিত্রকর্মে লিওনার্দো এই একই পদ্ধতি ব্যবহার করে গেছেন । শিল্পজগতে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির এই কাজগুলো আজও সমান ভাবে রহস্যময় এবং শ্রেষ্ঠ । বিখ্যাত এই ছবিটি মোনালিসার দ্বিতীয় পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ স্মরণে অঙ্কিত হয় । অনেক শিল্প-গবেষক রহস্যময় হাসির এই নারীকে ফ্লোরেন্টাইনের বণিক ফ্রান্সিসকো দ্য গিওকন্ডোর স্ত্রী লিসা গেরাদিনি বলে সনাক্ত করেছেন । শিল্পকর্মটি ফ্রান্সের ল্যুভ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে । বিশেষজ্ঞদের ধারণা, রেনাসা যুগেরই কোনো শিক্ষানবীশ শিল্পী ভিঞ্চির মোনালিসা ছবিটি দেখে দেখে এ অসাধারণ কার্বন কপিটি এঁকেছিল । ভিঞ্চি তার মডেলদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য অর্থাৎ কে, কবে, কোথায় তার ছবির মডেল হয়েছেন তার নোটবুকে রাখতেন । কিন্তু মোনালিসার মডেলের সম্পর্কে কোন তথ্য তার নোটবুকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু কেন ? তাহলে কে তার চিত্রকর্মের মডেল হয়েছিল ?
অনেকেই বলেন মোনালিসার হাসি নিয়ে যে পরিমাণ গবেষণা হয়েছে তা দিয়ে একটা মহাকাব্য লিখা যাবে অতি সহজেই ।এই হাসি আমরা দেখতে পেতাম না যদি শিল্পী মুখরে একটি রেখা অতি সামান্য ঘুরিয়ে দিতেন । ইতালির একজন গবেষক দাবি করেছেন, রেনেসাঁ যুগের শিল্পী লেওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা চিত্রকর্ম ‘মোনালিসা’র চোখে একাধিক বর্ণ লেখা রয়েছে । মোনালিসার দুই চোখে কয়েকটি বর্ণ রয়েছে । এখান থেকে ওই ছবিটির মডেল কে ছিলেন, তা জানা সম্ভব হতে পারে । ইতালির ফ্লোরেন্সের এক বণিকের স্ত্রী ছিলেন সেই মডেল । যাঁর নাম ছিল লিসা গেরারদিনি । কিন্তু ইতালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবিষয়ক জাতীয় কমিটির সভাপতি ভিনসেতি বলছেন, মোনালিসার ডান চোখের মণিতে ‘এল’, ‘ভি’ বর্ণ দুটি লেখা রয়েছে; যা লেওনার্দোর নামের আদ্যক্ষর । আর বাঁ চোখে রয়েছে ‘বি’ অথবা ‘এস’ বর্ণ বা ‘সি’, ‘ই’ বর্ণদ্বয় । এ দুটি বর্ণও কোনো অর্থ বহন করে এবং সম্ভবত তা এই চিত্রকর্মটির মডেলের পরিচয় বহন করছে । তাঁর মতে, ফ্লোরেন্সের বণিকের স্ত্রী নন, বরং মোনালিসার মডেল ছিলেন অন্য কোনো নারী । কারণ লেওনার্দো ছবিটি ইতালির মিলান শহরে বসে এঁকেছিলেন।
দ্য দা ভিঞ্চি কোড (ইংরেজি ভাষায়: The Da Vinci Code) ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি মার্কিন চলচ্চিত্র । দ্য দা ভিঞ্চি কোড উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন রন হাওয়ার্ড । উপন্যাসটি ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল । ২০০৬ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী রাতে এই ছবিটি প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল । প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র মুক্তি পাওয়ার পর বিশ্বের অনেকগুরো দেশেই এটি মুক্তি পেয়েছে । দ্য ডা ভিঞ্চি কোড বইয়ের কাহিনিতে ড্যান ব্রাউন লিখেছেন, মোনালিসা নামটি আসলে মিসরীয় দেবী আমন এলইসার নাম থেকে এসেছে । ভিনসেতি বলেন, ‘লেওনার্দো প্রতীক ও সংকেতের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন । এগুলো ব্যবহার করে তিনি বার্তা পৌঁছাতে চেয়েছেন । তিনি আমাদের জানাতে চেয়েছেন, মোনালিসার মডেল কে ছিলেন। সে জন্যই ছবির চোখে সূত্র রেখে গেছেন।’
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ক্ষণজন্মা পুরুষ কম , ৪৮৮ বছর আগে তিনি রেখে গেছেন অগণিত আধুনিক চিন্তা । তাকে আজও মানুষ স্মরণ করে। লিওনার্দোর মৃত্যুর প্রায় আড়াইশ বছর পর একজন পণ্ডিত তার নোটের সম্পূর্ণ পাঠ উদ্ধার করে চৌদ্দটি খণ্ডে প্রকাশ করেন। এই নোটই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আজ পর্যন্ত। ৬৭ বছর বয়সে ২ মে ১৫১৯ সালে চিরদিনের জন্য পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি- ইতালীয় রেনেসাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.