ঠাকুর ঘরের ভগবান কখনো মসজিদে ঢুকে আল্লাহ'র সাথে বিবাদে জড়ায়নি!
ধর্মীয় উৎসব সমুহ স্ব স্ব ধর্মাবলম্বিদের কাছে নি:সন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্ববহ। কিন্তু ধর্মের দেয়ালটাকে সরিয়ে রেখে যদি বাঙালি হিসেবে ভাবি তাহলে পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতি সত্তার এক মহৌৎসব।
ধর্মীয় উৎসব যেখানে মানুষের মাঝে বিভেদের দেয়াল তৈরী করে, পহেলা বৈশাখ সেখানে শিক্ষা দেয় অসাম্প্রদায়িকতার, ভ্রাতৃত্ববোধ আর উদার মানসিকতার। সাম্প্রদায়িকতা যেখানে স্বজাতির রক্তে হোলি খেলে, বৈশাখ সেখানে বার্তা নিয়ে আসে সম্প্রীতির, অসাম্প্রদায়িক নিবিঢ় বন্ধনের। ধর্ম একটি জাতিকে ছোট ছোট অনেকগুলো খন্ডে বিভক্ত করার মন্ত্রনা দেয়, পহেলা বৈশাখ দেয় ধর্মের প্রাচির টপকে গোটা জাতিকে এক হবার দীক্ষা। ধর্ম এ ক্ষেত্রে দোষি নয়, দোষ আমাদের ধর্মানুসারীদের। ধর্মের দেয়া বার্তাটি সঠিকভাবে অনুধাবন না করেই আমরা এর উল্টো পথটি ধরে হাঁটা রপ্ত করেছি।
আজ আমাদের নাগরিক সভ্যতায় সাম্প্রদায়িকতার যে সহিংস চেহারা দেখি বাঙালির ধর্মতত্ত্ব সব সময় এরকম ছিলো না। এক সময় গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো অসাম্প্রদায়িকতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সাম্য, ঐক্য এসব জটিল শব্দগুল বুঝতো না, কিন্তু শব্দের বিষয় বস্তুগুলো ছিল গ্রামের মানুষের সহজাত। এমন মুসলমান খুব কমই পাওয়া যেত যে বলতে পরবে সে হিন্দুদের রাস উৎসবে যায়নি, অথবা এমন হিন্দুও ছিল না যে মুসলমানদের ঈদ উৎসবে সেমাই মিষ্টান্ন খাইনি। ধর্মের ব্যপারটা গ্রামের মসজিদে-মন্দিরের অভ্যান্তরে ছিল। সনাতনীদের ঠাকুর ঘরের ভগবান কখনো মসজিদে ঢুকে আল্লাহর সাথে বিবাদে জড়াইনি। ধর্মালয়ের বাইরে সবাই ভাই, বন্ধু, পরিজন। আত্মার আত্মিয়। একের কাজে অন্যের ছিল স্বাবলিল অংশগ্রহন, বিপদে ছিল স্বতস্পুত সহযোগিতা। ধর্ম, বর্ণ, উচু, নিচুর ব্যবধান সেখানে কখনোই পার্থক্যের দেয়াল তৈরী করতে পারতো না।
একটি গ্রাম ছিল একটা পরিবারের মত। সেখানে কেউ ভাই, কেউ বন্ধু, কেউ পিতৃতুল্য, কেউবা মায়ের সমান। চৌদ্দ পুরুষ ধরে সেখানেই সবার বসতি, তাই অনাত্মিয় হবার কোন সম্ভাবনা নেই কিন্তু এখন সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। এখন সময় পাল্টে গেছে। অতিতের সহজ সরল ভ্রাতৃপ্রতিম মানুষ গুলোও হারিয়ে গেছে মহা কালের অমোঘ নিয়মে। আমাদের কৈশর বেলার সেই সোনাঝরা দিনগুলোর জন্য কষ্ট হয়। ভালো আর খারাপের এই যুগ সন্ধিক্ষনেই আমরা পৃথিবীতে এসেছি। আমরাই বোধহয় সেই প্রজন্ম যারা ধর্মীয় 'সম্প্রীতি' আর নিষ্ঠুর 'সাম্প্রদায়িকতা' এই দুটি যুগেরই প্রত্যাক্ষ সাক্ষি। ভাবতে খুব অবাক লাগে শান্ত স্রোতস্বিনীর মতো নিরবে পাশাপাশি বয়ে চলা দুই ধর্মের মানুষ গুলোর অন্তরে এ কোন বিষক্রিয়া শুরু হয়েছে যে, আমরা এতটা অসহিঞ্চু হয়ে গেলাম? কোন আগুনে ভষ্ম করেছে আমাদের ভ্রাতৃত্বপূর্ন মানসিকতাটাকে? কোন ধর্মই তো ভ্রাতৃহন্তারক হবার শিক্ষা দেয় না! তাহলে ধর্মের নামে আমাদের সমাজের এ কোন বিভাজনের দেয়াল?
বাঙালির বর্ষ বরন উৎসবও ত্রুটি মুক্ত নয়। বাঙালির সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্যের রয়েছে বিপুল একটি ভান্ডার। কিন্তু গোটা বৎসর বাঙালির আচরনে, জাপিত জীবনে, পালিত কৃষ্টি-কালচারে, লালিত চেতনায় তার লেশ মাত্র নেই। পশ্চিমা সংস্কৃতি এখন বাঙালির ফ্যশন, বাঙালিপনা সেকেলে, আন-কালচারাল। বৎসর জুড়ে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আপাদমস্তক লেপ্টে থেকে বৈশাখের প্রথম দিন হাজার টাকার ইলিশ যোগে পান্তা ভাত গিললেই কেবল বাঙালি হওয়া যায় না। বরং এটা বাঙালি সংস্কৃতিকে তীর্যক চপোটাঘাত।
বিস্তৃত ফসলের ক্ষেতে গাঢ় সবুজের মায়াকাড়া ঢেউ, শতবর্ষী বটের তলায় ক্লান্ত রাখালের মোহন বাঁশির সুর, অজস্র পাখ-পাখালির কোলাহল মুখর বিকেল, ঝিল্লি মুখর সাঁঝের বেলায় দাওয়ায় বসে গল্প শুনার আসর, শ্রাবণের অঝর বারি পাতের ধারায় শেষ রাতে টিনের চালের রিমঝিম ছন্দ অথবা নদীর কুলে আছড়ে পরা মাঝির কন্ঠ নিসৃত হৃদয় হাহাকার করা সুর "মন মাঝি তোর বৈঠানেরে আমি আর বাইতে পারলাম না", এসব আমাদের চিত্তকে আর বিশেষ আলোড়িত করে না। এ সমস্ত লোকজ বৈশিষ্ট অন্তরে ধারন করা এখন সেকেলে আর বুড়োদের মানসিকতা বলে জ্ঞান করা হয়।
ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ারি, জারি, সারি, পালা গান, পুথি, কবি গান, লোকগীতি যাত্রা পালা এসব বাঙালির জাতি সত্তার পরিচয়। এসবে মিশ্রিত আছে নিখাঁদ বাঙালি তত্ত্ব। অথচ আধুনিকতার নামে আমরা আমাদের প্রত্যাহিক জীবনাচরন থেকে নিজ সংস্কৃতির সকল অলংকার এক এক করে খুলে ফেলেছি।
আমি বলছি না যে, বাঙালি হওয়ার জন্য আমাদের ধুতি-পাঞ্জাবি পরা শুরু করতে হবে, আমি বলতে চাইছি আমাদের সংস্কৃতিটা যেন আমাদের অন্তরে শ্রদ্ধার আসন পায়। বাঙালিপনা যেন সীমাবদ্ধ হয়ে না পরে শুধু বৈশাখের প্রথম দিনে। পৃথিবীর যেই প্রান্তে থাকি না কেন, আমরা প্রত্যেকেই যেন যার যার অবস্থান থেকে গর্ব করে বলতে পারি "আমি বাঙালি"।
"ঐ পুরাতন বর্ষ গত,
আমি আজ ধুলি তলে
জ্বীর্ন জীবন করিলাম নত।
বন্ধু হও শত্রু হও
ক্ষমা কর আজিকার মত,
পুরানো বর্ষের সাথে
পুরানো অপরাধ যত।"
নববর্ষের অনাবিল শুভেচ্ছা | রহমান বর্ণিল
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
ধর্মীয় উৎসব যেখানে মানুষের মাঝে বিভেদের দেয়াল তৈরী করে, পহেলা বৈশাখ সেখানে শিক্ষা দেয় অসাম্প্রদায়িকতার, ভ্রাতৃত্ববোধ আর উদার মানসিকতার। সাম্প্রদায়িকতা যেখানে স্বজাতির রক্তে হোলি খেলে, বৈশাখ সেখানে বার্তা নিয়ে আসে সম্প্রীতির, অসাম্প্রদায়িক নিবিঢ় বন্ধনের। ধর্ম একটি জাতিকে ছোট ছোট অনেকগুলো খন্ডে বিভক্ত করার মন্ত্রনা দেয়, পহেলা বৈশাখ দেয় ধর্মের প্রাচির টপকে গোটা জাতিকে এক হবার দীক্ষা। ধর্ম এ ক্ষেত্রে দোষি নয়, দোষ আমাদের ধর্মানুসারীদের। ধর্মের দেয়া বার্তাটি সঠিকভাবে অনুধাবন না করেই আমরা এর উল্টো পথটি ধরে হাঁটা রপ্ত করেছি।
আজ আমাদের নাগরিক সভ্যতায় সাম্প্রদায়িকতার যে সহিংস চেহারা দেখি বাঙালির ধর্মতত্ত্ব সব সময় এরকম ছিলো না। এক সময় গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো অসাম্প্রদায়িকতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সাম্য, ঐক্য এসব জটিল শব্দগুল বুঝতো না, কিন্তু শব্দের বিষয় বস্তুগুলো ছিল গ্রামের মানুষের সহজাত। এমন মুসলমান খুব কমই পাওয়া যেত যে বলতে পরবে সে হিন্দুদের রাস উৎসবে যায়নি, অথবা এমন হিন্দুও ছিল না যে মুসলমানদের ঈদ উৎসবে সেমাই মিষ্টান্ন খাইনি। ধর্মের ব্যপারটা গ্রামের মসজিদে-মন্দিরের অভ্যান্তরে ছিল। সনাতনীদের ঠাকুর ঘরের ভগবান কখনো মসজিদে ঢুকে আল্লাহর সাথে বিবাদে জড়াইনি। ধর্মালয়ের বাইরে সবাই ভাই, বন্ধু, পরিজন। আত্মার আত্মিয়। একের কাজে অন্যের ছিল স্বাবলিল অংশগ্রহন, বিপদে ছিল স্বতস্পুত সহযোগিতা। ধর্ম, বর্ণ, উচু, নিচুর ব্যবধান সেখানে কখনোই পার্থক্যের দেয়াল তৈরী করতে পারতো না।
একটি গ্রাম ছিল একটা পরিবারের মত। সেখানে কেউ ভাই, কেউ বন্ধু, কেউ পিতৃতুল্য, কেউবা মায়ের সমান। চৌদ্দ পুরুষ ধরে সেখানেই সবার বসতি, তাই অনাত্মিয় হবার কোন সম্ভাবনা নেই কিন্তু এখন সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। এখন সময় পাল্টে গেছে। অতিতের সহজ সরল ভ্রাতৃপ্রতিম মানুষ গুলোও হারিয়ে গেছে মহা কালের অমোঘ নিয়মে। আমাদের কৈশর বেলার সেই সোনাঝরা দিনগুলোর জন্য কষ্ট হয়। ভালো আর খারাপের এই যুগ সন্ধিক্ষনেই আমরা পৃথিবীতে এসেছি। আমরাই বোধহয় সেই প্রজন্ম যারা ধর্মীয় 'সম্প্রীতি' আর নিষ্ঠুর 'সাম্প্রদায়িকতা' এই দুটি যুগেরই প্রত্যাক্ষ সাক্ষি। ভাবতে খুব অবাক লাগে শান্ত স্রোতস্বিনীর মতো নিরবে পাশাপাশি বয়ে চলা দুই ধর্মের মানুষ গুলোর অন্তরে এ কোন বিষক্রিয়া শুরু হয়েছে যে, আমরা এতটা অসহিঞ্চু হয়ে গেলাম? কোন আগুনে ভষ্ম করেছে আমাদের ভ্রাতৃত্বপূর্ন মানসিকতাটাকে? কোন ধর্মই তো ভ্রাতৃহন্তারক হবার শিক্ষা দেয় না! তাহলে ধর্মের নামে আমাদের সমাজের এ কোন বিভাজনের দেয়াল?
বাঙালির বর্ষ বরন উৎসবও ত্রুটি মুক্ত নয়। বাঙালির সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্যের রয়েছে বিপুল একটি ভান্ডার। কিন্তু গোটা বৎসর বাঙালির আচরনে, জাপিত জীবনে, পালিত কৃষ্টি-কালচারে, লালিত চেতনায় তার লেশ মাত্র নেই। পশ্চিমা সংস্কৃতি এখন বাঙালির ফ্যশন, বাঙালিপনা সেকেলে, আন-কালচারাল। বৎসর জুড়ে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আপাদমস্তক লেপ্টে থেকে বৈশাখের প্রথম দিন হাজার টাকার ইলিশ যোগে পান্তা ভাত গিললেই কেবল বাঙালি হওয়া যায় না। বরং এটা বাঙালি সংস্কৃতিকে তীর্যক চপোটাঘাত।
বিস্তৃত ফসলের ক্ষেতে গাঢ় সবুজের মায়াকাড়া ঢেউ, শতবর্ষী বটের তলায় ক্লান্ত রাখালের মোহন বাঁশির সুর, অজস্র পাখ-পাখালির কোলাহল মুখর বিকেল, ঝিল্লি মুখর সাঁঝের বেলায় দাওয়ায় বসে গল্প শুনার আসর, শ্রাবণের অঝর বারি পাতের ধারায় শেষ রাতে টিনের চালের রিমঝিম ছন্দ অথবা নদীর কুলে আছড়ে পরা মাঝির কন্ঠ নিসৃত হৃদয় হাহাকার করা সুর "মন মাঝি তোর বৈঠানেরে আমি আর বাইতে পারলাম না", এসব আমাদের চিত্তকে আর বিশেষ আলোড়িত করে না। এ সমস্ত লোকজ বৈশিষ্ট অন্তরে ধারন করা এখন সেকেলে আর বুড়োদের মানসিকতা বলে জ্ঞান করা হয়।
ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ারি, জারি, সারি, পালা গান, পুথি, কবি গান, লোকগীতি যাত্রা পালা এসব বাঙালির জাতি সত্তার পরিচয়। এসবে মিশ্রিত আছে নিখাঁদ বাঙালি তত্ত্ব। অথচ আধুনিকতার নামে আমরা আমাদের প্রত্যাহিক জীবনাচরন থেকে নিজ সংস্কৃতির সকল অলংকার এক এক করে খুলে ফেলেছি।
আমি বলছি না যে, বাঙালি হওয়ার জন্য আমাদের ধুতি-পাঞ্জাবি পরা শুরু করতে হবে, আমি বলতে চাইছি আমাদের সংস্কৃতিটা যেন আমাদের অন্তরে শ্রদ্ধার আসন পায়। বাঙালিপনা যেন সীমাবদ্ধ হয়ে না পরে শুধু বৈশাখের প্রথম দিনে। পৃথিবীর যেই প্রান্তে থাকি না কেন, আমরা প্রত্যেকেই যেন যার যার অবস্থান থেকে গর্ব করে বলতে পারি "আমি বাঙালি"।
"ঐ পুরাতন বর্ষ গত,
আমি আজ ধুলি তলে
জ্বীর্ন জীবন করিলাম নত।
বন্ধু হও শত্রু হও
ক্ষমা কর আজিকার মত,
পুরানো বর্ষের সাথে
পুরানো অপরাধ যত।"
নববর্ষের অনাবিল শুভেচ্ছা | রহমান বর্ণিল
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.