ইতিহাসের সেরা আট ছাত্র আন্দোলন

সর্বশেষ কোটা সংস্কারের দাবীতে ছাত্র আন্দোলন, ছবি- বাংলা ট্রিবিউন
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস বেশ পুরনো। বাঙালি জাতিয়তাবাদের উত্থান হয় ছাত্রদের মাধ্যমে। সেই ১৯৫২ সাল থেকে শুরু। সেটাই বাঙালি ছাত্রদের প্রথম আন্দোলন। আর এই আন্দোলনের ক্রমবিকাশের মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। আজ আমরা উল্লেখযোগ্য আটটি ছাত্র আন্দোলনের কথা জানবো।
আট. কোটা সংস্কার আন্দোলন (২০১৮)
এই আন্দোলনের সূত্রপাত অনেক আগে শুরু হলেও এই আন্দোলনের গ্রহনযোগ্যতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। বার কয়েক ছাত্ররা রাস্তায় নামলেও শেষ পর্যন্ত দাবী আদায় হয়নি। সবশেষ ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল থেকে শুরু করে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ছাত্ররা ভয় ভীতির উর্ধে উঠে আন্দোলন চালিয়ে যায়।

পুলিশের টিয়ার শেলের মধ্যে জাতীয় পতাকা হাতে এক কোটা সংস্কার আন্দোলন কর্মী। ছবিঃ সোনালী নিউজ
পুলিশের রাবার বুলেট, টিয়ারশেল, গুলি পাশাপাশি ছাত্রলীগের আক্রমন, নির্যাতন সবকিছু সয়ে গিয়ে ছাত্ররা আন্দোলন চালিয়ে যায়। অবশেষে শেখ হাসিনা সরকার ছাত্রদের দাবীর কাছে নতি স্বীকার করে। ছাত্রদের দাবী কোটা সংস্কার থাকলেও শেখ হাসিনা রাগান্বিত হয়ে পুরো কোটা পদ্ধতিই বাতিল করে দেন। ১২ এপ্রিল ছাত্ররা আনন্দ মিছিল করে ঢাকা ভার্সিটিতে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব ঢাকা ভার্সিটি দিলেও সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে।
সাত. নো ভ্যাট আন্দোলন (২০১৫)
২০১৫ সালে শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বাজেট অধিবেশনে বেসরকারি ভার্সিটির উপর ১০% ভ্যাট আরোপ করে। দেশের সবগুলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের প্রতিপাদ্য ছিল No Vat On Education.

শিক্ষায় ভ্যাটের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা, ছবি- সমকাল
আন্দোলনে পুলিশি নির্যাতন ছিল বরাবরের মতই। বহু ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়। আহত হয় শতাধিক। মাসব্যাপী চলা আন্দোলনে ছাত্ররা অনেক নির্যাতনের মুখোমুখি হয়। একপর্যায়ে শেখ হাসিনা সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়। প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভ্যাট আদায় রহিত হয়।
ছয়. সেনাশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন (২০০৭)
এই আন্দোলনের সূত্রপাত অবশ্য তুচ্ছ ঘটনা থেকে। ২০০৭ সালে এদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে সেনা শাসন চলছিল। তৎকালীন মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকার জরুরী অবস্থা জারি করে এদেশের সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ করে রেখেছিল। প্রায় সকল রাজনীতিবিদদের গ্রেপ্তার করে রেখেছিল।

সেনাশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ রাজু ভাস্কর্যের সামনে, ছবি- dw
মূলত সেনাপ্রধান মঈনুদ্দিনের একনায়কতন্ত্র তখন কায়েম ছিল। সেই সময় ঢাকা ভার্সিটিতে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের সাথে সেনাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। সেই থেকে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠে। মুহুর্তেই দাবানলের মত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলন। গ্রেপ্তার করা হয় কিছু ছাত্রনেতা ও ঢাকা ভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষককে। এতে আন্দোলন থামে নি বরং আরো দুর্বার হয়ে উঠে। অবশেষে ছাত্র ও শিক্ষকদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় জান্তা সরকার।
পাঁচ. স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন (১৯৯০)
৯০ এর আন্দোলনের প্রেক্ষাপট শুরু হয় ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ যখন তৎকালীন সেনাপ্রধান লেঃ জেঃ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। সে সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিএনপি মনোনীত ও জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। সেনাপ্রধান লেঃ জেঃ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেই সামরিক আইন জারি করেন । সেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করে ছাত্ররা । ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে উঠা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে সেনাবাহিনীর হামলায় জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালী সাহা সহ অনেক ছাত্র/ছাত্রী নিহত হয় ।

৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্রদের একটি মিছিল, ছবি- dw
তখন থেকে জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে একটি লাগাতার ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর। ১৯৯০ সালের ১০ই অক্টোবর জেহাদ নামে একজন ছাত্র পুলিশ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হলে সেই মৃত জেহাদের লাশকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে তৎকালীন ক্রিয়াশীল সকল ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত হয় । ২৪টি ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে গড়ে উঠে "সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য" । উল্লেখ্য এই সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গড়ে উঠার আগে বৃহৎ দুই ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্র দল ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আলাদাভাবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিল । সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনের মাধ্যমে ছাত্র সংগঠনের সকল শক্তি একই জায়গায় মিলিত হয়েছিল । এছারাও আরও কিছু শক্তিশালী বামধারার ছাত্র সংগঠন যথেষ্ট পরিমাণে সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী ছিল এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ , সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী ইত্যাদি । সব কয়টি ছাত্র সংগঠনের মিলিত শক্তির আন্দোলনের কাছে সেনাবাহিনী সমর্থিত জেনারেল এরশাদ টিকতে পারে নাই । সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য এর আন্দোলনের সাথে দেশের জনগণ সম্পৃক্ত হলে তা গণ আন্দোলন থেকে গণ অভ্যুত্থানে রুপ নেয় । সেই গণ অভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদ ৪ঠা ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দেন এবং ৬ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন । দীর্ঘ ৯ বৎসর পরিচালিত আন্দোলন ১৯৯০ এ এসে গণ আন্দোলনের রুপ নেয় । সেই গণ আন্দোলনে এরশাদ পদত্যাগ করেছিল । ইতিহাসে তা ৯০'র আন্দোলন হিসেবে পরিচিত । ১৯৯০ এর আন্দোলনের সফল সমাপ্তি ঘটেছিল মূলত ছাত্রনেতাদের দৃঢ়তায় ।
চার. সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ (১৯৬৯)
পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবির বাস্তবায়ন এবং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি প্রধান ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে গঠিত একটি সংগ্রাম পরিষদ। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সংগঠন ও সুসংবদ্ধকরণ এবং নেতৃত্ব প্রদানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মূখ্য ভূমিকা পালন করে।

ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের একটি সমাবেশের চিত্র, ছবি- দ্য পলিটিক্স২৪
১৯৭১ সালের পঁচিশ মার্চের মধ্যরাতে জনগণের উপর পাকবাহিনীর আক্রমণ ৩ মার্চ ছাত্রদের স্বাধীনতা ঘোষণার যৌক্তিকতা প্রমাণ করে৷ ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল বস্তুত ৩ মার্চ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতা ঘোষণারই স্বীকৃতি। উল্লেখ্য, আমাদের দেশের নাম, জয় বাংলা স্লোগান, জাতীয় পতাকা, ইত্যাদি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদই নির্ধারণ করে। মুজিবনগর সরকার সেগুলো গ্রহন করার মাধ্যমে পরিষদকে স্বাধীনতার মূল চালিকা শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৭১ সালে যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী গঠনে ব্যপক ভূমিকা রাখে।
তিন. ছয় দফা আন্দোলন (১৯৬৬)
ছয় দফা আন্দোলনই ছিল এদেশের স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ধাপ। ১৯৬৬ সালে এটি ছিল শেখ মুজিবের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবীতে ছাত্রদের মিছিল, ছবি- জাগোনিউজ২৪
ছয় দফা আন্দোলনের শুরুর দিকে নানাবিধ সংকটে পড়ে। পরবর্তিতে ছাত্রলীগের ব্যাপক তৎপরতায় এটি গণআন্দোলনে পরিণত হয়। প্রথমে ছাত্রলীগ ছয় দফার দাবী নিয়ে ছাত্রদের আন্দোলনে আহ্বান করে। ছাত্ররা এই দাবীটিকে গ্রহণ করে সারা বাংলা আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়।
দুই. শিক্ষা আন্দোলন (১৯৬২)
আইয়ুবের স্বৈরাচারী শিক্ষানীতির শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন একুশ উদযাপনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ১৯৬০ ও ১৯৬১ সালে এ ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত থাকে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী পালন করার মাধ্যমে সরকারের সাম্প্রদায়িক ও বাঙ্গালীবিরোধী মনোভাবকে অগ্রাহ্য করে।

শরিফ শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবীতে বিক্ষোভ, ছবি- সামহোয়্যার ইন ব্লগ
১৯৬২ সালের সারা আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস শরীফ কমিশন বাতিলের জন্য সংগ্রাম ও আন্দোলন অব্যাহত থাকে। ১৭ সেপ্টেম্বর সারা দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। ছাত্রদের সাথে সাধারণ মানুষও পিকেটিংয়ে অংশগ্রহণ করে। সকাল ১০ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হয়। সমাবেশ শেষে মিছিল বের হয়ে যায়। এসময় পুলিশ গুলি করে। তিন জন শহীদ হয় ও শতাধিক আহত হয়।
এক. ভাষা আন্দোলন (১৯৫২)
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ ৬ কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যাবিশিষ্ট নবগঠিত পাকিস্তানের নাগরিকে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশসহ প্রচারমাধ্যম ও বিদ্যালয়ে কেবলমাত্র উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ওই সমাবেশে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের প্রবল দাবি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাকে তাদের অনুমোদিত বিষয়তালিকা থেকে বাদ দেয় ও সাথে সাথে মুদ্রা এবং ডাকটিকেট থেকেও বাংলা অক্ষর বিলুপ্ত করে। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান মালিক উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদের একটি বিশাল সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল এবং সমাবেশের আয়োজন করে। এই আন্দোলনের প্রাথমিক নেতৃত্ব দেয় তমুদ্দুনে মজলিশ।

ভাষা আন্দোলনের সমাবেশ, শহীদ ও প্রথম শহীদ মিনারের চিত্র, ছবি- বাংলা হাব
এটা মূলত ছাত্রদেরই আন্দোলন ছিল। আন্দোলন আরো বেগবান করার ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর ধারাবাহিকতা ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় ছাত্ররা। পুলিশ সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ১ টি