সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দেশ ভারত
১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গায় এভাবেই রাস্তায় পড়ে থাকে মানুষের সারি সারি লাশ, সূত্রঃ Legal Insurrection
ভারত বরাবরই ধর্মীয় সহিংসতার দেশ। অখন্ড ভারতে মূলত এই উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের অবসানের পরই শুরু হয়েছে এই সংস্কৃতি। আর ভারত ভাগ হওয়ার পর বর্তমান ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়মিত ঘটনা। দাঙ্গা সবসময়ই রাজনৈতিক বিষয়। এলাকার মানুষের প্রতিদিন চলতে গিয়ে নানা ঘটনা ঘটে। এরকম ছোট কোন ঘটনাকে পুঁজি করেই শুরু হয় দাঙ্গা। এর পেছনে থাকে কারো না কারো রাজনৈতিক চাল। ভারতের দাঙ্গাগুলোর মধ্যে ভয়ানক দাঙ্গাগুলো সম্পর্কে জানবো।
১৯৪৬ - ১৯৪৭ সালের দাঙ্গাঃ
ভারতের সবচেয়ে বড় দাঙ্গা ভারত বিভাগের সময়। হিন্দুরা চেয়েছিলো ভারত অখন্ড থাকুক। আর মুসলিমরা চেয়েছিলো আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান তৈরি হোক। সেসময়ে সারা ভারতে দাঙ্গা হলেও মূলত কোলকাতা, বিহার, নোয়াখালী এবং ঘারমুকেশ্বরে দাঙ্গা হয়েছিল সবচেয়ে বেশি।
আগস্টের ১৬ তারিখ শুরু হয়েছিল এই দাঙ্গা। দিনটি ছিল বসন্তকালের অত্যন্ত উত্তপ্ত ও কষ্টকর দিন। সেদিন কলকাতায় মুসলমানরা তাদের বিরাট সমাবেশ যখন নেতাদের বক্তব্য শুনতেছিল, তখনই শুরু হয়েছিল এ গণহত্যা। হিন্দুরা আক্রমন করলো সেই সমাবেশে। হিন্দু ও মুসলমানরা ধারালো ছুরি নিয়ে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়াল।
‘কলকাতার এ ভয়ঙ্কর নরহত্যা ও ধ্বংস কান্ডের বিবরণ দিয়ে ষ্টিফেনস লিখেছেন, শ্যামপুর ও এর পার্শবর্তী অঞ্চলে মানুষের মৃত দেহের স্তুপ নিকটবর্তী বাড়িগুলোর দোতলার মেঝে বরাবর উঁচু হয়ে উঠেছিল। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর হিসাব মতে প্রায় ৫০,০০০ লোক হতাহত হয়েছিল। মেননের মতে ৫০০০০ নিহত ও ১৫০০০ আহত হয়েছিল। স্টেটসম্যানের হিসাব অনুযায়ী হতাহতের সংখ্যা ২০,০০০ কিংবা কিছু বেশি ছিল।
১৯৪৬ সালের দাঙ্গা নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা বৃটিশ পুলিশের। সূতঃ The Friday Times
... কলকাতায় মুসলমানদের হত্যার খবর পূর্ববাংলা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অক্টোবর মাসে নোয়াখালী ও ত্রিপুরা জেলায় মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এতে ভয় পেয়ে হিন্দুগণ ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে থাকে। কলকাতার হিন্দু সংবাদপত্রগুলো ও রিপোর্টারগণ ঘটনা স্থলে না গিয়েই মুসলমান কর্তৃক হিন্দু হত্যার অতিরঞ্জিত খবর সরবরাহ করে। সরকারি হিসাব থেকে জানা যায় যে, সেসময় নোয়াখালীতে ২২০ জন এবং ত্রিপুরায় ৬৫ জন নিহত হয়। এদিকে বিহারে নোয়াখালী গোলযোগের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত মুসলমানদের হত্যা করা হয়।’
(সিরাজউদ্দৌলা থেকে শেখ মুজিব- কে এম ফিরোজ খান)
যে মুসলিম জনগোষ্ঠী পুরুষানুক্রমে হিন্দু প্রতিবেশীদের মাঝে হৃদ্যতা ও বিশ্বস্ততার সাথে বিহারে বসবাস করে আসছিল, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে হঠাৎ করে হিন্দুদের এক বিরাট উচ্ছৃংখল জনতা তাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞে নিহত মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশু সংখ্যা ছিল প্রায় সাত থেকে আট হাজার।
গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাঃ
১৯৬৯ সালে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে। আহমেদাবাদের একটি হিন্দু মন্দির নিয়ে সমস্যা শুরু হয়ে পুরো গুজরাটে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।
দাঙ্গায় গৃহহারা ও স্বজনহারা এক মুসলিম পরিবার, সূত্রঃ Quit Hate Movement
প্রথমে দাঙ্গা শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আসে। এর এক মাসের মধ্যেই আবার দাঙ্গা শুরু হয়। মোট ৬৬০ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে ৪৩০ জনই ছিলেন মুসলিম। সহস্রাধিক আহত হয় এবং গৃহহারা হয় প্রায় ৫০০০০ মানুষ।
মোরাদাবাদ দাঙ্গা
১৯৮০ সালের আগস্টে উত্তর প্রদেশের মোরাদাবাদে এই দাঙ্গা শুরু হয়। মুসলিমদের উপর উচ্ছেদ অভিযান চালায় খোদ সরকার। প্রথমে পুলিশ- মুসলিম সংঘর্ষ হলেও এটা ক্রমেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ নেয়।
দাঙ্গায় আহত একজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে, সূত্রঃ Quit Hate Movement
সরকারিভাবে বলা হয়েছে প্রায় ৪০০ জন মৃত্যবরণ করেছে এই দাঙ্গায়। আসলে চার মাস ধরে স্থায়ী হওয়া এই দাঙ্গায় নিহতের পরিমাণ হাজার ছাড়িয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
শিখ বিরোধী দাঙ্গাঃ
১৯৭০ সালে শিখরা পাঞ্জাবে স্বায়ত্বশাসন দাবী করে এবং হিন্দুদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধী সরকার জরুরী অবস্থা জারি করে এবং প্রায় ১লাখ ৪০ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করে। বিক্ষুব্দ শিখরা ক্রমেই স্বাধীনতা দাবীর দিকে অগ্রসর হয়। ১৯৮৪ সালে অমৃতসারের গোল্ডেন টেম্পল থেকে স্বাধীনতার দাবী উত্থাপিত হয়। ইন্দিরা গান্ধী সেনা অভিযান পরিচালনা করেন গোল্ডেন টেম্পলে। সেনাদের অতর্কিত আক্রমনে হাজার হাজার শিখ নিহত হয়।
১৯৮৪ সালের শিখ বিরোধী দাঙ্গার কিছু খন্ড চিত্র, সূত্রঃ The Logical Indian
এর প্রতিবাদে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর দুই শিখ দেহরক্ষী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করে। এর ফলে সারাদেশে হিন্দু-শিখ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় বিশ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসঃ
১৯৯২ সালে হিন্দুরা বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে দেয়। এই নিয়ে উত্তর প্রদেশ, মুম্বাই ও দিল্লীতে দাঙ্গা শুরু হয়। ভারতের উত্তর প্রদেশের, ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা শহরের রামকোট হিলের উপর অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। মসজিদটি ১৫২৭ খ্রীষ্টাব্দে ভারতের প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের আদেশে নির্মিত হয় এবং তাঁর নাম অনুসারে এর নামকরণ হয়।
১৯৯২ সালে ঐতিহাসিক বাবরি মুসজিদ ভাঙ্গছে উগ্রবাদী হিন্দুরা, সূত্রঃ India Today
১৯৯২ সালে একটি হিন্দুরা একটি রাজনৈতিক সমাবেশের আয়োজন করে। উদ্যোক্তারা ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় সমাবেশটি শুরু করে। মূলত এটি ছিল একটি কৌশল। সমাবেশের প্রায় লাখ খানেক মানুষ অল্প সময়ের মধ্যেই মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলে। সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা। দাঙ্গায় প্রায় তিন হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন যার বেশিরভাগই ছিল মুসলিম।
ফের গুজরাটের দাঙ্গাঃ
২০০২ সালে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয়াকে কেন্দ্র করে ভারতের গুজরাটে হিন্দু-মুসলিম ভয়াবহ দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এ দাঙ্গায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের আক্রমণে হাজার হাজার মুসলমান প্রাণ হারায়। ভারতের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহনকারী ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পেছনে কোনো অবস্থাতেই মুসলমানরা দায়ী ছিল না। এ নপথ্যে ছিল বিজেপি।
২০০২ সালের দাঙ্গায় জ্বলছে গুজরাট, সূত্রঃ Quit Hate Movement
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) গুজরাট রাজ্যে তাদের অবস্থানকে আরো মজবুত এবং ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে এ নাশকতামূলক কাজে ইন্ধন যুগিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বিজেপি এ নাশকতামূলক কাজে ইন্ধন যোগালেও অথচ এ ঘটনার জন্য তারা মুসলমানদের দায়ী করে। এর ফলে হিন্দুরা উত্তেজিত হয়ে সংখ্যালঘু মুসলমানদের আক্রমণ করে বসে এবং সংঘটিত হয় হিন্দু মুসলিম ভয়াবহ দাঙ্গা। ভারতের মানবাধিকার সংস্থাগুলো ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এ অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য গুজরাটের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সরাসরি দায়ী করে।
নিয়মিত দাঙ্গাঃ
ভারতে দাঙ্গা নিয়মিত ব্যাপার। প্রতিবছরই সারা ভারতে দাঙ্গা লেগে থাকে। আমরা ২০১৭ সালের দাঙ্গার রিপোর্ট দেখেই বুঝতে পারবো কী পরিমাণ হিংসা ও অসহিষ্ণু আচরন চলে ভারতে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গত বছর ৮২২টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ১১১ জন। আর আহত হয়েছেন ২ হাজার ৩৮৪ জন।
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হংসরাজ আহির গতকাল মঙ্গলবার লোকসভায় সাংসদ জি হরি এবং টিজি ভেঙ্কটেশ বাবুর আনা প্রশ্নের জবাবে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
হংসরাজ আহির বলেন, এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে ভারতের উত্তর প্রদেশ। সেখানে গত বছর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে ১৯৫টি। এসবে নিহত হয়েছেন ৪৪ জন। আহত হয়েছেন ৫৪২ জন। এসবের বেশির ভাগই হয়েছে গরুর গোশত নিয়ে।
এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যার দিক দিয়ে কর্ণাটক রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে ১০০টি। এতে ৯ জন নিহত ও ২২৯ জন আহত হন। রাজস্থানে দাঙ্গা হয়েছে ৯১টি। নিহতের সংখ্যা ১২ ও আহতের সংখ্যা ১৭৫ জন। বিহারে এ দাঙ্গার সংখ্যা ৮৫। নিহত ৩, আহত ৩২১ জন। মধ্য প্রদেশে দাঙ্গার সংখ্যা ৬০। নিহত ৯, আহত ১৯১ জন। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় ৫৮টি। তাতে নিহত হন ৯ জন, আহত হন ২৩০ জন। আর গুজরাটে হয়েছে ৫০টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। যাতে নিহতের সংখ্যা ৮ ও আহতের সংখ্যা ১২৫ জন।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.