মুক্তিযুদ্ধে যাঁর ভূমিকা অনন্য
কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহ (কে এম সফিউল্লাহ) ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯ মার্চে ঢাকা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব জয়দেবপুরে আসেন ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে৷ কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন।
সে সময় কে এম শফিউল্লাহ ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন৷ ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব ফিরে যাবার পর কে এম শফিউল্লাহর নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করে৷ ৩টি ব্যাটেলিয়ান নিয়ে জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ হয়ে সিলেটের তেলিয়া লাগয় মাতৃমার পর সেক্টর ও এস ফোর্স গঠন করে যুদ্ধ শুরু করেন৷ ২৯ মার্চ ঢাকা আক্রমণের পরিকল্পনা করেন৷ কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে প্রথমে সেক্টর ও পরে এস ফোর্স গঠন করে প্রথমে সিলেটসহ বিরাট একটি অংশ মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলা হয়৷ একদিকে সিলেট আর একদিকে আশুগঞ্জ, ভৈরব আর মাধবপুর শত্রুমুক্ত করেন তাঁরা৷ তাঁর নেতৃত্বে আশুগঞ্জ, ভৈরব, লালপুর, আজবপুর, সরাইল, শাহবাজপুর, মাধবপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মিপুর শত্রুমুক্ত হয়ে যায়৷
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অনন্য। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার চান্দুরায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক যুদ্ধে তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান। ষোলোই ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উপস্থিত ছিলেন।
আসুন আমরা তাঁর জবানীতেই শুনি মুক্তিযুদ্ধের সেসময়কার কিছু কথা। ‘২৫ মার্চ রাত একটায় কর্নেল মাসুদুল হাসান খান (দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাবেক অধিনায়ক। ২৩ মার্চ তাঁকে ঢাকা সেনানিবাসে অ্যাটাচড করা হয়) ঢাকা থেকে টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করেন যে তোমাদের খবর কী? ঢাকাতে তো বেশ গোলাগুলি শুনছি। এই টেলিফোন পাবার পর ঢাকার সাথে সামরিক-বেসামরিক সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঢাকায় যে তখন কী হচ্ছিল, তার কোনো খবরই আমরা পাচ্ছিলাম না।
‘২৬ মার্চ সকালবেলায় ব্যাটালিয়নের কমান্ডার কর্নেল রকিবকে (কাজী আবদুর রকিব, তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল) বললাম যে গত রাতে যা কিছু ঘটেছে এবং চারদিকে যে সমস্ত গুজব রটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে একটা উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে। এ মুহূর্তে এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা উচিত।
‘২৭ মার্চ বিকেলের দিকে আমাদের একজন ড্রাইভার ঢাকা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়।...সন্ধ্যার দিকে আরও কিছু লোক ঢাকা থেকে আসে। তাঁদের মুখে শুনতে পাই ঢাকাতে বেশ হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এর আগে ড্রাইভার ছাড়া আর কারও কাছে কিছু শুনতে পাইনি।
‘২৮ মার্চ ১০টার সময় উদ্বৃত্ত অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহন নিয়ে আমি ময়মনসিংহ অভিমুখে যাত্রা করি। জয়দেবপুর থেকে বের হওয়ার পর সকল গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডয়ন করি। সাথে সাথে সমস্ত জোয়ানের মাঝে এক অভূতপূর্ব আনন্দের সৃষ্টি হয়। আমার কনভয় জয়দেবপুর থেকে বের হবার সাথে সাথে জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং “জয় বাংলা” স্লোগান দিয়ে আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে।
‘টাঙ্গাইলে জনতার উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখে আমি খুবই অনুপ্রাণিত হই। ভাবনাও কম ছিল না। মনে মনে চিন্তা করতে থাকি, আমি যা করতে চলেছি সে কাজে আমি শুধু একা, না আরও কেউ আছে? কারণ আমি জানি, আমি যা করতে চলেছি তা যদি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তাহলে মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র সাজা। অন্যদিকে জনতার উৎফুল্লতা দেখে মনে উৎসাহের সৃষ্টি হতো।
‘২৯ মার্চ বিকেলে জেলা (ময়মনসিংহ) অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সমস্ত অফিসারবৃন্দ, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএদেরকে নিয়ে এক বৈঠক করা হয়। সেই বৈঠকে কীভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে তার পরিকল্পনা নিই।
‘৩০ মার্চ ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনযোগে নরসিংদী রওনা দেই। আসার পূর্বে আমি জনগণকে আশ্বাস দিলাম যে, আমি আমার ব্যাটালিয়ন নিয়ে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে যাচ্ছি। আমার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি কিশোরগঞ্জ। আর আমার লোকজন বিভিন্ন গন্তব্যে অগ্রসর হয়।’
কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহ এর পর আর পেছন ফিরে তাকাননি। ৩ নম্বর সেক্টর এলাকায় তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচালনায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে অসংখ্য যুদ্ধে অংশ নেন। তাঁর সার্বিক নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি সরাসরি যুদ্ধও সংঘটিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ০২।
ছবিঃ শিল্পীর তুলিতে কে এম শফিউল্লাহ
১৯৭০ সালে মেজর পদে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন কে এম শফিউল্লাহ৷ ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান কে এম শফিউল্লাহকে ডেকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিতে বলেন। তখন দেশের সামরিক বাহিনীর প্রধান অধিনায়কের দায়িত্বে এম এ জি ওসমানী ছিলেন। শফিউল্লাহর পদবী তখন লেঃ কর্নেল ছিলো (যুদ্ধের সময় পদোন্নতিপ্রাপ্ত), তিনি সেনাপ্রধান হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাঁকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিতে হয় এবং তাকে পূর্ণ কর্নেল পদে উন্নীত করা হয়৷১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি ব্রিগেডিয়ার এবং একই বছরের ১০ অক্টোবর তিনি মেজর-জেনারেল পদবী লাভ করেন, তার সঙ্গে জিয়াউর রহমানও পদোন্নতি পেয়ে উপসেনাপ্রধান হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত শফিউল্লাহ সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন৷
১৯৭৫ সালের পর যুক্তরাজ্য, কানাডা ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার এবং সুইডেনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হন।
কে এম শফিউল্লাহর জন্ম ১৯৩৪ সালের ২সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে। তাঁর বাবার নাম কাজী আব্দুল হামিদ এবং মায়ের নাম রজ্জব বানু। ৩ ভাই ৬ বোনের মধ্যে শফিউল্লাহ ছিলেন ৬ষ্ঠ৷ মুড়াপাড়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন৷ এরপরে মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে ভর্তি হন৷ ১৯৫৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার আগেই তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন৷ কমিশন লাভ করেন ১৯৫৫ সালে৷ ১৯৬৮ সালে সেনা স্টাফ কলেজ (পাকিস্তান) থেকে পিএসসি পাশ করেন৷
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
মন্তব্য: ১ টি