ছেলেহারা ইমাম ঠেকিয়ে দিলেন আরেকটি দাঙ্গা
ছবিঃ ইমাম মুহাম্মদ ইমদাদুল্লাহ
আসানসোলের পরিস্থিতি তখনো দুদিনের হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের জের ধরে থমথমে। সবকিছু বন্ধ। চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে নানা গুজব।
ইমাম মুহাম্মদ ইমদাদুল্লাহ হাসপাতালে গেলেন। সনাক্ত করলেন নিজের ছেলের ক্ষত-বিক্ষত লাশ। নখ উপড়ে নেয়া হয়েছে। ঘাড়ে ধারালো অস্ত্রের কোপ। লাশটি আধপোড়া, মনে হচ্ছে কেউ পুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।
আগের দুদিন ধরে নিখোঁজ ছেলেকে খুঁজেছেন ইমদাদুল্লাহ। সেই সঙ্গে মহল্লার সব মানুষ। কোথাও পাওয়া যায়নি তাকে। ক্ষত-বিক্ষত লাশটি যখন মহল্লায় আনা হলো, পরিস্থিতি হয়ে উঠলো আরও অগ্নিগর্ভ।
"ইমাম সাহেবের ছেলের মৃত্যুর ঘটনাটা শুনে প্রথমে সবারই মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল" বলছিলেন মহল্লার বাসিন্দা মুহম্মদ ফারহাদ মালিক। "এটা তো রক্ত গরম করে দেওয়ার মতোই ঘটনা।"
ইমাম মুহাম্মদ ইমদাদুল্লাহ বুঝতে পারলেন, এই প্রতিহিংসার রাশ টানতে হবে এখনই। নইলে আরও রক্ত ঝরবে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চলে যাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রাণ যাবে আরও মানুষের। একটা মাইক হাতে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে সবার প্রতি আবেদন জানালেন, আপনারা শান্ত হোন।
পুত্র হারানোর কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে গেল ইমামের। তবে তার মধ্যেও বলছিলেন, "এই অবস্থাতেও আমি সবার কাছে আবেদন করতে রাস্তায় বেরিয়েছিলাম - সবাইকে বুঝিয়েছি যে আমার যে ক্ষতি হয়েছে, সেটা যেন আর কোনও বাপ-মায়ের না হয় - কেউ যেন দাঙ্গা না বাধায় ছেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে।"
পুত্রশোকের মধ্যেও এলাকায় ঘুরে ছেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অশান্তি না ছড়ানোর জন্য তার এই আবেদনে কাজ হলো। লোকজন ঘরে ফিরে গেল।
ছবিঃ ইমামের নিহত কিশোর সন্তান
ইমাম ইমদাদুল্লাহ বলছিলেন, "ছেলেটা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল, একই সঙ্গে নানা জায়গায় কোরান পড়তেও যেত। বুধবার যখন অশান্তি শুরু হয়, তখন নেহাতই কৌতূহলবশে দেখতে গিয়েছিল। আমার বড় ছেলে খবর দেয় যে একদল লোক ওকে টেনে নিয়ে যায়। পরের দিন জানলাম একটা মৃতদেহ পাওয়া গেছে - ওটাই আমার ছেলের দেহ।"
"খুব যন্ত্রণা দিয়ে মেরে তো ফেলেইছে ছেলেটাকে, তারপরে দেহটা জ্বালিয়েও দিয়েছিল। এটা কেন করল ওরা!"
এই নিদারুণ পুত্রশোক ভুলে ইমদাদুল্লাহ যে বলিষ্ঠ অবস্থান নেন, সেটি যেন আসানসোলকে আরও বড় বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এই ভয়ংকর ঘটনার পরও তার এলাকায় আরও দাঙ্গা অথবা কোনওরকম সাম্প্রদায়িক অশান্তি রোধ করা গেছে।
আসানসোলের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার নাসিম আনসারীর বয়ান অনুযায়ী,
"জানাজার ময়দানকে কারাবালার ময়দান বলে মনে হচ্ছিল। যুবকদের চোখেমুখে ফুটে উঠছিল প্রতিশোধগ্রহণের প্রতিজ্ঞা । আমি প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, না আর আসানসোলকে রক্ষা করা গেল না।"
জানাজার নামাজ শুরুর আগে মৃত সন্তানের পিতা ইমাম ইমদাদুল্লাহ্ রশিদি খুদবা(বক্তব্য) দিতে উঠলেন। বললেন,
" আল্লাহ্ আমার সন্তানের যতদিন আয়ু রেখেছিলেন, ততদিন সে বেঁচেছে। আল্লাহ্-র ইচ্ছায় তার মৃত্যু হয়েছে। তাকে যারা হত্যা করেছে, আল্লাহ্ তাদের কেয়ামতের ময়দানে শাস্তি দেবেন।
কিন্তু, আমার সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার আপনাদের কারও নেই। আমার সন্তানের মৃত্যুর জন্য একটিও মানুষের উপর আক্রমণ করা চলবে না। একটিও মানুষকে হত্যা করা যাবে না। বাড়িঘর, দোকানপাট কোথাও ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ বা লুটপাট করা চলবে না।
ইসলাম আমাদের নিরীহ কোনো মানুষকে হত্যা করতে শেখায় না। ইসলাম আমাদের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রেখে বসবাস করতে শেখায়। আমাদের আসানসোলে আজ শান্তিশৃঙ্খলার প্রয়োজন। আপনারা যদি আমায় আপন মনে করেন, তাহলে ইসলাম নির্দেশিত শান্তি বজায় রাখবেন। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব আপনাদের।
আর যদি, আপনারা শান্তি বজায় রাখতে না পারেন, তাহলে ভাববো- আমি আপনাদের আপন নই। আমি আসানসোল ছেড়ে চিরতরে চলে যাবো।"
সাথে সাথেই পরিবেশ অদ্ভুতভাবে অত্যন্ত ঠান্ডা হয়ে যায়। জানাজার নামাজ শেষ হয়। প্রত্যেকেই নিজের নিজের বাড়ি ফিরে যান। মৌলানা সাহেব ফিরে যান মসজিদে।
না, আসানসোলের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে শান্ত করার জন্য একজন পুলিশ বা একজন প্রশাসনিক লোকের দরকার পড়েনি। মৌলানা সাহেবের মোহিত করা বক্তব্যই পুরো পরিস্থিতিকে শান্ত করে দেয়।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.