আমরা কি ধুলামুক্ত ঢাকা শহর পাব?
একসময় ভোররাতে এই ঢাকা শহরে সিটি করপোরেশনের গাড়ি প্রধান সড়কগুলোয় পানি ছিটাতো। পানিতে ধুয়ে যেত দুই পাশের গাছের পাতা। বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা বর্জ্যও পরিষ্কার হতো ভোরের আলো ফোটার আগেই। ভোরে নাগরিকরা পেত ধুলো-আবর্জনামুক্ত পরিচ্ছন্ন এক নগরী। কিন্তু এখন হয় না। শহরে বের হলেই ধুলোয় দম বন্ধ হয়ে আসে। অথচ বিভিন্ন দেশে এখনো ধুলো দূর করতে পানি ছিটানো হয়। সিটি করপোরেশনের গাড়ি প্রতিদিন শহর জেগে ওঠার আগেই রাস্তায় তো বটেই, রাস্তার দুই পাশের গাছের পাতায় পানি ছিটায়।
বর্ষাকালে বর্ষার পানিতে ঢাকা শহর ডুবতে দেখে নগরবাসী অপেক্ষার দিন গুনছিল, কবে বর্ষা শেষ হবে এবং চলাচলে একটু স্বস্তি ফিরবে। দুর্বল নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার কারণে স্বাভাবিক বর্ষায়ও খানাখন্দে ভরা রাস্তাঘাটে চরম জলজট ও যানজট দেখা দেয়। কর্মস্থলে পৌঁছাতে বিলম্ব, স্কুল-কলেজে যেতে অসুবিধা, অত্যাবশ্যকীয় যাতায়াতে অতিরিক্ত ভাড়া, এসব গা-সওয়া হয়ে গেছে। নগরবাসীর প্রত্যাশা ছিল, শুষ্ক মৌসুমে তাঁরা আরামেই চলাফেরা করতে পারবেন। কিন্তু সেই আপাত-আয়েশের ফুরসত কই? চলমান বিভিন্ন উন্নয়নকাজে সৃষ্ট ধুলাবালু এবং তা সামলানোর কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় নাগরিক জীবন বিষময় হয়ে উঠেছে।
ঢাকা শহরে জনচলাচলের রাস্তা, ফুটপাত ও খোলা জায়গা পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। এসব স্থানের পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ৬০০ পরিবারের ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, ৭৭ শতাংশ পরিবারের আশপাশের রাস্তা ও খোলা জায়গা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ঝাড়ু দেন; এ কাজ ভোর থেকে শুরু হয়ে সকাল আটটার মধ্যে শেষ হয়। কিন্তু তারপরই রাস্তার পাশের দোকানিরা ঝাড়ু দিয়ে ভেতরের ময়লা রাস্তায় ফেলেন। পরিচ্ছন্ন সড়ক নগরবাসী দেখার আগেই তা নোংরা হয়ে যায়। ২০১৫ সালের পর নির্বাচিত মেয়রদ্বয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতির প্রতি বিশেষ নজর দেন। যেমন রাস্তার পাশে ছোট ছোট বিন, চারদিকে দেয়ালঘেরা ‘দ্বিতীয় স্থানান্তর কেন্দ্র’ স্থাপন, কনটেইনার থেকে ট্রাকভর্তি বর্জ্য ঢেকে নেওয়া ইত্যাদি।
ঢাকা নগরের রাস্তা ও খোলা জায়গার সর্বত্রই ধুলাবালু। কয়েক বছর ধরে ঢাকায় উন্নয়নের মহা কর্মযজ্ঞ চলছে। যেমন ফুটপাতের উন্নয়ন, ইউলুপ ও উড়ালসেতু নির্মাণ, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার জন্য খোঁড়াখুঁড়ি। এসব উন্নয়ন বেশির ভাগ প্রত্যাশিত। সরকারি পর্যায়ে এসব কাজের জন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সাধারণত নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ করতে ঠিকাদারদের মধ্যে তাগাদা থাকার কথা; কারণ দীর্ঘসূত্রতা লভ্যাংশ হ্রাস করে। বাস্তবে দফায় দফায় বিভিন্ন প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে, সঙ্গে প্রকল্পের বরাদ্দও। এতে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সুবিধা পেলেও ভুক্তভোগী নগরবাসীর মধ্যে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রতি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। সরকারি প্রকল্প ছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়ে নির্মাণসামগ্রী জনচলাচলের পথে বিক্ষিপ্তভাবে ও দীর্ঘ সময় ধরে পড়ে থাকে। এসব তদারকের কার্যকর ব্যবস্থা বা নীতিমালার অভাব লক্ষণীয়।
ঢাকা নগরের পরিবেশ উন্নত করার বিকল্প নেই। মানুষ রোগাক্রান্ত হলে উৎপাদনশীলতা কমবে এবং স্বাস্থ্যগত ব্যয় বাড়বে; শহরের অর্থনৈতিক উন্নতিও ব্যাহত হবে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছর জিডিপির ১ শতাংশ হারাচ্ছে, যেটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে অন্যতম বাধা (প্রথম আলো, ১০ ডিসেম্বর ২০১৭)। তা ছাড়া ধুলাবালু থেকে রেহাই পেতে পথচারীরা যানবাহন ব্যবহারে উদ্যোগী হবে; তাতে যানজটের অবনতি হবে। এমনিতে ঢাকার জনসংখ্যার তুলনায় সড়কের পরিমাণ ও যানবাহনের সংখ্যা কম।
ব্যাপক প্রচারণা ও সচেতনতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ২০০৩ থেকে ঢাকার রাস্তায় টু-স্ট্রোক ইঞ্জিনচালিত যানবাহন নিষিদ্ধ করে সিএনজি প্রবর্তন করে। এতে ঢাকায় বায়ুদূষণ প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ কমে যায়। এখন আমাদের লড়তে হবে ধুলাবালুমুক্ত, পরিচ্ছন্ন ঢাকার জন্য। একটা বিরাট প্রশ্ন আমরা কি ধুলামুক্ত ঢাকা শহর পাব?
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.