ব্ল্যাকবক্স কী এবং এটা কী কাজে লাগে?
যেকোন বিমান দুর্ঘটনা হলেই উঠে আসে ব্ল্যাক বক্সের নাম। ব্ল্যাক বক্স আসলে কী? এটা কীভাবে কাজ করে? এটা কেন দরকার? এটা আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না। আজ আমরা ব্ল্যাকবক্স সম্পর্কে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার চেষ্টা করবো।
আমরা না চাইলেও ইউএস বাংলার মত দুর্ঘটনা ঘটে যায় অহরহই। হাজার হাজার ফুট ওপরে হাজার একটা কারণ থাকতে পারে দুর্ঘটনা ঘটার | কি কারণে হলো এরকম ঘটনা; সেটা জানা খুব জরুরি এইজন্যই যাতে সেই ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করে পরের দুর্ঘটনাগুলো রোধ যায় | কিন্তু কীভাবে সম্ভব অত উপরে, ঐরকম সময় কেন এরকম হলো সেটার খোঁজ নেয়া? ঠিক এই কাজটাই করে ব্ল্যাক বক্স |
ব্ল্যাক বক্স কী?
প্রথমেই জানা যাক মজাদার একটা তথ্য। ব্ল্যাক বক্স এর রং আদৌ কালো নয়, এর রং উজ্জ্বল কমলা। এই ঝকঝকে রঙের ভীষণ মজবুত এবং অসীম সহনশীল পদার্থের তৈরী এই বাক্সটা আসলে দুই ধরনের ডাটা-রেকর্ডার এর সমন্বয়ে তৈরী একটি single unit। যাত্রাকালীন সময় এর বিভিন্ন তথ্য - বিমানের কর্মীদের সাথে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এর কথাবার্তা জমা করতে থাকে এটি নিজের ভেতরের রেকর্ডিং সিস্টেম এ। এটি দুটো অংশ নিয়ে গঠিত।
একটি হলো flight data recorder (FDR)। যেটি বিমানের মধ্যের ও সংলগ্ন পরিবেশের বিভিন্ন রকমের শব্দ, চাপ ও তাপের পরিবর্তনের হিসাব এবং আরো অনেক রকমের ফ্লাইট সংশ্লিষ্ট তথ্য রেকর্ড করে।
আরেকটি হলো cockpit voice recorder (CVR), যেটি ককপিট এর ভেতরে পাইলটদের নিজেদের মধ্যের কথাবার্তা, পাইলটদের সাথে বিমানের অন্য ক্রুদের কথা, ককপিট এর সাথে বিভিন্ন এয়ারপোর্ট এর রেডিও কমুনিকেশন রেকর্ড করতে থাকে | অনেক সময় এই FDR আর CVR একসাথে না রেখে সামান্য দুরত্বে বসানো থাকে।
দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পর আহত মানুষদের বাঁচানো ছাড়াও উদ্ধারকারী দলের 2nd priority objective থাকে এই বাক্সটাকে খুঁজে বের করে উদ্ধার করা। ব্ল্যাক বক্সের উজ্জ্বল কমলা রং এই সময় সাহায্য করে বাক্সটিকে খুঁজে পেতে। ওই পরিবেশের সাথে খাপছাড়া ওই রং খুব সহজেই চোখে পড়ে। উদ্ধার করার পর এটি পাঠানো হয় বিশেষজ্ঞের কাছে। তারা ব্ল্যাক বক্সের তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে আসবার চেষ্টা করেন যে দুর্ঘটনার আদতে কারণ টা কি।
ব্ল্যাক বক্স এর নাম "ব্ল্যাক" বক্স কেন
ব্ল্যাক বক্স এর রং উজ্জল কমলা হওয়া সত্বেও একে "ব্ল্যাক" বক্স কেন বলে সেটা নিয়ে কয়েকটা মত আছে। আগে এই রেকর্ডারগুলোর রং হত কালো; তাই অনেকে বলেন যে এর থেকেই এই নামের উত্পত্তি। আবার কেউ কেউ বলেন, দুর্ঘটনার পর আগুনে পুড়ে এর রং কালো হয়ে যায় বলেই এরকম নামে একে ডাকা হয়। অনেকে আবার বলেন, দুর্ঘটনা, মৃত্যু এসব খারাপ ব্যাপারকে মাথায় রেখেই এরকম নাম দেয়া হয়েছে | নামের কারণ যাই হোকনা কেন, এর কাজ সেই একই | শেষ মুহূর্ত গুলোকে ধরে রাখা | আর এই শেষ মুহুর্তগুলোর তথ্য উদ্ধারের জন্য একে খুঁজে পাওয়া খুব জরুরি |
ব্লাক বক্সের আবিষ্কার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ ধরণের যন্ত্র তৈরির উদ্যোগ প্রথম নেয়া হয়। তবে সত্যিকারের ব্ল্যাক বক্সের কাজ শুরু হয় ১৯৫০এর দশকের গোড়ার দিকে। অস্ট্রেলীয় সরকারের এয়ারোনটিকাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে কেমিস্ট ডেভিড ওয়ারেন এটি আবিষ্কার করেন। ১৯৬২ সালের ২৩শে মার্চ প্রথম অস্ট্রেলিয়ার একটি বিমানে পরীক্ষামূলকভাবে এটির ব্যবহার করা হয়।
দুর্ঘটনার পরেও কিভাবে টিকে থাকে ব্ল্যাক বক্স?
এটি অত্যন্ত শক্ত ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয়। কয়েকটি লেয়ার দিয়ে এটি এমনভাবে তৈরি করা হয় যে, প্রচণ্ড উত্তাপ, ভাঙচুর, পানি বা প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও সেটি টিকে থাকতে পারে। স্টেইনলেস স্টিল বা টাইটানিয়ামের খোলস দিয়ে বক্সের আবরণ তৈরি করা হয়। টিকে থাকার অনেকগুলো পরীক্ষায় পাস করার পরেই ব্ল্যাক বক্সগুলোকে বিমানে সংযোজন করা হয়।
ব্ল্যাক বক্স কিভাবে তথ্য পায়?
আধুনিক ব্ল্যাকবক্সগুলোয় ২৫ ঘণ্টা পর্যন্ত বিমানের ফ্লাইট ডাটা ধারণ করে রাখতে পারে। এর ভেতর অনেকগুলো মেমরি চিপ পাশাপাশি সাজানো থাকে। এখানে তথ্য সরবরাহ করার জন্য বিমানের বিভিন্ন জায়গায় অনেক সেন্সর লাগানো থাকে। এসব সেন্সর অনবরত বিমানের গতি, তাপমাত্রা, সময়, ভেতর বাইরের চাপ, উচ্চতা ইত্যাদি বিমানের সামনের দিকে থাকা ফ্লাইট ডাটা অ্যাকুইজিশন ইউনিট নামের একটি অংশে পাঠাতে থাকে। সেখান থেকে সেসব তথ্য চলে যায় ব্ল্যাক বক্সের রেকর্ডারে। পাইলট, কো পাইলট, ক্রুদের বসার কাছাকাছি জায়গায় অনেকগুলো মাইক্রোফোন বসানো থাকে। তাদের সব কথাবার্তা, নড়াচড়া বা সুইচ চাপা ইত্যাদি সব এসব মাইক্রোফোনে রেকর্ড হতে থাকে। সেগুলো এ্যাসোসিয়েটেড কন্ট্রোল ইউনিট নামের একটি ডিভাইসে পাঠায়। এরপর সেসব তথ্য ব্ল্যাক বক্সে গিয়ে জমা হয়। বিমান চলাচলের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্ল্যাক বক্স তথ্য সংরক্ষণ করে রাখে। মূলত শেষের দিকে তথ্য এটিতে জমা থাকে। একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর আগের তথ্য মুছে যেতে থাকে আর নতুন তথ্য জমা হয়। ফলে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বশেষ তথ্য এটিতে পাওয়া যায়।
দুর্ঘটনার পর
ব্ল্যাক বক্স খুঁজে পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য একে টকটকে কমলা রঙ্গে রঞ্জিত করার পাশাপাশি আরো কিছু কারিগরী ব্যাপারও রাখা হয় | যানবাহনের গায়ে বা হাইওয়ের পাশে রোডসাইন গুলোতে যেমন refelctive material লাগানো থাকে, তেমনি টেপ লাগানো থাকে ব্ল্যাক বক্স এর গায়ে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিস লাগানো থাকে সেটা হলো underwater locator beacon। পানির সংস্পর্শে এলেই এর মধ্যে থাকা সেন্সর underwater locator beacon টাকে চালু করে দেয়। যে এটা চালু হয়, তারপর থেকে underwater locator beacon টা প্রতি সেকেন্ডে একবার করে ultrasonic শব্দের ঢেউ ছাড়তে শুরু করে আগামী ৩০ দিন পর্যন্ত। এমনকি ১৪০০০ ফুট পানির নিচে থেকেও এটি কাজ করতে সক্ষম। এর থেকে নির্গত শব্দ মানুষের কানে ধরা পরেনা ঠিকই, কিন্তু sonar বা acoustical locating যন্ত্রের দ্বারা এই শব্দ সনাক্ত করা যায়। ব্ল্যাক বক্স খুঁজে পাওয়ার পর চেষ্টা করা হয় আর কোনমতেই যেন এর রেকর্ডিং ডিভাইসগুলোর আর কোনো ক্ষতি না হয়। যেমনভাবে পাওয়া যায়, চেষ্টা করা হয় যেন সেইভাবেই এটাকে পরীক্ষাগারে নিয়ে যাওয়া যায়। সেই কারণে, ব্ল্যাক বক্স পানি থেকে উদ্ধার করা হলে একে পানিভর্তি কন্টেইনারে চুবিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যাতে একে যে পরিবেশে পাওয়া গেছে তা অক্ষুন্ন থাকে। পরীক্ষাগারে গেলে পরে বিশেষজ্ঞরা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
তথ্য পুনরুদ্ধার
ল্যাব এর নিয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় FDR আর CVR থেকে তথ্য উদ্ধারের প্রক্রিয়া। দুটো ডিভাইস থেকেই তথ্য উদ্ধার সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। আধুনিকতম প্রযুক্তির যন্ত্র, সফটয়্যার ব্যবহার করেও কখনো কখনো সপ্তাহ, এমনকি মাস ও লেগে যায় এর তথ্য উদ্ধারে। FDR যদি ঠিকঠাক থাকে তো এর মেমরি বোর্ড থেকে তথ্য উদ্ধার সামান্য সময়ের ব্যাপার | কিন্তু খুব সঙ্গত কারণেই, বেশিরভাগ সময়েই একে পাওয়া যায় ভাঙ্গাচোরা অবস্থাতে। তখন একে খুলে ফেলে ভেতর থেকে মেমরি বোর্ডগুলো বের করে ফেলে নতুন মেমরি ইন্টারফেস কেবল লাগিয়ে একে সংযুক্ত করা হয় নতুন FDR এর সাথে। এই নতুন FDR এর ভেতর এমন সফটয়্যার থাকে যেটা তথ্য উদ্ধারের পাশাপাশি এটাও খেয়াল রাখে, আগের তথ্য যেন ওভাররাইট না হয়ে যায়।
সবচে ঝামেলার কাজ হলো CVR এর তথ্য উদ্ধার করা। এই কাজের জন্য রীতিমত একটা বিশেষজ্ঞ দল তৈরী করা হয়। এই দলে থাকে এয়ারলাইন থেকে একজন প্রতিনিধি, বিমান প্রস্তুতকারী সংস্থার লোক, পরিবহন-নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ, ফ্লাইট-নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ইনভেস্টিগেটর। এছাড়াও থাকতে পারে ভাষা-বিশেষজ্ঞ এবং খুব প্রয়োজন হলে দোভাষীও। এরা মিলেই সম্পন্ন করেন ব্ল্যাক বক্স থেকে তথ্য উদ্ধারের অসীম ধৈর্যের এই সময়সাপেক্ষ কাজটি। বিমান দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য অমূল্য প্রয়োজনীয় এই যন্ত্রটি দিনে দিনে আরো উন্নত হয়ে উঠছে এবং আকাশে উড়ার নিরাপত্তাকে করে তুলছে আরো নিখুঁত।
ট্যাগ ও ট্রেন্ডঃ
কোন মন্তব্য নাই.